মেয়েরা কী কারণে চাকরির প্রতি আগ্রহী

‘Desensitization of Evil’ নামে একটা টার্ম আছে। এর মানে হলো খারাপ বা পাপের ব্যাপারে সংবেদনশীলতা কমে যাওয়া। যে সিরিয়াল কিলার, সে প্রথম যেদিন খুন করে, তার মধ্যে কিছুটা হলেও পাপবোধ থাকে। কিন্তু, ২-৪টি খুন করার পর তার মধ্যে তখন আর পাপবোধ থাকে না।

অনেকেই জীবনে কোনো নাটক-সিনেমা, ভিডিও গান, কিংবা খারাপ কিছু দেখেনি। সে হঠাৎ কোনোদিন একটি সামাজিক নাটক দেখলো। তখন তার মধ্যে বেশ পাপবোধ জন্ম নিবে। কিন্তু আস্তে আস্তে একটা-দুইটা নাটক, এরপর বাংলা সিনেমা, হিন্দি সিনেমা, ইংলিশ সিনেমা দেখতে থাকবে। এটা হলো ‘Chain Reaction’। একবার শুরু হলে চলতেই থাকবে। একসময় সে এসবে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।

একজন সিরিয়াল কিলারকে ‘খুন করা পাপ’ বলে আসলে তেমন একটা লাভ নেই। কারণ, পাপের প্রতি তার সংবেদনশীলতাই নেই। অথচ আপনি ছোট্ট একটা বাচ্চাকে বলে দেখুন- ‘পিঁপড়াগুলোকে এভাবে আগুনে পুড়িও না, আল্লাহ গুনাহ দিবেন’, এতেই দেখবেন কাজ হয়ে গেছে। সে পিঁপড়ার ঢিবিতে আগুন দিবে না।

দুই
২০২০ সালে HSC পরীক্ষায় ও সমমানের পরীক্ষায় মোট ৭০৬,৮৮৫ জন ছাত্র এবং ৬৬০,৪৯২ জন ছাত্রী নিবন্ধন করেছিল। পাশের হার যেহেতু শতভাগ, তারমানে ৭ লক্ষ+ ছাত্র এবং ৬ লক্ষ+ ছাত্রী পাশ করেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা ৪৬,১৫০ জন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ ডিপার্টমেন্টে ছাত্র-ছাত্রীর অনুপাত প্রায় সমান। তারপরও ধরে নিলাম ছাত্র-ছাত্রীর অনুপাত ৬০:৪০। তাহলে **বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১৮,৫০০ জন **(একজেক্ট ফিগার ১৮,৪৬০ জন)।

তিন
ইসলাম মেয়েদের/নারীদেরকে যেমন দায়িত্ব দিয়েছে, তেমনি দিয়েছে অধিকার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেই অধিকারগুলো বুঝিয়ে দেবার দায়িত্ব দিয়েছে পুরুষদের উপর। যেমন ধরুন, একজন মেয়ের জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ ঘটনা হলো বিয়ে। বিয়ের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের দায়িত্ব থাকে পুরুষের কাঁধে।

কিন্তু বিয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো Consent বা মত। একজন মেয়ের যদি বিয়েতে অমত থাকে, তাহলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই বিয়েকে ‘বাতিল’ বলেছেন। একজন মেয়েকে জোরজবরদস্তি করে বিয়ে দিতে পারবেন না; আপনি মেয়ের বাবা হোন বা ভাই হোন।

ইসলাম নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য জ্ঞানার্জনকে ফরজ করেছে। নারী জ্ঞানার্জন করবে, এটা তার অধিকার। কিন্তু নারীকে কিভাবে সুষ্ঠুভাবে জ্ঞানার্জন করানো যায়, সেই ব্যবস্থা করার দায়িত্ব ইসলাম পুরুষকে দিয়েছে। বাবা, ভাই বা স্বামী নারীর জন্য সুষ্ঠু শিক্ষার্জনের ব্যবস্থা করবে।

নারীর অর্থনৈতিক অধিকারের দিকটা দেখুন। একজন মেয়ের বিয়ের আগ পর্যন্ত ভরণপোষণের দায়িত্ব ইসলাম পুরুষের কাঁধে দিয়েছে। বিয়ের আগ পর্যন্ত একজন মেয়ে তার বাবা বা ভাইয়ের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পাওয়াটা তার অধিকার, অন্যদিকে সেটা তার বাবা-ভাইয়ের পূরণ করা তাদের দায়িত্ব।

