Writing

লা তাহযান

সবরের পরিচয় ও প্রকার

আমরা অধিকাংশ মানুষ জানি না, সবর (ধৈর্য) কী জিনিস। অথচ সবর এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেটি মানুষকে দুনিয়া ও আখিরাতে সীমাহীন মর্যাদায় আসীন করে। আজ আমরা সবরের সংজ্ঞা ও প্রকারগুলো তুলে ধরবো, ইনশাআল্লাহ।

আরবি সবর (اَلصَّبْرُ) শব্দের অর্থ হলো: ধৈর্যধারণ করা, কষ্ট সহ্য করা, সহিষ্ণুতা অবলম্বন করা, সহনশীল হওয়া ইত্যাদি। পরিভাষায়, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সংযম অবলম্বন করা, প্রসন্ন বদনে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করাকে সবর বলা হয়।

সর্বোৎকৃষ্ট সবর হলো, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও নিকট নিজের দুঃখ-বেদনার অভিযোগ পেশ না করা। এটি অনেক উঁচু স্তরের ব্যাপার। তবে, যারা এই স্তরে অটল থাকতে পারে, তাদের মধ্যে আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল অত্যন্ত প্রবলভাবে বিরাজ করে, যা তাদের মানসিক শক্তিকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। বড় বড় বিপদ-আপদেও তারা ঘাবড়ে যায় না।

আলিমগণ সামগ্রিকভাবে সবরকে ৩ ভাগে ভাগ করেছেন।1

(১) الصبر على الطاعة (আল্লাহর আনুগত্যে সবর)

আল্লাহর আনুগত্যে অবিচল থাকা সহজ কোনো ব্যাপার নয়। শয়তান এবং নিজের নফস (প্রবৃত্তি)-এর সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়। কষ্ট সহ্য করে আল্লাহর আনুগত্যে অটল থাকা সবরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

(২) الصبر على المعاصي (গুনাহের কাজে সবর)

গুনাহের কাজগুলো খুব আকর্ষণীয় হয়ে থাকে। মন তো গুনাহ করার জন্য ফুঁসলায়, শয়তান সারাক্ষণ প্ররোচিত করে। কিন্তু আল্লাহর ভয়ে গুনাহ থেকে বিরত থাকতে হয়। গুনাহ থেকে বিরত থাকার জন্য মনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা, গুনাহমুক্ত জীবনযাপনের জন্য সাধনা করা এই প্রকার সবরের অন্তর্ভুক্ত।

(৩) الصبر على المصائب (বিপদ-মুসিবতে সবর)

বিপদ-মুসিবতে চিৎকার-চেঁচামেচি না করা, হতাশ না হওয়া, অশোভন কাজ থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি হলো এই প্রকার সবরের অন্তর্ভুক্ত। সাধারণভাবে সবর বলতে আমরা এই প্রকার সবরকেই বুঝে থাকি।

তাকদিরের উপর দৃঢ় বিশ্বাস যেভাবে মানুষকে স্বাচ্ছন্দ্যে রাখে

তাকদিরের উপর বিশ্বাস রাখলে জীবন সহজ হয়ে যায়; অনায়াসে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা যায়।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‘‘জমিনে এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যে এমন কোনো মুসিবত আপতিত হয় না, যা আমি সংঘটিত করার পূর্বে কিতাবে (তাকদিরের ফায়সালায়) লিখে রাখি না। নিশ্চয়ই এটি আল্লাহর জন্য খুবই সহজ—যাতে তোমরা সে বিষয়ে আফসোস না করো, যা তোমাদের থেকে হারিয়ে গেছে এবং তোমরা সে বিষয়ে উৎফুল্ল না হও, যা তিনি তোমাদের দিয়েছেন। আর আল্লাহ কোনো উদ্ধত ও অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না।”2

আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে তাঁর নবিকে বলেন,

“আপনি বলে দিন, আল্লাহ আমাদের জন্য যা লিখে রেখেছেন, তা ব্যতীত কোনো কিছুই আমাদের জন্য ঘটবে না।”3

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘জেনে রেখো, সমস্ত মানুষ জড়ো হয়ে যদি তোমার উপকার করতে চায়, কোনও উপকার করতে পারবে না, কেবল যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন (তা ব্যতীত)। আবার, তারা সকলে মিলে যদি তোমার ক্ষতি করতে চায়, তবে কোনও ক্ষতি করতে পারবে না, কেবল যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন (তা ব্যতীত)। কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে, কিতাব শুকিয়ে গেছে (সবকিছু নির্ধারিত হয়ে গেছে)।’’4

তাই, এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে, যা আমি পাইনি, তা আমার পাওয়ার ছিলো না আর যা আমি পেয়েছি তা আমার জন্যই নির্ধারিত ছিলো।
তাই বলে কি আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকবো আর তাকদিরের অপেক্ষায় থাকবো?

