আমি চাই আপনি নিজেকে একবার আপনার কর্মের অভিভাবক হিসেবে চিন্তা করুন। আপনি আপনার কর্মের জনক, আপনি তাদের প্রতিপালন করেন, এদের নিয়ে আপনার অনেক প্রত্যাশা। কিন্তু ব্যাপারটা হল এখন পর্যন্ত আপনি তাদের দেখতে পাননি।
ঠিক যেমন বাবা-মা প্রত্যাশা করেন বৃদ্ধ বয়সে তাদের পার্থিব সন্তানরা তাদের সান্ত্বনা দেবে, যত্ন নিবে, ঠিক তেমনি আপনিও প্রত্যাশা করেন জীবনের ক্রান্তিলগ্নে আপনার পরকালের সন্তানেরাও আপনার যত্ন নিবে, এবং আপনার উপকারে আসবে। কিন্তু প্রশ্ন হল আপনি কি আমল করেছেন?
কত বেশি নেক আমল আপনি প্রতিপালন করেছেন?
এবং প্রথমবারের মতো তাদের সাথে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা আপনার কেমন হবে?
হাতেম ইবনেল আসম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আমি মানবজাতির দিকে তাকিয়ে যে বিষয়টি লক্ষ্য করেছি তা হল প্রত্যেকের জীবনেই এমন কিছু বা কেউ থাকে যাকে সে ভালবাসে। অতঃপর সে মারা গেলে, সেই প্রিয় ব্যক্তি বা জিনিসটি তাকে ছেড়ে চলে যায়। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আমার আমার ভালো কাজগুলোকে ভালোবাসতে শিখবো যাতে আমি কবরে প্রবেশ করলে তারা আমার সঙ্গী হতে পারে।’
রাসুল (সাঃ) বলেন, يتْبعُ الميْتَ ثلاثَةٌ – কবরে মৃত ব্যক্তির সাথে তিনটি জিনিস অনুসরণ করে। اأهلُهُ ومالُه وعمَلُه তার পরিবার, তার সম্পদ এবং তার আমল। فيرْجِع اثنانِ ويبْقَى واحِدٌ: يرجعُ أهلُهُ ومالُهُ، ويبقَى عملُهُ – তার পরিবার এবং তার সম্পদ কবর থেকে ফিরে আসে এবং তারা ঘরে চলে যায়, এবং তার একমাত্র সঙ্গী যে তার সাথে তার নতুন বাড়িতে এখন থেকে থাকবে তা হল তার পুঞ্জিভূত আমলগুলো।
আমরা জানি যে আল্লাহ সুবহানা তা’লা কেয়ামতের দিন সম্পর্কে বলেছেন –
يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ সেদিন ধন-সম্পত্তি, সন্তান-সন্ততি কোন উপকারে আসবেনা। [২৬:৮৮]
এই পর্যায়ে এসে আপনার নেক আমলগুলোই আপনার সান্ত্বনা এবং আপনার সম্পত্তি হয়ে উঠবে। একদিন রাসূল (ﷺ) তাঁর সাহাবীদের বলেছিলেন তোমরা কি জানো এ আয়াতের দ্বারা আল্লাহ কি বুঝিয়েছেন?
وَمَنْ أَعْرَضَ عَن ذِكْرِى فَإِنَّ لَهُۥ مَعِيشَةً ضَنكًا وَنَحْشُرُهُۥ يَوْمَ ٱلْقِيَٰمَةِ أَعْمَىٰ আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন এবং আমি তাকে কিয়ামত দিবসে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়। [২০:১২৪]
সমস্ত কবর জুড়ে সেই সংকীর্ণতা বিরাজ করবে। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘কবরে আল্লাহ কাফের ব্যক্তির জন্য ৯৯ টি সাপ নিযুক্ত করেন, প্রতিটি সাপ আবার সাতমাথা বিশিষ্ট ৭০ টি সাপের রূপ নেয়। কেয়ামত পর্যন্ত সাপগুলো তাকে দংশন করতে থাকে।'[সহীহ ইবনে হিব্বান ৩১২২] আল্লাহ আপনি আমাদের রক্ষা করুন।
এই মুহুর্তে আপনার পরকালের সন্তানরা আপনার সাহায্যে প্রথমবারের মতো এগিয়ে আসবে, ফেরেশতারা আসার আগেই। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, যখন মুমিনকে তাদের কবরে রাখা হয় এবং সে যখন তার পরিবারের সদস্যদের চলে যাওয়ার চূড়ান্ত পদধ্বনি শুনতে পায়, তখনই আজাব আসতে শুরু করে।