বিয়ের সময় দেনমোহর পাওয়া একজন মেয়ের অধিকার। সেটা তার স্বামী থাকে প্রদান করবে, স্বামীর সেটা দায়িত্ব। বিয়ের পর পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব স্বামীর কাঁধে। স্বামী পরিবারের জন্য খাবার কিনবে, পোশাক কিনবে, যাবতীয় ব্যয় বহন করবে। হাদীসে এটাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, এটাকে ‘সাদকাহ’র সমান সওয়াব বলা হয়েছে। স্বামী স্ত্রীকে হাত-খরচের টাকা দিবে। এটাও তার দায়িত্ব, স্ত্রীর ক্ষেত্রে সেটা পাওয়া তার অধিকার।

ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় মেয়ে/নারীর ব্যয় করার ক্ষেত্র একেবারে সীমিত। তাদের ব্যয় করার ক্ষেত্রগুলোর চেয়ে সঞ্চয় করার ক্ষেত্র বেশি। তবুও ইসলাম তাদের জন্য আর্থিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। পিতার সম্পত্তি থেকে তারা ভাগ পায়, স্বামীর সম্পত্তি থেকেও তারা ভাগ পায়।

একপক্ষের কাছে যা ‘অধিকার’, আরেক পক্ষের কাছে সেটা বুঝিয়ে দেওয়া হলো ‘দায়িত্ব’। অধিকার এবং দায়িত্ব, এই দুটোকে একটা থেকে আরেকটা আলাদা করার সুযোগ নেই। যখন দুই পক্ষ দুই পক্ষের দায়িত্ব পালন করবে, তখন এমনিতেই দুই পক্ষ দুই পক্ষের অধিকার পেয়ে যাবে। কিন্তু, যখন এক পক্ষ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করবে, তখন আরেক পক্ষ অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।

যেমন:
আমি একটি দোকান থেকে ১০ টাকার পণ্য বাকিতে কিনলাম। আমার দায়িত্ব হলো সময়মতো সেটা পরিশোধ করা। দোকানদারের অধিকার হলো ধারের টাকা ফেরত পাওয়া। আমি যখন দোকানদারকে ১০ টাকা না দিয়ে, ৫ টাকা পরিশোধ করবো, দোকানদার তখন ৫ টাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। আমি আরেকদিন ১ কেজি আলু টাকা দিয়ে কিনতে গেলে আমার অধিকার থাকবে ওজন ঠিকমতো পাওয়া, দোকানদারের দায়িত্ব থাকবে ঠিকমতো মেপে দেওয়া। কিন্তু, আমি আমার আগের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন না করায় দোকানদার আমাকে ১ কেজির জায়গায় ৯০০ গ্রাম আলু দিয়ে তার না-পাওয়া অধিকার শোধ করেছে।

তখন যদি কেউ দোকানদারকে বলে, “আপনি মাপে কম দিলেন কেনো?
” সে তখন বলবে, “লোকটি যখন আমার পাওনা পরিশোধ করলো না, আপনি তখন কোথায় ছিলেন? আপনাকে তো পাওনাদারের ধার পরিশোধের ওয়াজ করতে কখনো দেখলাম না!”

আমাদের দেশের নারী-পুরুষের অধিকার-দায়িত্বের আলোচনাগুলো ঠিক এই উদাহরণের মতো। আমার আশেপাশের মা-চাচী-খালাদের উদাহরণই দিই। ইসলাম তাদেরকে সবচেয়ে বড়ো যে দুটো আর্থিক অধিকার দিয়েছে (দেনমোহর, সম্পত্তির উত্তরাধিকার), সেগুলো থেকে তারা বঞ্চিত। বাংলাদেশের মেয়েরা একইসাথে এই দুটোর অধিকার বুঝে পেয়েছে, এমন সংখ্যা ১% হবে কিনা আমি নিশ্চিত নই।
বিশেষ করে সম্পত্তিতে নারীর অংশ বুঝিয়ে দেয়ার তো প্রশ্নই আসে না! এই বাস্তবতাটি আমাদের সমাজের সাধারণ মানুষ থেকে আলেম পরিবারে পর্যন্ত বিদ্যমান। যে ১% পরিবার নারীর অধিকারের ব্যাপারে সচেতন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ হলো সমাজের মধ্যে গুটি কয়েক আলেম পরিবার অথবা দ্বীন সচেতন পরিবার।