না, বরং আমরা আমাদের সাধ্যানুসারে উপায় অবলম্বন করবো, যেমনটি নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিসে আমাদের জানিয়েছেন। একবার এক ব্যক্তি নবিজিকে প্রশ্ন করেন,
“হে আল্লাহর রাসুল, আমি কি এটি (উট) বেঁধে এরপর (আল্লাহর উপর) ভরসা করবো নাকি এটির বাঁধন খুলে দিয়েই ভরসা করবো?” নবিজি উত্তরে বলেন, “তুমি এটি বাঁধো, এরপর (আল্লাহর উপর) ভরসা করো।”5

নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য এক হাদিসে বলেন,
“যা তোমার উপকার করবে, তা অর্জনে তুমি সচেষ্ট হও; আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও এবং অক্ষম হয়ে যেও না।”6

আল্লাহ কখনও মানুষকে নিঃস্ব-অসহায় করে দেন, তাকে শীঘ্রই উপরে উঠিয়ে নেওয়ার জন্য

নিয়ামতে ভরপুর শান্তি-সুখের জীবন উপহার দেওয়ার জন্য আল্লাহ কখনো মানুষকে সাময়িকভাবে নিঃস্ব-অসহায় করে দেন।

আইয়ুব আলাইহিস সালাম। আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও নবি। জীবনের কঠিন সময়ে আত্মীয়-স্বজন তাঁকে ছেড়ে চলে যায়, সমস্ত সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যায়। ভয়ানক রোগে আক্রান্ত হয়ে পুরোপুরি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যান। কেবল মমতাময়ী স্ত্রী ছিলেন তাঁর পাশে, যিনি অবিরত তাঁর সেবায় নিয়োজিত ছিলেন।

এমন করুণ অবস্থা সত্ত্বেও আল্লাহর নবি আইয়ুব (আ.) নিরাশ হননি। এমনকি জোরালোভাবে আল্লাহর কাছে অভিযোগও পেশ করেননি। কেবল নিজের অসহায়ত্বের বিষয়টি আল্লাহর কাছে এভাবে তুলে ধরেছেন—

أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنْتَ أَرْحَمُ الرّٰحِمِينَ
‘‘আমাকে দুঃখ-কষ্ট আঁকড়ে ধরেছে; আর আপনি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।’’7

আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম বান্দা আইয়ুবকে পরীক্ষা করে নিলেন। তাঁর দু‘আ কবুল করলেন। অতঃপর তাঁকে প্রচুর অর্থ-সম্পদ, আত্মীয়-স্বজন ও সুস্বাস্থ্য দিয়ে নিয়ামতে ভরপুর এমন জীবন দান করলেন, যা পূর্বের চেয়ে বহুগুণে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ ছিলো।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আইয়ুব (আ.)-এর প্রশংসায় বলেন,

‘‘কতই না উত্তম বান্দা সে!’’8
একই আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ‘‘আমি তাকে ‘ধৈর্যশীল’ পেয়েছি।’’

অতএব, পরিস্থিতি যেমনই হোক, সবর করতে হবে, আল্লাহর সিদ্ধান্ত ও তাকদিরে সন্তুষ্ট থাকতে হবে এবং তাঁর দিকেই ফিরে আসতে হবে। বিনিময়ে তিনি উত্তম বদলা দেবেন, যেভাবে আইয়ুব (আ.)-কে দিয়েছিলেন।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা:

আমরা সরাসরি বাক্যে কিছু চাওয়াকেই কেবল দোয়া মনে করি। যেমন: ‘‘হে আল্লাহ! আমাকে এই দাও, সেই দাও।’’ অথচ নবি-রাসুলগণ সবসময় সরাসরি বাক্যে চাইতেন না। তাঁরা কখনো কখনো নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করতেন এবং আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব, গুণাবলী ও পবিত্রতা ঘোষণা করতেন। এতেই দোয়া কবুল হতো। যেমন: আইয়ুব (আ.)-এর দোয়া—‘‘আমাকে দুঃখ-কষ্ট আঁকড়ে ধরেছে; আর আপনি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।’’9

এখানে কিন্তু সরাসরি কিছু চাওয়া হচ্ছে না। তেমনিভাবে, ইউনুস (আ.) মাছের পেটে গিয়ে বলেছিলেন—

لَا إِلٰهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحٰنَكَ إِنِّيْ كُنْتُ مِنَ الظّالِمِيْنَ
‘‘আপনি ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই; আপনি পবিত্র আর আমি তো জালিমদের অন্তর্ভুক্ত।’’10

এখানেও দেখুন—স্পষ্ট করে কিছু চাওয়া হচ্ছে না। সবসময় স্পষ্ট করে চাওয়ার দরকারই-বা-কী! মহান অন্তর্যামী আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তো আমাদের চাওয়াগুলো খুব ভালো করেই জানেন। তবে, দোয়ার ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো: নিজের অসহায়ত্ব ও অযোগ্যতা আল্লাহর কাছে পেশ করা, নিজের গুনাহ ও অপরাধ স্বীকার করা এবং আল্লাহর মহানত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, মর্যাদা, অমুখাপেক্ষীতা ইত্যাদির স্বীকৃতি দিয়ে এগুলোর উসিলা দেওয়া। নিজের নেক আমলের উসিলা দিয়েও দোয়া করা যায়।

