মায়ের দোয়া
কাঠফাটা রোদে প্রচন্ড গতিতে হাঁটছে রাশেদ। গন্তব্যস্থল ধানমন্ডি।
বারবার ঘড়ি দেখে নিচ্ছে। দেরী হয়ে যাচ্ছে নাতো! দুপুর তিনটা বেজে ত্রিশ মিনিটে তার টিউশন আছে। পৌঁছাতে হবে তিনটা পনের কিংবা বিশ এর মধ্যে। পাঁচ মিনিট এদিক-সেদিক হলেই স্টুডেন্টের মা বকাবকি শুরু করে দেয়। কিছুটা তীক্ষ্ণ মেজাজের মানুষ তিনি।
এ সময়টা মূলত খাওয়ার সময়। এ সময়ে না খেয়ে পড়াতে যাওয়াটা রীতিমতো অযৌক্তিক ব্যাপার। কিন্তু এই সময়ে ছাড়া অন্য কোন সময়ে পড়ানোর জন্য স্টুডেন্টের মা অসম্মতি জানিয়েছেন। রাশেদের ও কোন উপায় নেই।
সেই নিজেও স্টুডেন্ট মানুষ। হুট করেই তো আর টিউশন ছেড়ে দিতে পারেন না। এই টিউশনটা খুঁজে পেতেই অনেক বেগ পেতে হয়েছিল তাকে। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই এমন সময়ে পড়ানোর কথা মেনে নিতে হয়েছে।
ভার্সিটির ক্লাস শেষে ক্ষুধায় প্রান ওষ্ঠাগত হয়ে যায় তার। কিছু খাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ ক্লাস শেষ হতে হতে দুইটা ত্রিশ বেজে যায়। ক্লাস শেষে হোটেলে খেতে গেলে বিশ-ত্রিশ মিনিট সময় লেগে যাবে। এর ফলে সঠিক সময়ে টিউশনিতে যেতে পারবে না সে।
একদিন তো ক্ষিদের জ্বালায় প্রায় অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম হয়ে গিয়েছিলো তার। তাই তাড়াতাড়ি হোটেলে গিয়ে দু লোকমা গলাধঃকরণ করে টিউশনির উদ্দেশ্য রওনা হয়েছিল। কিন্তু স্টুডেন্টের বাসায় গিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে তিনটা বেজে চল্লিশ মিনিট। দশ মিনিট বিলম্ব হয়ে গিয়েছে তার! কিছু কারণে আরও দুইদিন যথাসময়ে উপস্থিত হতে পারে নি সে।
যার ফলশ্রুতিতে, মাস শেষে বেতন হাতে পেয়ে দেখে সেখান থেকে তিন দিনের টাকা কেটে রাখা হয়েছে। বিষয়টা তাকে খুব আশ্চর্যান্বিত করেছিলো। তারপর থেকে যতই ক্ষিদে লাগুক না কেন না খেয়েই টিউশনির উদ্দেশ্য রওনা দেয় সে।
– কিরে ভাইয়া, বেতনটা পেলি? (শুষ্ক মুখে আগ্রহের চোখে প্রশ্ন করলো তানিয়া)
– না রে, আজও দেয় নি। আমি লজ্জা ত্যাগ করে বেতন চেয়ে এসেছি। স্টুডেন্টের মা বললো, আজকে মাসের দুই তারিখ মাত্র আরও কিছুদিন যাক তারপর দিবো। তাছাড়া আমাদের হাতে এখন টাকা নেই। টাকা হাতে আসলে দিয়ে দিবো।
– তুই বলিস নি যে আম্মা অসুস্থ? আম্মার ঔষধ শেষ হয়ে গিয়েছে। ডাক্তার তো বললো অপারেশন করানো লাগবে না হয় আম্মা বেশিদিন বাঁচবে না বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো তানিয়া।
– তা আবার বলি নি বুঝি! সবই বলেছি। ওনারা বড়লোক মানুষ যখন মন চাইবে তখন দিবে। ওনারা কি গরীবের কষ্ট বুঝবে, বল!