তারউপর মানুষের ইসলামের প্রতি আবেগ থাকলেও, জানাশোনা এবং মানার অনেক ঘাটতি আছে। ফলে পরিবারের মেয়ে, স্ত্রী, বোন যারা ঘরে থাকে, ঘরের কর্মক্ষম পুরুষ তাদেরকে খোঁটা দেয় না, এরকম পরিবার কয়টা আছে? ‘সারাদিন ঘরে কী করো? গল্প করছো আর খাচ্ছো, ঘুমাচ্ছো’ এসব কথা হরহামেশাই ঘরের কর্তা বলে থাকেন।
ছোট্ট মেয়ে, যখন তার বাবাকে বলতে শুনেছে (তার মাকে বলছে), ‘সারাদিন তো ঘরে বসে আছো, আমিই রুজি করে খাওয়াচ্ছি, তুমি এতো কথা বলো কেনো?

যাও আমি দেবো না, পারলে রুজি করে নিয়ে আসো’, সেই মেয়েটি চাইবে না যে, বড়ো হয়ে সে আর ঘরে থাকতে। কারণ, সে বুঝেছে, ঘরে থাকলে তাকে খোঁটা শুনতে হবে তার মায়ের মতো।

দেশের ৯৯% মেয়েরা/নারীরা তাদের আর্থিক অধিকার থেকে পারিবারিকভাবে বঞ্চিত। ‘নারীর অধিকার’ সংক্রান্ত বাজারে যেসব বই আছে, ইউটিউবে যতো ওয়াজ আছে, সেগুলোকে দেখানো হয় অন্যান্য সভ্যতা থেকে ইসলাম কতোটা সভ্য সেই বিষয়টি। কিন্তু, ইসলাম নারীকে যে অধিকার দিয়েছে, মুসলিম সমাজ সেটার কতোটা প্রয়োগ করেছে, কিভাবে প্রয়োগ করবে সেই সংক্রান্ত আলোচনা খুব কম থাকে।

চার
উপরের পরিসংখ্যানে দেখতে পাই, প্রায় ১৮,৫০০ মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগামী ২-৪ বছর পর গ্র্যাজুয়েট হবে। তারমানে সে তার জীবনের ২৪-২৫ বছরের মধ্যে ১৮-১৯ বছর পড়ালেখায় কাটিয়েছে প্রাইমারি, মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে। বেশিরভাগই ‘প্রি-মিক্সিং’ –এ অভ্যস্ত, ছেলেদের সাথে কথা বলা, গ্রুপ স্টাডি করা, প্রেজেন্টেশন দেওয়া, ইন্টার্নশিপ করে তাদের কাছে ফ্রি-মিক্সিং আর ট্যাবু হিশেবে থাকেনি। খুব স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

যারা খুবই ধার্মিক, তারা হয়তো এসব বিষয়ে ‘Compromise’ নীতি ফলো করেছে। বোরকা, নিকাব পরে ঠিক যতোটুকু ইন্টারেকশন না করলেই নয়, ততোটুকু তারা করেছে; বাকিটার ব্যাপারে তারা সচেতনভাবে দূরে থেকেছে।

এই আর্টিকেলের মূল জায়গাটি হলো এখানে। ১৮-১৯ বছর এমন একটা পরিবেশে পড়াশোনা করে সে যখন শুনে- ‘ইসলামে চাকরি করা হারাম’ তখন এই বাক্যটি বেশিরভাগের কাছে কী মনে হয় জানেন?
প্রথম অনুচ্ছেদের ‘Desensitization of Evil’ –এর উদাহরণগুলোর সাথে মিলিয়ে নিন।
চাকরি কেনো হারাম, এটার পক্ষে আপনি সবচেয়ে বড়ো দুটো আর্গুমেন্ট দেখাবেন।

১. সেখানে ফ্রি-মিক্সিং হবে, পর্দা-পালন ঠিকমতো হবে না।
২. ঘরের দায়িত্ব, দেখাশোনা করতে হবে, স্বামীকে অসন্তুষ্ট রাখা যাবে না।