ঈমানদারের জীবনে দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-মুসিবত এবং কঠিন পরীক্ষা

ঈমানদারের জীবনে দুঃখ-কষ্ট, বিপদ-মুসিবত এবং কঠিন পরীক্ষা থাকা খুব সাধারণ বিষয়। কষ্ট ও মুসিবতগুলো বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।

  • ঈমানদার ব্যক্তিকে মৃত্যু পর্যন্ত অবিরাম শয়তানের সাথে যুদ্ধ করে যেতে হয়। আল্লাহর আনুগত্যে অবিচল থাকা এবং তাঁর অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকার এই যুদ্ধে বিশ্রাম বলতে কিছু নেই। কারণ প্রতিপক্ষ (শয়তান) খুবই শক্তিশালী। একটু সময়ের জন্য অমনোযোগী পেলেই সে ধরাশায়ী করে ফেলে। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা সহজ কোনো বিষয় নয়। সবসময় সজাগ থাকতে হয়, নিজেকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
  • ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা বিভিন্ন বালা-মুসিবত, দুশ্চিন্তা-পেরেশানি ও দুঃখ-কষ্টের মাধ্যমে পরীক্ষায় ফেলেন।
  • কখনও বড় কোনো অসুস্থতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা আর্থিক সংকটের কবলে পড়ে অসহায়ত্ব বরণ করতে হয়।

এভাবে জীবনে একের পর এক বিপদ-মুসিবত আসতে থাকে। এই মুসিবত কখনও তার মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আসে, আবার কখনও গুনাহের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে আসে। উভয় অবস্থাই তার জন্য কল্যাণকর।

তবে, জীবনের এই সফরে সবরের উপর অটল থাকা জরুরি। হাদিসে এসেছে, সর্বনিম্ন জান্নাতি ব্যক্তিকেও আল্লাহ তা‘আলা এই দুনিয়ার ১০ গুণ বড় জান্নাত দেবেন11। অতএব, এই জান্নাতে যেতে হলে পরীক্ষার মধ্য দিয়েই নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। সেই পরীক্ষা কখনও হতে পারে দুশ্চিন্তা ও ভয়-আতঙ্কের মাধ্যমে; কখনও হতে পারে বিপদ-মুসিবতের মাধ্যমে; আবার কখনও সেই পরীক্ষা আসতে পারে বড় কোনো অসুস্থতা অথবা আর্থিক ক্ষয়-ক্ষতির মাধ্যমে। সর্বাবস্থায় সবরের উপর জমে থাকতে হবে। তাহলেই প্রতিদান নিশ্চিত, ইনশাআল্লাহ।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যাঁর হাতে আমার জীবন, তাঁর শপথ! একজন মুমিনের উপর যে কোনো ধরনের ক্লান্তি-ক্লেশ, রোগ-ব্যধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানি, এমনকি একটি কাঁটা বিঁধলেও এর মাধ্যমে আল্লাহ তার গুনাহের কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত) করেন।”12

আখিরাতের তুলনায় এই দুনিয়ার জীবনের দুঃখ-কষ্ট অথবা হাসি-আনন্দ কিছুই নয়। কোনোভাবেই দুটোর তুলনা চলে না। তাই, ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াবি কষ্টগুলোকে সবরের সাথে মেনে নেওয়ার মধ্যেই মুমিনের কল্যাণ নিহিত। মুমিনজীবনের সাথে দুঃখ-কষ্টকে সেঁটে দেওয়া হয়েছে।
প্রখ্যাত সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘উদ (রা.) সত্যই বলেছেন, ‘আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের আগ পর্যন্ত ঈমানদারের কোনো স্বস্তি নেই।’13

আল্লাহর কাছেই দুঃখ বেদনার কথা উপস্থাপন করা উচিত

দুঃখ-কষ্টের কথা শুধু আল্লাহর কাছেই বলা উচিত। এতে বেশ কিছু উপকারিতা আছে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“যে ব্যক্তি অভাব-অনটনে পড়ে তা মানুষের নিকট উপস্থাপন করে (অর্থাৎ মানুষের উপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে), তার অভাব-অনটন (পুরোপুরি) দূর হয় না। আর যে ব্যক্তি অভাব-অনটনে পড়ে তা আল্লাহর নিকট উপস্থাপন করে তবে অবশ্যই আল্লাহ তাকে দ্রুত অথবা বিলম্বে রিযিক দান করেন।”14

অন্য বর্ণনায় এসেছে, “…আল্লাহ তাকে অমুখাপেক্ষী করেন—শীঘ্রই মৃত্যুর মাধ্যমে অথবা শীঘ্রই ধন-সম্পদ দিয়ে।”15
বিখ্যাত আল্লাহওয়ালা বুযুর্গ শাকিক আল-বালখি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
‘যে ব্যক্তি কোনো দুঃখ-দুর্দশার ব্যাপারে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে অভিযোগ করে, সে ইবাদতের মিষ্টতা অনুভব করতে পারে না।’16