উপর থেকে যখন আজাব আসে তার নামাজ উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে বলে, ‘তুমি আমাকে অতিক্রম করে যেতে পারবে না।‘ এভাবে নামাজ তার মাথাকে হেফাজত করে, এবং তারপরে তার ডান দিক থেকে শাস্তি আসে এবং রাসূল (ﷺ) বলেন, তার সিয়াম তখন দাঁড়িয়ে পাহারা দেয় এবং ‘বলে তুমি আমাকে অতিক্রম করে যেতে পারবে না।’ তারপর তার বাম দিকে তার যাকাত দাঁড়িয়ে থাকে এবং বলে, ‘তুমি আমাকে অতিক্রম করে যেতে পারবেনা।’ তারপর তার পায়ের কাছে তার সাদাকা এবং সিলা – তার পরিবার তার সম্প্রদায়ের প্রতি তার ভালো কাজ, তার স্বেচ্ছা দান, তার সত্যতা, তার সততা এই সমস্ত জিনিসগুলো দাঁড়িয়ে যায়। এগুলো নিচ থেকে পাহারা দিয়ে বলে, ‘তুমি আমাকে অতিক্রম করে যেতে পারবে না।’
তারপর তাকে বসতে বলা হয় এবং সে উঠে বসে। রাসূল (ﷺ) বলেন,
‘সূর্যকে তার কাছে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন অস্ত যাচ্ছে – প্রায় মাগরিবের নামাজের সময় হতে চলেছে। তাহলে মুমিন কিসে অভ্যস্ত? একজন মুমিন নামাজে অভ্যস্ত। আপনি যদি মুমিন হয়ে থাকেন, এই অস্বাভাবিক সময়ে ঘুম থেকে উঠে বিভ্রান্ত হয়ে প্রথম যে বিষয়টি নিয়ে আপনি উদ্বিগ্ন হবেন তা হল – আমি কি নামাজ পড়েছি?
তাই মুমিন ব্যক্তি তখন বলবেন, ‘আমাকে নামাজ পড়তে দিন।’ ফেরেশতারা তখন বলবেন, ‘ঠিক আছে নামাজ পড়বেন, তার আগে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিন।’
আপনাকে জিজ্ঞেস করা হবে مَن رَبُّكَ؟ – তোমার প্রভু কে?
وما دِينُكَ؟ – এবং তোমার ধর্ম কি?
ومَن نَبيُّكَ؟- এবং তোমার নবী কে?
‘আপনার প্রভু কে?’- এ প্রশ্নের উত্তর দিতে আপনি কেবলমাত্র তখনই সক্ষম হবেন যদি আপনি তাঁর উপাসনা করে থাকেন, ‘আপনার ধর্ম কি?’ – এ প্রশ্নের উত্তর আপনি কেবল তখনই দিতে পারবেন যদি আপনি আপনার ধর্ম পালন করে থাকেন, ‘আপনার নবী কে?’ – এই প্রশ্নের উত্তর আপনি দিতে পারবেন যদি আপনি আপনার নবীকে (ﷺ) অনুসরণ করে থাকেন।
তখন জান্নাত থেকে একটি কণ্ঠস্বর উচ্চস্বরে বলে উঠবে – ‘আমার বান্দা সত্য কথা বলেছে।’ সুবহানাল্লাহ!
হাদিসে এসেছে রাসূল (ﷺ) বলেছেন,
‘সেই দুই ফেরেশতা যারা প্রথমে ভয় দেখাচ্ছিল তারা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়ার পরে আপনাকে বলবে –
‘আমরা জানতাম আপনি এটাই বলবেন, আমরা জানতাম আপনি এই প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর দিবেন।’
আল্লাহ সুবহানা তা’য়ালা তখন বলেন,
‘তার জন্য জান্নাতের গৃহসজ্জার সামগ্রী সরবরাহ করুন, তাকে জান্নাতের পোশাক পরিয়ে দিন, তার জন্য জান্নাতের একটি দরজা খুলে দিন যাতে তার কবরে জান্নাতের কিছু সুগন্ধ আসে, এবং যতদূর চোখ যায় তাঁর কবরকে প্রশস্ত করে দিন।’
সেই সময় আপনি জান্নাতের কাপড়ে সুসজ্জিত, খিরকি দিয়ে আপনি জান্নাত দেখতে পাচ্ছেন। আপনার কাছে সবকিছু জান্নাতের মতোই মনে হচ্ছে। এই সময় একজন দর্শনার্থী আপনার কাছে আসবেন – যার মুখশ্রী খুব সুন্দর, যিনি সুন্দর পোশাকে সুসজ্জিত, যার গা থেকে ভেসে আসছে মনোরম সুবাস। দর্শনার্থী তখন বলবেন,
‘আমি আপনাকে এখন এমন একটি সুসংবাদ দিব যা শুনলে আপনি আনন্দিত হবেন, আজ তো আপনারই দিন – যে দিনের জন্য আপনি প্রতিশ্রুত।’ মৃত ব্যক্তি তখন বলেন,
‘আপনি কে? আপনার চেহারাই বলে দিচ্ছে আপনি সুসংবাদ দিতে যাচ্ছেন।’
দর্শনার্থী তখন বলেন,
‘আমি আপনার নেক আমল।’
সুবহানাল্লাহ! কল্পনা করুন আপনার সব নেক আমলগুলোর সমাবেশ এক ব্যক্তির মধ্যে – কেমন দেখাবে?