পাঁচ বছর হয় বাবা মারা গিয়েছে রাশেদের। সে’ই পরিবারের বড় সন্তান। তানিয়া তার ছোট বোন। পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় সংসারের সব দায়িত্ব এসেছে তার কাঁধে। ছোট বোনটাকে পড়াশোনা করানো, নিজে পড়াশোনা করা তাছাড়া গত এক বছর ধরে তার মায়ের অসুস্থতা আরও বেড়েছে, ওনার ঔষধ পত্রের খরচ সামলাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। ভাগ্যিস তারা বাবা সরকারি চাকরি করতেন! ওনার পেনশনের টাকায় আর তার টিউশনের টাকা মিলিয়ে কোনমতে টেনেটুনে সংসার চলে তাদের।
একদিন মাছ খেলে দুইদিন ডাল, আলুভর্তা দিয়ে ভাত খেতে হয়।
রাশেদ অনেক মেধাবী ছাত্র। মাস্টার্স টা ভাল ভাবে শেষ করতে পারলেই একটা ভাল চাকরিতে যোগদান করতে পারবে। তখন আর কোন অভাব থাকবে না তাদের সংসারে। “এই তো আর মাত্র একটা বছর তারপরই সব ঠিক হয়ে যাবে” এই বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় রাশেদ।
– ভাইয়া আম্মার অবস্থা ভাল না। অবিলম্বে চিকিৎসা শুরু করা লাগবে না হয় আম্মার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাবে। তুই যেদিক থেকে পারিস কিছু টাকা নিয়ে তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিকেলে আয়। কথাগুলো একটানা বলে মোবাইলের লাইন কেটে দিলো তানিয়া।
– তানিয়া, এই তানিয়া! আম্মার কী হয়েছে? কথাটা জিজ্ঞেস করতেই মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখে তানিয়া লাইন কেটে দিয়েছে।
রাশেদ তখন স্টুডেন্টের বাসায়। স্টুডেন্টের মায়ের কাছে অগ্রীম বেতন চেয়েছিলো কিন্তু স্টুডেন্টের মা মুখের উপর টাকা নেই বলে চলে গেলো। অথচ স্টুডেন্ট একটু আগে বলেছে তাকে আজকে একটু তাড়াতাড়ি ছুটি দিতে। কারণ তারা আজ শপিং করতে যাবে।
স্টুডেন্টকে পড়ানো শেষে ক্লান্ত পায়ে হাসপাতালের দিকে দৌড়ে যায় রাশেদ। মায়ের অবস্থা দেখে দাঁড়ানো থেকে সোজা মাটিতে বসে পড়ে সে। তার মা স্ট্রোক করেছে। টয়লেটে যাওয়ার সময় অসাবধানতা বসত পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। তারপর থেকে আর জ্ঞান ফেরে নি।
ডাক্তার ইসিজি করে বলেছে অতিসত্বর চিকিৎসা শুরু করাতে নাহয় ওনাকে বাঁচনো সম্ভব হবে না।
কিন্তু এই স্বল্প সময়ে কোথা থেকে টাকা জোগাড় করবে রাশেদ! মাথা কাজ করছে না তার।
মোটামুটি সব আত্মীয়ের কাছে সাহায্য চেয়ে তাদের দোরগোড়ায় হাজির হয়েছিলো সে। কিন্তু কেউই তাকে সাহায্য করে নি। সে এ ও বলেছিল, আপনারা আমাকে দান করতে না চাইলে কিছু টাকা না হয় ধার দিন। কথা দিচ্ছি আমি চাকরি পেলে আপনাদের সব ঋণ পরিশোধ করে দিবো। এই কথাটি শোনার পর তার দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ব্যঙ্গাত্মক সরে হেসে উঠেছিল তার চাচা আনোয়ার হোসেন।
– এখনও মাস্টার্স শেষ করে নি সে কিনা চাকরি করে আমার টাকা পরিশোধ করবে! আমি এতো হুজুগে পাগল নই যে একটা বেকার ছেলেকে টাকা ধার দিবো। যা অন্য কোথা থেকে টাকা জোগাড় কর গিয়ে। কথাগুলো বলে মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো আনোয়ার হোসেন।
সবার কাছে সাহায্য চাওয়া শেষ কিন্তু এখনও টাকা জোগাড় করতে পারে নি। এদিকে তার মা’কে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে রেখে এসেছে। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে তার।
হাসপাতালে গিয়ে দেখে তার বোন মা’কে ধরে কান্না করছে। ভাইকে দেখে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো টাকা জোগাড় হয়েছে কিনা। ভাই কাঁদো কাঁদো স্বরে স্বরে বললো না রে কেউই সাহায্য করলো না আমাকে।
– কিন্তু মা’কে কতক্ষণ এভাবে বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখবো! মায়ের অবস্থা তো আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার মাত্র এসে একটা ঔষধ কিনে আনার কথা বললো। এখনই না খাওয়ালে নাকি মা’কে আর বাঁচানো যাবে না বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো তানিয়া।
রাশেদ দৌড়ে ঔষধের দোকানে গেলো। গিয়ে জানতে পারলো ঔষধটার দাম প্রায় দশ হাজার টাকা। পকেটে হাত দিয়ে দেখে একশো টাকার একটা নোট ছাড়া আর এক পয়সাও নেই। এ টাকা দিয়ে তো কিছুই হবে না!
