মদপান করার বিধান কী
ধূমপান ও মদপান কি সমান অপরাধ?
“ধূমপান করলে ৪০ দিনের ইবাদত কবুল হয় না” এ কথা কি সঠিক?
নি:সন্দেহে তামাক (Tobacco) থেকে তৈরি সকল প্রকার নেশা বস্তু গ্রহণ করা হারাম। যেমন: আগুন দিয়ে সিগারেট, বিড়ি, চুরুট, হুঁকো, সীসা বা অন্য কোন মাধ্যমে ধূমপান করা। অনুরূপভাবে পানের সাথে চিবিয়ে জর্দা খাওয়া, ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে গুল বা নাকে ঠুসে (নস্যি) ব্যবহার করা ইত্যাদি। এগুলো হারাম হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। কেননা মানব দেহে এগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব মারাত্মক ভয়ঙ্কর। আধুনিক স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের মতে, এর ফলে শরীরে বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি হয় যা ধূমপানে অভ্যস্ত মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে।
তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিশেষজ্ঞগণ বলেন,
“তামাক অত্যন্ত বিষাক্ত পদার্থ। একখানি সিগারেটে যতখানি তামাক আছে তা চিবিয়ে খেলে পুরোপুরি শরীরে যদি প্রবেশ করত তা থেকে দ্রুত মৃত্যু অনিবার্য। তবে ধূমপানের ফলেও ধীরে ধীরে আয়ু কমে আসতে থাকে-শুধু ক্যান্সারের প্রবণতার জন্যেই নয় হৃদরোগের জন্যেও বটে।” [উইকিপিডিয়া]
সুতরাং যারা এ সকল ক্ষতিকর দ্রব্য গ্রহণে অভ্যস্ত তাদের জন্য ফরজ হল, অনতিবিলম্বে এগুলো বর্জন করা এবং খাঁটি অন্তরে আল্লাহর নিকট তওবা করা।
মদপান করলে ৪০ দিনের সালাত কবুল হবে না:
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, মদ পান করে কেউ যদি নেশাগ্রস্ত হয় তথা মদের প্রভাবে মাতাল বা মস্তিষ্ক বিকৃত হয় অথবা কেবল মদ পান করে তাহলে তার ৪০ দিনের সালাত কবুল হবে না। (অন্যান্য ইবাদতের ব্যাপারে এ কথা আসেনি।)
এ প্রসঙ্গে হাদিস হল, আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَنْ شَرِبَ الْـخَمْرَ وَسَكِرَ لَمْ تُقْبَلْ لَهُ صَلَاةٌ أَرْبَعِيْنَ صَبَاحًا، وَإِنْ مَاتَ دَخَلَ النَّارَ، فَإِنْ تَابَ تَابَ اللهُ عَلَيْهِ، وَإِنْ عَادَ فَشَرِبَ فَسَكِرَ لَمْ تُقْبَلْ لَهُ صَلَاةٌ أَرْبَعِيْنَ صَبَاحًا، فَإِنْ مَاتَ دَخَـلَ النَّارَ، فَإِنْ تَابَ تَابَ اللهُ عَلَيْهِ، وَإِنْ عَادَ فَشَرِبَ فَسَكِرَ لَمْ تُقْبَلْ لَهُ صَلَاةٌ أَرْبَعِيْنَ صَبَاحًا، فَإِنْ مَاتَ دَخَلَ النَّارَ، فَإِنْ تَابَ تَابَ اللهُ عَلَيْهِ، وَإِنْ عَادَ كَانَ حَقًّا عَلَى اللهِ أَنْ يَّسْقِيَهُ مِنْ رَدْغَةِ الْخَبَالِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، قَالُوْا: يَا رَسُوْلَ اللهِ! وَمَا رَدْغَةُ الْـخَبَالِ؟ قَالَ: عُصَارَةُ أَهْلِ النَّارِ
‘‘কেউ মদ পান করে নেশাগ্রস্ত হলে তার চল্লিশ দিনের সালাত কবুল করা হবে না এবং এমতাবস্থায় তার মৃত্যু হলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। তবে যদি সে তওবা করে নেয় তা হলে আল্লাহ তাআলা তার তওবা কবুল করবেন।
এরপর আবারও যদি সে মদ পান করে নেশাগ্রস্ত হয় তা হলে আবারও তার চল্লিশ দিনের সালাত কবুল করা হবে না এবং এমতাবস্থায় তার মৃত্যু হলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অবশ্য যদি সে তওবা করে তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তার তওবা কবুল করবেন।
এরপর আবারও যদি সে মদ পান করে নেশাগ্রস্ত হয় তা হলে আবারও তার চল্লিশ দিনের সালাত কবুল করা হবে না এবং এমতাবস্থায় তার মৃত্যু হলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। কিন্তু যদি সে তওবা করে নেয় তা হলে আল্লাহ তার তওবা কবুল করবেন।
এরপর আবারও যদি সে মদ পান করে নেশাগ্রস্ত হয় তখন আল্লাহর হক হয়ে যায়, কিয়ামতের দিন তাকে ‘রাদগাতুল খাবাল’ পান করানো।
সাহাবিগণ বললেন: হে আল্লাহর রসুল, ‘রাদগাতুল খাবাল’ কী?