বি ইজনিল্লাহি তা’লা আপনি যদি প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর দেওয়া সেই নির্দেশনার উপর আমল করে থাকেন, তাহলে আপনার কুরআন, আপনার নামাজ, আপনার রোজা, আপনার দান-খয়রাত সব কিছুর সমাবেশ যখন এক ব্যক্তির মধ্যেই দেখতে পাবেন তখন আপনার কেমন লাগবে?
কেমন অনুভূতি হবে আপনার যখন দর্শনার্থী এসে বলবেন, ‘আমি আপনার নেক আমল, এবং আমি আপনাকে সুসংবাদ দিতে এসেছি?’
প্রথমে আপনার ভাল কাজ আপনাকে শাস্তি থেকে রক্ষা করেছে, তারা আপনার চারপাশে প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়েছে, আর এখন তারা আপনার জন্য সুসংবাদ নিয়ে এসেছে। এখন থেকে আপনার নেক আমলগুলোকে ব্যক্তিত্বে রূপ দেওয়া হবে এবং তারা আপনার উপকারের সবচেয়ে বড় উৎস হতে চলেছে এবং তারা আপনার জীবনের সবচেয়ে ভালো সঙ্গী হতে চলেছে।
কবরের আজাব থেকে সুস্পষ্টভাবে সুরক্ষিত ব্যক্তিদের অনেক বর্ণনা এসেছে, যেমন – যারা শহীদ, যারা পেটের রোগে মারা যায়, অথবা যারা শুক্রবারের দিন বা রাতে মারা যায়। এছাড়া ঐ সব ব্যক্তির বর্ণনাও আছে যারা বিশেষভাবে তাদের পাপের কারণে শাস্তি পাবে। সুতরাং আপনি অবশ্যই চাইবেন পাপগুলি এড়িয়ে চলতে – যেমন যারা পরনিন্দায় লিপ্ত, যারা তাহারা অর্থাৎ পবিত্রতাকে এড়িয়ে চলে, যারা ব্যভিচার করে এবং সুদের কারবারে লিপ্ত থাকে।
যাই হোক না কেন, আপনি এখন যে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাবেন, তাই শেষ বিচারের দিনে নেতৃত্ব দিবে। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, মৃত্যুর পর একজন ব্যক্তিকে সকাল-সন্ধ্যা তার চূড়ান্ত গন্তব্য স্থল দেখানো হয়। কাজেই সে যদি জান্নাতের অধিবাসী হয়, এবং জান্নাতের খিরকি পেয়ে থাকে, তবে তাকে প্রতিনিয়ত বলা হবে এটাই তার গন্তব্য স্থল – সে এখানেই যাবে। আর সে যদি আগুনের অধিবাসী হয় (হে আল্লাহ, আপনি আমাদের রক্ষা করুন) তবে তাকে আগুনের আবাস দেখানো হবে, এবং বলা হবে এটাই তার গন্তব্য স্থল।
পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, মৃতকে আরো একটি জায়গা দেখানো হবে, এবং বলা হবে শেষ বিচারের দিন তাকে সেখানেই পাঠানো হবে। সুতরাং মুমিনদের জন্য তার নেক আমল সেদিন তার সঙ্গী হবে। সে তখন জান্নাতের খিরকি পেয়েছে, জান্নাতের সুন্দর কাপড়ে সুসজ্জিত হয়েছে। মুমিন ব্যক্তি কেয়ামতের দিনে তার স্থান দেখতে পেয়ে কিন্তু পালিয়ে যাবেনা।
সে বলবে,
‘হে আমার প্রভূ, সেই সময়কে প্রতিষ্ঠিত করুন, হে আমার প্রভূ, সেই সময়কে প্রতিষ্ঠিত করুন, হে আমার প্রভূ, সেই সময়কে প্রতিষ্ঠিত করুন!’
কবরের অন্ধকারে
শেষ বিচারের দিন
মূল : ড. ওমর সুলাইমান