নিজের শরীরটা আজ খুব ভারি মনে হচ্ছে। পা চলছে না তার। খুব কষ্টে শরীরটা টেনে নিয়ে গেলো হাসপাতালের পানে।
গিয়ে দেখে তার বোন কান্না করছে। মা’য়ের মুখটা চাদর দিয়ে ঢাকা। দাঁড়ানো থেকে বসে পড়লো সে। আজ সামান্য দশ হাজার টাকার জন্য বাঁচাতে পারলো না তার মা’কে। নিজেকে খুব বেশি অসহায় মনে হচ্ছিলো তার।
চার বছর পর….
রাশেদ এখন বড় অফিসার। টাকা-পয়সার কমতি নেই। সব পেলেও সে দুনিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ- বাবা-মা’কে হারিয়ে ফেলেছে সে।
তানিয়াকে বিয়ে দেয়ার জন্য পাত্রের খোঁজ করছে রাশেদ। বোনকে পাত্রস্থ করার পর নিজে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। প্রতি মুহূর্তে মায়ের কথা মনে পড়ে তার।
একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ আছে রাশেদ। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। এর মাঝে হুট করেই মোবাইল বেজে উঠলো রাশেদের। রিসিভ করে অপর প্রান্তের কান্না বিজারিত কন্ঠ শুনে কিছু ঘাবড়ে যায় সে।
– রাশেদ আমি তোর চাচী বলছি। তোর চাচা স্ট্রোক করেছে। আমি মহিলা মানুষ ওনাকে নিয়ে এখন কোথায় যাবো! মাথা কাজ করছে না আমার। তুই একটু আসতে পারবি বাবা?
– আচ্ছা চাচী আমি এক্ষুণি আসছি বলে কল কেটে দেয় রাশেদ।
মিটিং রেখে দৌড়ে যায় চাচার বাসার উদ্দেশ্যে।
চাচী আর সে মিলে চাচাকে মেডিকেলে ভর্তি করায়। তারপর ঔষধ সহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে সব ঠিকঠাক করে তবেই হাসপাতাল ত্যাগ করে সে।
তার ব্যবহার দেখে কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি চলে আসে তার চাচীর। অপরদিকে, পূর্বে রাশেদের সাথে তার স্বামীর কৃত ব্যবহারের জন্য ক্ষমাও চায় সে।
রাশেদের মা মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে তাকে কিছু কথা বলে গিয়েছিল যা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করে।
তার মা বলেছিল, “আমি তোর উপর সম্পূর্ন সন্তুষ্ট বাবা। তুই আমার সুস্থতার জন্য সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করেছিস। আমি দোয়া করে যাচ্ছি। দেখবি তুই একদিন অনেক বড় হবি। আমি চাই তুই সৎ পথে উপার্জন কর। আমি চলে গেলে তানিয়ার খেয়াল রাখিস। একটা দ্বীনদার ছেলের সাথে বিয়ে দিস ও’কে।
যারা আমাদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে তাদের সাথে তুই কখনো খারাপ ব্যবহার করিস না। তারা আমাদের আপনজন। তারা মুখ ফিরিয়ে নিলেও আমরা তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবো না। সবসময় গুরুজনদের সম্মান করবি।”
মায়ের দোয়া কখনো বৃথা যায় না। রাশেদের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকালেই তা উপলব্ধি করা যায়।