তিনি বললেন, তা হচ্ছে জাহান্নামীদের পুঁজ।”
[সহিহ ইবনে মাজা, হা/২৭৩৮, সহিহুল জামে-শাইখ আলবানী, হা/৬৩১৩ নাম্বার হাদিস]
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
من شرب الخمر لم تقبل له صلاة أربعين صباحاً
“যে ব্যক্তি মদ পান করবে তার চল্লিশ দিনের সালাত কবুল হবে না।”
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
لا يَشْرَبُ الخمرَ رجلٌ من أُمَّتِي ، فيَقْبَلُ اللهُ منه صلاةً أربعينَ يومًا
“আমার উম্মতের যে ব্যক্তি মদ পান করবে আল্লাহ তার চল্লিশ দিনের সালাত কবুল করবেন না।”
[নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, সহিহুল জামে, হা/৭৭১৭]
মাদকাসক্ত মূর্তিপূজারীর মত:
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
مدمن الخمر كعابد وثن
“মাদকাসক্ত মুর্তিপূজারীর মত।”
[ইবনে মাজাহ, হাসান-আলবানি, দ্রষ্টব্য: সিলসিলা সহিহাহ, হা/৬৭৭]
এ হাদিসের হাদিসের অর্থ কী?
– ইবনে আব্বাস রা. বলেন,
يشبه أن يكون فيمن استحلها
“যে মদপান করাকে হালাল মনে করে সে মুর্তিপূজারীর সাথে সাদৃশ্য রাখে।” (অর্থাৎ উভয়েই কাফের)। [মুনাবি-ফয়যুল কাদীর]
-সিন্ধী ইবনে মাজাহ-এর হাশিয়ায় বলেন,
هما سواء في عدم قبول الصلاة، فإن الكافر لو صلى لم تقبل صلاته
“সালাত কবুল না হওয়ার দিক দিয়ে তারা উভয়েই সমান। কেননা কাফের যদি সালাত আদায় করে তার সালাত কবুল হবে না।”
– শাইখ সালেহ আল ফাউযান (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, “সম্পর্ক রাখার দিক দিয়ে উভয়ে সমান। অর্থাৎ মূর্তিপূজারী যেমন সবসময় তার মূর্তির সাথে সম্পর্ক রাখে, সহজে সেখান থেকে সরে আসতে পারে না তেমনি যে মদ ও নেশাপানে অভ্যস্ত সে এগুলো সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। সহজে এই অন্ধকার পথ থেকে বের হয়ে আসতে পারে না।”
ধূমপান ও মদপান কি সমান অপরাধ?
ধূমপান, গুল-জর্দা ইত্যাদি সেবন আর মদপান সমান অপরাধ নয়:
বিশ্ববিখ্যাত ফতোয়া বিষয় ওয়েব সাইট islamweb-এ বলা হয়েছে,
قد اختلف أهل العلم في شارب الخمر، هل يجلد ثمانين جلدة أم أربعين؟ والذي عليه الجمهور هو الأول
أن تحريم شرب الدخان قد ثبت بأدلة صحيحة ولكنها غير صريحة، وأما الخمر فثبت تحريمها بالكتاب والسنة وإجماع الأمة، وأدلتها في كل ذلك صريحة، وقد ثبت فيها الحد في الدنيا مع ما توعد به شاربها في الآخرة.
وعليه؛ فشرب الدخان أمر محرم، ولكن فاعله لا يبلغ درجة شارب الخمر
“মদপানকারীর শাস্তি ৮০ দোররা নাকি ৪০ দোররা সে বিষয়ে আহলে ইলমগণ দ্বিমত পোষণ করেছেন। তবে জুমহুর বা অধিকাংশ আলেম প্রথম মতের পক্ষে। আর মদপান করার ব্যাপারে দলিলগুলো সহিহ ও স্পষ্ট কিন্তু ধূমপানের দলিলগুলো সহিহ হলেও সুষ্পষ্ট নয়। কিতাব, সুন্নাহ এবং উম্মতের ইজমা দ্বারা মদপান হারাম হওয়ার বিষয়টি সাব্যস্ত হয়েছে। এ সংক্রান্ত দলিলগুলোও সুষ্পষ্ট। মদপানের ব্যাপারে আখিরাতে শাস্তির হুমকির পাশাপাশি দুনিয়ায় দণ্ডবিধি রয়েছে।
এর উপর ভিত্তি করে বলা যায়, ধূমপান হারাম কিন্তু ধূমপান কারী মদপানকারীর স্তরে পৌঁছবে না।” [slamweb net]
সুতরাং বিড়ি-সিগারেট, গুল, জর্দা ইত্যাদি হারাম ও ক্ষতিকর দ্রব্যাদি সেবনের ফলে গুনাহগার হলেও তাকে মদপান করার মত অপরাধ বলা যাবে না।
আরেকটি বিষয় হল, পূবোর্ক্ত হাদিস সমূহে একমাত্র সালাতের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং ’মাদকাসক্ত ব্যক্তির ৪০ দিন সালাত ছাড়া অন্য কোন ইবাদত কবুল হবে না-বলার সুযোগ নেই।
আল্লাহু আলাম।