১৮-১৯ বছর একজন মেয়ে যে পরিবেশে কাটিয়েছে, চাকরির পরিবেশের সাথে সেটার খুব একটা পার্থক্য নেই। অনেকটাই একই পরিবেশ। চাকরির প্রশ্নে আপনি যেটাকে ‘পাপ’ হিশেবে দেখাতে চাচ্ছেন, সে তো বলবে- ‘আমি তো এই পাপের সাগরে প্রায় ২০ বছর ধরে ডুবে আছি’।
আমাদের মা-চাচী-খালা-ফুপুদের কাছে একটি অফিসে পুরুষদের সাথে চাকরি করার গুনাহর বয়ান শুনে যে সংবেদনশীলতা কাজ করবে, সেটা প্রায় ২০ বছর পড়াশোনা করা মেয়েটার কাছে একই আবেদন রাখবে না।

আর দ্বিতীয়ত, সে তার বাপ-চাচাকে দেখে এসেছে তারা তাদের ঘরের স্ত্রীদের সাথে কেমন আচরণ করে, তাদেরকে কিভাবে খোঁটা দেয়। সে চাইবে না তার মা-চাচীর মতো ‘ঘরের বোঝা’ হয়ে স্বামীর কথা শুনতে। সে পাল্টা প্রশ্ন করবে নিজেকে- ‘আমি কি কম যোগ্য?
এতোদিন পড়ালেখা করেছি কি গৃহিণী হবার জন্য?’

সে যে সমাজে বেড়ে উঠেছে, সেই সমাজের মানুষদেরকে দেখেছে ‘গৃহিণী’ –কে যথাযথ সম্মান না করতে, মর্যাদা না দিতে, গৃহিণীর কথাকে গুরুত্ব না দিতে। অন্যদিকে, তার কোনো এক স্কুল শিক্ষিকা আত্মীয়কে জামাইর বাড়ি, বাপের বাড়ি কী পরিমাণ সম্মান দেওয়া হয়, সেটাও সে চোখের সামনে দেখেছে।

সে দেখে, ইসলাম তাকে যে অধিকার দিয়েছে, তার বাপ-ভাই-স্বামী সেসব অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত রেখেছে। ঠিক যে মুহূর্তে সে চাকরি করে স্বাবলম্বী হবার চিন্তা করছে, সেসময় ‘চাকরি করা হারাম’ ফতোয়াটি সে আনায়াসে পাশ কাটিয়ে যেতে পারে। আল্লাহ/খোদার দোহাই দিয়ে তার মা-চাচীকে চুপ রাখা হয়েছে, মা-চাচী প্রাপ্য অধিকার আর সম্মান তো পায়ই নি, উল্টো ঘরে থাকার জন্য অপমানিত হয়েছে, সন্তানের জন্য স্বামীর কাছে টাকা চাইতে গেলে বকা শুনতে হয়েছে।

সে প্রশ্ন উঠায়- ‘আমার মায়ের অধিকারের বেলায় কেউ তো এগিয়ে এসে সেটা আদায় করেনি, কেউ ফতোয়া দেয়নি। আজ আমি যখন অধিকার আদায় করতে শিখেছে, আজ আপনারা ফতোয়া নিয়ে আসবেন না!’

পরিবার-সমাজের মানুষের আচরণ তাকে ইসলাম থেকে সরিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। মানুষের আচরণের ফলে তার মনে রবের দেয়া বিধান নিয়ে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। মজার ব্যাপার হলো, বোরকা আর নিকাব পরা মেয়েদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে বলে আমরা উচ্ছ্বাস করি, মনে করছি মোটামুটি ইসলাম কায়েম হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, এরচেয়ে দ্রুত গতিতে মেয়েদের মধ্যে যেভাবে ‘আধুনিক’ হবার প্রয়াস দেখা যাচ্ছে, সেটা হয়তো আমরা উপলব্ধি করতে পারছি না।

পাঁচ
মুফতি কে?
মুফতির সংজ্ঞায়ন করা হয়:
“মুফতি হলেন এমন ব্যক্তি, যিনি আল্লাহর নামে স্বাক্ষর করেন।”
কোনো একটি বিষয়ে ফতোয়া দেওয়া চট্টিখানি কথা না।
কুরআন-হাদীসের ‘নস’ বা টেক্সট আর পূর্ববর্তী ইমামগণের ফতোয়া থেকে এটা মোটামুটি স্পষ্ট যে, ইসলাম মেয়েদের চাকরির ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করে। ইসলামে নারীর স্বাভাবিক যে দায়িত্ব পালনের কথা বলা আছে, সেগুলো পালন করে ওভারটাইম জব করেও মূল দায়িত্ব পালন সম্ভব কিনা সেটা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।