কেউ যখন শুধু আল্লাহর কাছেই নিজের সমস্যার কথা পেশ করে, তখন তার ঈমান বৃদ্ধি পায়, তাওয়াক্কুল মজবুত হয়। কারণ সে তখন একমাত্র আল্লাহর কাছেই সমাধান তালাশ করে, আল্লাহকেই আপন মনে করে।

দেখুন, নবি ইয়াকুব (আ.) কত কষ্টেই-না ছিলেন! প্রিয়তম সন্তান ইউসুফকে হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তবুও শুধু আল্লাহর কাছেই তাঁর দুঃখ-বেদনার অভিযোগ উপস্থাপন করেছেন। কুরআনে তাঁর অভিব্যক্তি এসেছে এভাবে—

إِنَّمَا أَشْكُو بَثِّي وَحُزْنِي إِلَى اللَّهِ
‘‘আমি কেবল আল্লাহর কাছেই আমার অস্থিরতা ও দুঃখ-কষ্টের ব্যাপারে অনুযোগ করছি।’’17

আল্লাহ তাঁর ভারাক্রান্ত হৃদয়ের আকুতি শুনেছেন। শীঘ্রই ইউসুফ (আ.)-কে সম্মানিত করে তাঁদের মধ্যে সাক্ষাৎ ঘটিয়েছেন।
বিপদে-মুসিবতে যখন কেউ মানুষের সাথে কিছু শেয়ার না করে শুধু আল্লাহর কাছেই চোখের পানি ফেলে, তখন আল্লাহ অত্যন্ত খুশি হন। পূর্ববর্তী নেককার ব্যক্তিদের একটি বৈশিষ্ট্য ছিলো যে, তাঁরা নিজেদের দুঃখ-বেদনা মানুষের কাছ থেকে ঢেকে রাখতেন আর আল্লাহর কাছে মুনাজাতে পেশ করতেন।

তবে, সমস্যার কথা শেয়ার করলে যদি সমাধানের সম্ভাবনা থাকে, তাহলে শেয়ার করতে সমস্যা নেই। নবিজি ও সাহাবিগণের জীবনে এমন অনেক ঘটনা আছে।

আল্লাহর কাছে সবই আছে

আমাদের যা যা দরকার তার সবকিছুই আল্লাহর কাছে আছে। আমাদের কাজ শুধু তাঁর কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া। সহিহ হাদিসে এসেছে, বান্দার খালি হাত ফিরিয়ে দিতে আল্লাহ লজ্জাবোধ করেন। সুতরাং চাওয়ার মত করে চাইতে হবে।
হঠাৎ করে চাকরিটা চলে গেছে। এতো ভালো জব সহজে মিলবে না। মনে হচ্ছে, পায়ের নীচে মাটি নাই। সকল আশা এবং স্বপ্নের সমাপ্তি।

উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে টাকা ইনভেস্ট করে প্রথমবারেই বিশাল লস খেয়ে ফেলেছেন। হতাশায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এবার আর আশার আলো দেখছেন না।
না ভাই, আল্লাহর সক্ষমতার ব্যাপারে আপনি কিছুই জানেন না। যেকোনো সময় বেটার (উত্তম) কোনো রিযিকের ব্যবস্থা করে আল্লাহ আপনার অন্তরকে প্রশান্ত করে দিতে পারেন। শুধু চাওয়ার মত করে তাঁর কাছে চেয়ে যান। আর এটাও মনে রাখুন—হতে পারে এগুলোতে আপনার কল্যাণ ছিলো না, যা মহাজ্ঞানী আল্লাহই শুধু জানেন। আপনার পঞ্চেন্দ্রিয় সেটা উপলব্ধি করতে সক্ষম নয় এবং অনাগত তাকদিরের ফায়সালাও আপনার জানা নেই।

ভালো একটি ছেলেকে/মেয়েকে বিয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সে আপনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি, অন্যত্র বিয়ে করে নিয়েছে। হতাশ হবেন না। আপনি জানেন না—কার সাথে বিয়ে হলে আপনি দুনিয়া এবং আখিরাতে উপকৃত হবেন। এটি জানেন কেবল সর্বজ্ঞানী মহান রাব্বুল আলামিন। সুতরাং আল্লাহর নিকট নির্দিষ্ট কোনো পাত্র/পাত্রীর জন্য দুআ না করে এভাবে দুআ করুন, ‘‘হে আল্লাহ! যে আমার জন্য দুনিয়াতে চোখের শীতলতা হবে এবং আখিরাতে কল্যাণ বয়ে আনবে, তাকে মিলিয়ে দিন।’’ এভাবে আল্লাহর উপর নিজের ভালোটা বাছাইয়ের কাজ ন্যস্ত করে দিন। নিজে কাউকে বাছাই করে তার জন্য দুআ করলেন; তাকে পেলেনও। কিন্তু বিয়ের পর আপনি হতাশও হতে পারেন। এমন অগণিত ঘটনার ফিরিস্তি চারপাশেই আছে।
সুতরাং সবকিছু আল্লাহর দিকে সমর্পণ করুন। মন-প্রাণ দিয়ে তাঁর কাছে দুআ করুন।