তারউপর তো আছে পর্দা, নন-মাহরামের সাথে ইন্টারেকশনের বিষয়গুলো। নারীদের চাকরির ব্যাপারে ইসলামের ‘রুল অব থাম্ব’ দেখা যাবে- নিরুৎসাহিত করে, নিষেধ করে।
তারপরও পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বল্প সংখ্যক স্কলার শর্তসাপেক্ষে অনুমোদন দেন। যেসব শর্তারোপ করা হয়, সেগুলো মেনে বর্তমান সময়ে খুব কম সংখ্যক জব সেক্টরে জব করা যাবে।

এক্ষেত্রে মূল প্রশ্নটি যতোটা না মেয়েদের চাকরি সংক্রান্ত, তারচেয়ে বেশি পড়াশোনা সংক্রান্ত। অর্থাৎ, চাকরি হালাল-হারাম, জায়েজ-নাজায়েজের প্রশ্নের ‘Root Cause’ হলো- শিক্ষা। মজার ব্যাপার হলো এই প্রশ্নটি একটি ‘প্যারাডক্সিকাল কুয়েশ্চন’।
ইসলাম মেয়ে/নারীদের উপরও শিক্ষা ফরজ করেছে। তাদেরকে চাকরির ক্ষেত্রে না হয় বাধা দিতে পারবেন, কিন্তু শিক্ষার্জনের জন্য বাধা দেবার সুযোগ নেই। বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থা হলো- স্কুল-কলেজ অথবা মাদ্রাসা।

দুটোর মধ্যে জনপ্রিয় হলো স্কুল-কলেজ। এদেশের মুসলমানদের মধ্যে মাদ্রাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থী, শিক্ষকের প্রতি স্নেহ, সম্মান ভক্তি থাকলেও নিজের সন্তানকে মাদ্রাসায় দেবার ব্যাপারে তার দ্বিগুণ অনাগ্রহ দেখা যায়। মাদ্রাসার শিক্ষকরা প্রায়ই আফসোস করে বলেন,
“মা-বাবা মেধাবী সন্তানকে পাঠান স্কুল-কলেজে, আর কম মেধাবী, ত্যাড়াদের পাঠান মাদ্রাসায়!”
দেশের মানুষজন যেখানে ছেলেদেরকে মাদ্রাসায় পাঠাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না, সেখানে মেয়েদেরকে মাদ্রাসায় পাঠানোর ব্যাপারে অনেক সাতপাঁচ ভাবেন। তারউপর সব এলাকায় পর্যাপ্ত মহিলা মাদ্রাসাও পাওয়া যায় না।

ছয়
মেয়ে/নারীদের চাকরি করার ব্যাপারটি এখন আর স্রেফ ফতোয়া কেন্দ্রিক সমাধানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় (অর্থাৎ ধর্মীয় প্রশ্ন না)। এই প্রশ্নটি এখন আর্থ-সামাজিক প্রশ্ন। একদিকে সমাজের পুরুষদের কাছ থেকে যথাযথ অধিকার, সম্মান না পাওয়ায় তারা নিজেরাই সম্মানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে স্বাবলম্বী হবার পথে ঝুঁকছে (They are pushed)। অন্যদিকে, মডার্নিটি তাদেরকে উৎসাহ দিচ্ছে, তাদের নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।

এই প্রশ্নের সমাধানের একদিক হলো সমাধানযোগ্য, আরেক দিক হলো সময়সাপেক্ষ। সমাধানযোগ্য দিকটি হলো নারীদের অধিকারের প্রশ্নে ইসলাম যেসব অধিকার দিয়েছে সেগুলো নিশ্চিত করা এবং নারীদের ব্যাপারে সমাজে বিদ্যমান অসম্মানজনক কথা বলা, খোঁটা দেওয়া বন্ধ করা। ইসলাম হলো একটি সিস্টেম। সামাজিক জীবনব্যবস্থার ইসলামি সিস্টেমের একটি দিক পূরণ না করলে, সেটা আরেক দিকে সমস্যা সৃষ্টি করবে। দায়িত্ব আর অধিকারের প্রশ্নটি এমনই।

দ্বিতীয় সমাধানের মূল সমস্যা হলো মডার্নিটি। মডার্নিটি মুসলিম সমাজে অনেকগুলো সমস্যা সৃষ্টি করেছে, যেগুলো আগে কখনো ছিলো না। নারীদের চাকরি করাটা হলো একটি Modern Phenomena। এটি শুধু মুসলিম সমাজেই না, পুরো বিশ্বে অভূতপূর্ব ঘটনা। ইউরোপ, অ্যামেরিকার ইতিহাস পড়লেই দেখতে পাবেন; আজ থেকে দুশো বছর আগে এমন প্রবণতা ছিলো না।

মডার্নিটির মোকাবিলায় কেউ কেউ ইসলামের টেক্সটকে কাটছাঁট করে মডার্নিটিকে গ্রহণ করেছেন। এই পদ্ধতিতে সমাধান না এসে আরো সমস্যা তৈরি করেছে। মডার্নিটির সাথে মিলিয়ে মনমতো একটি জীবন ব্যবস্থা তৈরি হবে, যেখানে সব থাকলেও ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা থাকবে না।
মডার্নিটির সাথে খাপ খেয়ে ইসলামকে সেভাবে ব্যাখ্যা না করে, ইসলামের টেক্সটকে তার জায়গায় অক্ষুণ্ণ রেখে মডার্নিটির সাথে বোঝাপড়া করলে সমাধান আসতে পারে। মডার্নিটির সমস্যা এবং সমাধান যে স্রেফ ফতোয়া কেন্দ্রিক না, এটা বুঝার জন্য মেয়েদের চাকরি করা না করার উদাহরণটি যথেষ্ট।

চাকরি না করার ব্যাপারে যারা ফতোয়া দিচ্ছেন, তাদের সামনে আছে কুরআন-হাদীস আর সালাফদের অকাট্য দলীল। আর চাকরি করার ব্যাপারে যারা আগ্রহ দেখাচ্ছে, তাদের মনস্তত্ত্বের পেছনে কাজ করছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা এবং প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা। এটাকে ট্যাগিং দিয়ে তাদেরকে দূরে সরিয়ে দেওয়া মানে তাদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে যেটুকু সুধারণা আছে, সেখানে পানি ঢালা।

পুরো লেখার পয়েন্ট অব ভিউ আবার ক্লিয়ার করে নিই; যদিও সেটা পুরো লিখায় ক্লিয়ার ছিলো।

১. কোন এমন আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার মুখে মেয়েরা চাকরিমুখী হচ্ছে।
২. মেয়েদেরকে ইসলাম যে আর্থিক অধিকার দিয়েছে, সমাজের মুসলিমগণ সেটা দিচ্ছেন কি-না? সেগুলোও যে একধরণের ‘অবিচার’ সেটা নিয়ে কি সচেতন মহল সোচ্চার?
৩. আধুনিকতার সংকট (Crisis of Modernity) মোকাবিলা করতে হলে ‘ব্যবস্থাপনা’ কিভাবে করতে হবে সেই বিষয় নিয়ে ভাবা উচিত। এই ব্যবস্থাপনার অভাব শুধুমাত্র ‘করতে হবে’ টাইপের বক্তব্য দিয়ে হয় না। করে দেখাতে হয়।
৪. সমাজের বেশিরভাগ মানুষ পরিপূর্ণ ইসলাম মেনে চলে না। যার ফলে, মেয়েদের সাথে অনেকক্ষেত্রে জাহেলী যুগের মতো আচরণ করা হয়। তাদেরকে জীবন্ত মাটিচাপা দেয়া হয় না ঠিক, কিন্তু নানানভাবে হেয় করা হয়, খোঁটা দেয়া হয়।
ফলে তাদের মনে সমাজের মানুষের প্রতি একধরণের চাপা ক্ষোভ কাজ করে। এটা থেকেই অনেকসময় সে সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে ‘প্রতিষ্ঠিত’ হবে। প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজেই নিজের অধিকার বুঝে নেবে।

তার অধিকার দেবার বেলায় যখন ইসলাম মানা হয় না, কিন্তু তার জিঁদ ধরার পর যখন তাকে ইসলামের ফতোয়া দেখানো হয়, তখন সে ইসলামকেই তার প্রতিপক্ষ মনে করে!
আর যখন সে বুঝে, তার ইসলামি অধিকার দেয়া হচ্ছে না, কর্তব্যকে ইসলামের নামে আটকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, তখন সে ইসলামের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

এটা হলো দায়িত্ব ঠিকমতো পালন না করার, অধিকার আদায় না করার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। নিউটনের সূত্র অনুযায়ী- Every action has an equal or opposite reaction. অর্থাৎ, প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান বা বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে।

মেয়েদের চাকরি করা না করার মনস্তত্ত্ব

লিখেছেন

আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

Exit mobile version