কেউ যখন আমাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের কাছে কোনো পরামর্শ চায়, তখন আমরা ঠিকই সর্বোত্তম পরামর্শটি দিই, সুতরাং যখন আমরা ভালোটা দেওয়ার জন্য আল্লাহকে বলবো এবং তাঁর কাছেই আমাদের ভালো-মন্দের সিদ্ধান্ত ন্যস্ত করে দেবো, তখন তিনি আমাদের হতাশ করবেন না। আল্লাহর উপর কোনোকিছু ছেড়ে দিলে সেটা আল্লাহই দেখভাল করেন।

পছন্দের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারেননি। একটুও হতাশ হবেন না, বরং যেখানেই থাকুন, নিজের যোগ্যতা অর্জন করুন। স্বপ্নের মতো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েও সবার জীবন সুন্দর হয় না। অনেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে নিজেকে পর্যন্ত শেষ করে দেয়। শুধু অ্যাকাডেমিক যোগ্যতা দিয়ে কেউ সম্মানিত হতে পারে না, সম্মান আসে একমাত্র আল্লাহর তরফ থেকে।

আপনার দরকার একটি সম্মানজনক হালাল রিযিক; সেটি আল্লাহ যেকোনো উসিলাতে মিলিয়ে দিতে পারেন। শুধু টাকা-পয়সার নাম রিযিক নয়, বরং সুস্থতা, পেরেশানি থেকে মুক্তি, পারিবারিক মিল-মহব্বত, অবসর, প্রশান্ত মন—এগুলো সবই রিযিকের অংশ।

নামাজে মনোযোগ আনতে পারছেন না, গিবত থেকে বাঁচতে পারছেন না, কুদৃষ্টির গুনাহ হয়েই যাচ্ছে, কুধারণা থেকে বিরত থাকতে পারছেন না—নফসের কাছে বারবার হেরে যাচ্ছেন; আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করুন। আন্তরিকভাবে দুআ করুন।

আল্লাহর কাছে কোনো নিয়ামত বা সুবিধা চাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক কল্যাণ কামনা করা উচিত। সহিহ বর্ণনায় এসেছে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বাধিক সময় যে দুআটি পড়তেন সেটি হলো—

اللَّهُمَّ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً، وَفِي الآخِرَةِ حَسَنَةً، وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
‘‘হে আল্লাহ, হে আমাদের রব, আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দান করুন, আখিরাতেও কল্যাণ দান করুন এবং জাহান্নামের আগুন থেকে আমাদের রক্ষা করুন।’’18

দুআটি কতো ব্যাপক অর্থবোধক খেয়াল করুন! মনে রাখবেন, বান্দার সকল চাওয়া এবং প্রচেষ্টা যেখানে শেষ, মহান রবের অনুগ্রহ সেখানে কেবল শুরু! বিশ্বাস ও ভালবাসার সাথে আল্লাহকে ডাকুন, তাঁর নৈকট্য অর্জনে লেগে থাকুন। হতাশ হবেন না। মনে রাখবেন, সকল ভান্ডারের মালিকানা শুধু তাঁরই হাতে। তাঁর ভান্ডারে কোনো সংকীর্ণতা নেই।

আল্লাহর উপর ভরসা করার সঠিক পদ্ধতি এবং এর গুরুত্ব

দুনিয়াতে সুখী মানুষ তারাই, যারা আল্লাহর সকল সিদ্ধান্তে (তাকদিরে) সন্তুষ্ট থাকে এবং সকল পরিস্থিতিতে আল্লাহর উপর ভরসা করে।
তাওয়াক্কুল (আল্লাহর উপর ভরসা করা) মানে এই নয় যে, কোনো কাজ না করে সবকিছু আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়া। বরং তাওয়াক্কুল হলো, উপকরণ সংগ্রহ করে সাধ্যানুযায়ী কাজ করে যাওয়া এবং সফলতার জন্য দুআ করা। বান্দার কাজ এটুকুই। বাকি কাজ আল্লাহই করে দেবেন, এই আশা রাখা।

বিশ্বাস রাখতে হবে, এই উপায়-উপকরণ বা কাজের মাধ্যমে কোনো সফলতা আসবে না, বরং আল্লাহই সফলতা দেওয়ার একমাত্র মালিক। আল্লাহ তাআলা চাইলে কোনো উপকরণ ছাড়াও সাহায্য করতে পারেন আবার উপকরণ দিয়েও সাহায্য করতে পারেন। যেমন: ইব্রাহিম (আ.)-কে তিনি কোন উপকরণ ছাড়াই আগুন থেকে মুক্তি দিয়েছেন আবার মুসা (আ.)-কে (তাঁর নির্দেশে) সামান্য লাঠির আঘাতে সমুদ্র/নদীতে রাস্তা তৈরির মাধ্যমে সাহায্য করেছেন। আল্লাহ তাআলা দুটোই করতে সক্ষম। তবে, সুন্নাহ বা ইসলামের নিয়ম হলো, বান্দা সাধ্যানুযায়ী উপকরণ সংগ্রহ করবে, অতঃপর আল্লাহর উপর নির্ভর করবে। এটিই হলো প্রকৃত তাওয়াক্কুল।

উমার (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘‘যদি তোমরা সঠিকভাবে আল্লাহর উপর ভরসা করতে, তবে তিনি অবশ্যই তোমাদেরকে পাখির মতো রিযিক দিতেন। ভোরবেলা পাখিরা খালিপেটে (বাসা থেকে) বের হয়ে যায় এবং সন্ধ্যাবেলা ভরা পেটে (বাসায়) ফিরে আসে।’’19

অনেকে উপরের হাদিস থেকে ভুল ধারণা নিয়ে বলেন যে, সঠিকভাবে তাওয়াক্কুল করলে উপকরণের প্রয়োজন নেই। অথচ দেখুন, পাখি শুধু তাওয়াক্কুল করে তার নীড়ে বসে থাকে না, বরং খাবারের খোঁজে বেড়িয়ে পড়ে।

হাফিয ইবনুল কাইয়িম (রাহ.) বলেন, তাওয়াক্কুলের রহস্য ও তাৎপর্য হলো, বান্দার অন্তর এক আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হওয়া, জাগতিক উপকরণের প্রতি অন্তর মোহশূন্য থাকা, সেগুলোর প্রতি আকৃষ্ট না হওয়া। (এই বিশ্বাস রাখা যে,) এসব উপায়-উপকরণের সরাসরি কোনো ক্ষতি কিংবা উপকার করার ক্ষমতা নেই।20

মারইয়াম (আ.) ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। আমরা ভালো করেই জানি, একজন অন্তঃসত্ত্বা নারী শারীরিক এবং মানসিকভাবে কত দুর্বল থাকেন। আবার আমরা এটাও জানি, খেজুর গাছের ভিত্তি পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম শক্ত ও মজবুত ভিত্তি। যত বড় তুফানই আসুক খেজুর গাছকে সমূলে উপড়াতে পারে না। মারইয়াম (আ.) ছিলেন আল্লাহর খুবই প্রিয় বান্দি। তিনি মসজিদে থাকতেন। তাঁর জন্য জান্নাতের খাবার পাঠানো হতো। এগুলো সব কুরআনেই আছে। তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হলো, ‘‘তুমি তোমার দিকে খেজুর গাছের কাণ্ড ধরে নাড়া দাও। এটি তোমার উপর পাকা খেজুর নিক্ষেপ করবে।’’21

এই ঘটনা থেকে আমাদের অন্যতম শিক্ষা হলো, আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলে এমনিতেই খেজুর নিক্ষেপ করতে পারতেন। তবুও তিনি মারইয়ামকে একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতির মধ্য দিয়ে রিযিক পৌঁছিয়েছেন। অথচ তিনি ছিলেন তখন শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল। এজন্য মনে রাখতে হবে যে, উপকরণ খুব তুচ্ছ হতে পারে, তবুও সেটি নিয়েই তাওয়াক্কুল করতে হবে। যেমনটি করেছিলেন মুসা (আ.), মারইয়াম (আ.) এবং অন্যরা।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন, ‘‘আর যে আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার জন্য (সমস্যা থেকে) বের হওয়ার পথ করে দেবেন এবং তাকে এমন উৎস থেকে রিযিক দেবেন, যা সে ধারণাও করে না। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ তার কাজ পূর্ণ করবেন। আল্লাহ সবকিছুর জন্যে একটি পরিমাণ স্থির করে রেখেছেন।’’22

আমাদের জীবনে যদি বিপদ-আপদ না আসতো..

অনেক সময় বিপদ-মুসিবত ও দুঃখ-বেদনা দলবেধে আসতে থাকে। দুচোখে শুধু অন্ধকার দেখা যায়। এভাবে আল্লাহ কখনও কখনও সব পথ বন্ধ করে দেন। তখন কেবল তাঁর দিকে ফেরার পথটা খোলা থাকে৷ আল্লাহ চান, বান্দা যেন সেই সময়গুলোতে তাঁর দিকেই ফিরে আসে। এই সময়গুলোকে যারা লুফে নিতে পারে, তাদের জন্য বিপদগুলো আর বিপদ থাকে না, নিয়ামতে পরিণত হয়।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন,
‘‘অতঃপর যখন তাদের কাছে আমার (পক্ষ হতে) শাস্তি আপতিত হলো, তখন তারা কেন বিনীত হলো না?’’23

ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
‘দুনিয়ার দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ যদি না থাকতো, তবে বান্দাকে অহংকার, গর্ব ও হৃদয়ের কাঠিন্য এমনভাবে পেয়ে বসতো যে, এগুলো তার দুনিয়া ও আখিরাতের পতনের কারণ হয়ে যেতো।’24

একজন জ্ঞানী ব্যক্তি বলেছিলেন—
‘যাদের হৃদয় ভেঙ্গে যায়, তাদের সাথে আল্লাহ থাকেন। আপনার হৃদয় ভেঙ্গে যাওয়া একটি ভালো ব্যাপার। কেননা ভেঙ্গে যাওয়া হৃদয়টি নিজের মাঝে আল্লাহর আলো প্রবেশের পথ প্রশস্ত করে দেয়। দুনিয়া তো সাজানোই হয়েছে এমন করে, যা আপনার হৃদয়কে ভাঙবে; চুরমার করে দেবে।’

তাই, সবরের মালা গলায় পড়ে নিতে হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের আর্তনাদ শুনছেন। তিনি গর্তের পিপীলিকা থেকে নিয়ে গভীর সমুদ্রের প্রাণিদের আওয়াজও শুনেন। আমাদের প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসের জন্যই বিনিময় অবধারিত।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“যাঁর হাতে আমার জীবন, তাঁর শপথ! একজন মুমিনের উপর যে কোনো ধরনের ক্লান্তি-ক্লেশ, রোগ-ব্যধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানি, এমনকি একটি কাঁটা বিঁধলেও এর মাধ্যমে আল্লাহ তার গুনাহের কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত) করেন।”25

তাই, আসুন আল্লাহকে আপন করে নিই। তাঁর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকি। দুঃখ-কষ্টে তাঁর দরবারেই হাত তুলি। তিনি বান্দাকে শূন্য হাতে ফেরান না। আমাদের সুখ-দুঃখের অনুভূতিগুলো তাঁর অজানা নয়। ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) খুব সুন্দর বলেছেন, ‘যারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখে, তাদের জন্য কষ্টকর সকল কাজই সহজ হয়ে যায়, যখন তারা জানে যে, আল্লাহ তাদেরকে শুনছেন।’26

বিপদের মাধ্যমে আল্লাহ গুনাহ মাফ করেন

দুনিয়ার বিপদ-আপদ আখিরাতের জন্য কামাইস্বরূপ। আল্লাহ কখনও তাঁর প্রিয় বান্দাকে দুনিয়াতে শাস্তি দিয়ে দেন, যাতে আখিরাতে তার শাস্তি মওকুফ করতে পারেন।

আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যখন আল্লাহ তাঁর বান্দার কল্যাণ চান, তখন তিনি তাকে দ্রুত দুনিয়াতে শাস্তি দিয়ে দেন। আর, যখন আল্লাহ তাঁর বান্দার অকল্যাণ চান, তখন তিনি তাকে (শাস্তিদানে) বিরত থাকেন। পরিশেষে কিয়ামতের দিন তাকে পুরোপুরি শাস্তি দেবেন।’’27
সুতরাং, বিপদ-আপদ আসলে কখনই বলা যাবে না, ‘সবসময় শুধু আমিই কেন?’

কারণ হতে পারে আপনার এমন কোনো কাজ আছে, যেটি আল্লাহ খুব পছন্দ করেছেন। তাই, তিনি চান আপনি আখিরাতে নিরাপদ থাকুন। সেজন্য দুনিয়াতেই আপনাকে দুঃখ-কষ্ট, মুসিবত, অসুস্থতা ইত্যাদির মাধ্যমে ঝালিয়ে নেন, গুনাহ মাফ করিয়ে নেন। ফলে আপনার আখিরাত হবে ভয়হীন, স্বস্তির; ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ দেখতে চান, বান্দা বিপদে কেমন আচরণ করে, কীভাবে বিপদকে মোকাবেলা করে। সে কি আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকে নাকি বেসামাল হয়ে পড়ে।

সবার ক্ষেত্রে আল্লাহ একই নীতি অবলম্বন করেন না। তিনি তাঁর একচ্ছত্র ক্ষমতাবলে কাউকে সরাসরি ক্ষমা করে দেন। কাউকে অসুস্থতার মাধ্যমে, কাউকে মুসিবতের মাধ্যমে আবার কাউকে বিশেষ নেক আমলের উসিলায় ক্ষমা করে দেন। সুতরাং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং কষ্ট-বেদনা—সর্বদা আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখুন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“হে আবু বকর, আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন; তুমি কি অসুস্থ হও না? তুমি কি কষ্ট পাও না? তুমি কি দুঃখ-দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হও না? মুসিবত তোমাকে কি পিষ্ট করে না?’’ আবু বকর বলেন, ‘অবশ্যই।’ তখন নবিজি বললেন, ‘‘এগুলো তোমাদের (গুনাহের) প্রায়শ্চিত্ত।”28

মুসলিম উম্মাহর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ আবু বকর (রা.)-ও দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-আপদ থেকে মুক্ত ছিলেন না, সুবহানাল্লাহ।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘‘মুমিন নারী-পুরুষের নিজ জীবনে, তাদের সন্তানাদির জীবনে ও মাল-সম্পদে সর্বদা বিপদাপদ লেগেই থাকে। অতঃপর সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করে এমন অবস্থায় যে, তার কোনো পাপই থাকে না।’’29

তাই, বিপদ-মুসিবতে আমরা যেন হতাশ না হয়ে যাই। বরং আমরা সবর করবো এবং মহামহিম আল্লাহর কাছে বিনিময় প্রত্যাশা করবো।

দুনিয়ার প্রকৃত বাস্তবতা

দুনিয়ার নিয়মটাই এমন যে, এটি আপনাকে ভেঙে চুরমার করে দেবে, দুঃখ-দুশ্চিন্তার অথৈ সাগরে একাকি ছেড়ে দেবে। এই জগতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য যেমন স্থায়ী হয় না, তেমনি দুশ্চিন্তা-ঝামেলাও চিরদিন থাকে না।

একবার সুলতান মাহমুদ গজনবি তার এক গোলামকে একটি আংটি দিয়ে বললেন,
‘আংটিতে এমন কিছু খোদাই করে আনো, যা পড়লে আনন্দের সময় আমার কষ্ট হবে আর কষ্টের সময় আনন্দ হবে।’ সেই গোলাম আংটিতে একটি বাক্য খোদাই করে এনেছিলো। বাক্যটি ছিলো—
এই সময় শীঘ্রই কেটে যাবে!

অর্থাৎ, আনন্দের সময় সুলতান যখন এই কথাটিতে নজর পড়বে, তখন তিনি সেই আনন্দকে চিরস্থায়ী ভেবে উদ্বেলিত হবেন না। আবার কষ্টের সময় যখন পড়া হবে, তখন এই ভেবে স্বস্তি পাওয়া যাবে যে, এই সময়টি শীঘ্রই কেটে যাবে!
আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন,

‘‘নিশ্চয়ই কষ্টের সাথেই আছে স্বস্তি।’’30

প্রখ্যাত তাবি তাবিয়ি সুফিয়ান আস সাওরি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যাকে দুনিয়াবি কিছু দেওয়া হয়, তাকে এ কথাও বলে দেওয়া হয় যে, অনুরূপ দুঃখও গ্রহণ করো।’ (অর্থাৎ, অনুরূপ দুঃখের জন্যও প্রস্তুত থেকো।)31

শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু সালিহ আল উসায়মিন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এই দুনিয়ার জীবনে কোনও মানুষের পক্ষে সর্বদা আনন্দে থাকা সম্ভব নয়। তার একটি দিন যদি যায় প্রফুল্লতায়, তো আরেকটি দিন যাবে দুশ্চিন্তায় (এটাই স্বাভাবিক)।’32

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,

‘‘এই পার্থিব জীবন তো (অস্থায়ী) ভোগের সামগ্রী মাত্র। আর জেনে রেখো! আখিরাতই হলো চিরস্থায়ী আবাস।’’33

  1. ইমাম ইবনু কাসির, তাফসিরুল কুরআনিল আযিম: ১/২৫৮ ↩︎
  2. সুরা হাদিদ, আয়াত: ২২-২৩ ↩︎
  3. সুরা তাওবাহ, আয়াত: ৫১ ↩︎
  4. ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান: ২৫১৬; হাদিসটি সহিহ ↩︎
  5. ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান: ২৫১৭; হাদিসটি হাসান ↩︎
  6. ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৬৬৬৭ ↩︎
  7. সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৮৩ ↩︎
  8. সুরা সোয়াদ, আয়াত: ৪৪ ↩︎
  9. সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৮৩ ↩︎
  10. সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৮৭ ↩︎
  11. ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৬৫৭১ ↩︎
  12. ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৫৬৪১ ও ৫৬৪২ ↩︎
  13. ইমাম ওয়াকি, কিতাবুয যুহদ, পৃষ্ঠা: ৮৬ ↩︎
  14. ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান: ২৩২৬; হাদিসটি সহিহ ↩︎
  15. ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৬৪৫; শায়খ আলবানি, সিলসিলা সহিহাহ: ২৭৮৭; হাদিসটি সহিহ ↩︎
  16. আস সিয়ার: ৯/৩১৫ ↩︎
  17. সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৮৬ ↩︎
  18. ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৬৩৮৯ ↩︎
  19. ইমাম ইবনু মাজাহ, আস-সুনান: ৪১৬৪; হাদিসটি সহিহ ↩︎
  20. আল ফাওয়াইদ, পৃষ্ঠা: ৮৭ ↩︎
  21. সুরা মারইয়াম, আয়াত: ২৫ ↩︎
  22. সুরা ত্বলাক্ব, আয়াত: ২-৩ ↩︎
  23. সুরা আন‘আম, আয়াত: ৪৩ ↩︎
  24. আত-তিব্বুন নাবাবি: পৃষ্ঠা ১৯১ ↩︎
  25. ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৫৬৪১ ও ৫৬৪২ ↩︎
  26. আল-ফাওয়াইদ, পৃষ্ঠা: ১১৯ ↩︎
  27. ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান: ২৩৯৬; হাদিসটি সহিহ ↩︎
  28. ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ: ৭০; হাদিসটি সহিহ ↩︎
  29. ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান: ২৩৯৯; হাদিসটি সহিহ ↩︎
  30. সুরা ইনশিরাহ ↩︎
  31. ইমাম আবু নু‘আইম, হিলয়াতুল আউলিয়া: ৭/২১ ↩︎
  32. শারহু রিয়াদিস সালিহিন: ১/২৪৩ ↩︎
  33. সুরা গাফির, আয়াত: ৩৯ ↩︎

লিখেছেন

Picture of নুসুস টিম

নুসুস টিম

কুরআন ও হাদিসের মূল পাঠকে নুসুস (text) বলা হয়। নুসুসের উপর ভিত্তি করেই আমরা লেখালেখি করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন
Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button