খাবার খাওয়া বা পানাহারের ও পানি পান করার ২৯ টি আদব বা সুন্নাত এবং খাওয়ার আগে ও পরের প্রয়োজনীয় দোয়া সহ নিচে দেয়া হলোঃ
খাবার খাওয়া বা পানাহারের আদব সমূহঃ
(১) উভয় হাত কব্জি পর্যন্ত ধোয়া।
আবু দাউদ ৩৭৬১
(২) দস্তরখানা বিছিয়ে খাবার খাওয়া।
বুখারী ৫৩৮৬
(৩) খাবার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলাঃ
হুযাইফা রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, শয়তান ঐ খাবারকে নিজের জন্য হালাল মনে করে যার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা হয় নি।
[ মুসলিম : ৩৭৬১]
«بِسْمِ اللَّهِ»
(বিসমিল্লাহ) “আল্লাহর নামে।”
(৪) খাবার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে গেলে নিচের দোয়া পড়া,
بسمِ اللَّهِ فِي أَوَّلِهِ وَآخِرِهِ
(বিস্মিল্লাহি ফী আওওয়ালিহী ওয়া আখিরিহী)।
“এর শুরু ও শেষ আল্লাহ্র নামে।”
[ আবূ দাঊদ ৩/৩৪৭, নং ৩৭৬৭; তিরমিযী, ৪/২৮৮, নং ১৮৫৮।
(৫) যাকে আল্লাহ কোনো খাবার খাওয়ায় সে যেন বলে,
« اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِيهِ وَأَطْعِمْنَا خَيْراً مِنْهُ».
(আল্লা-হুম্মা বারিক লানা ফীহি ওয়া আত‘ইমনা খাইরাম-মিনহু)।
“হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে এই খাদ্যে বরকত দিন এবং এর চেয়েও উত্তম খাদ্য আহার করান।”
(৬) আল্লাহ্ কাউকে দুধ পান করালে সে যেন বলে:
«اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِيهِ وَزِدْنَا مِنْهُ».
(আল্লা-হুম্মা বারিক লানা ফীহি ওয়াযিদনা মিনহু)।
“হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে এই খাদ্যে বরকত দিন এবং আমাদেরকে তা থেকে আরও বেশি দিন।”
তিরমিযী ৫/৫০৬, নং ৩৪৫৫। আরও দেখুন, সহীহুত তিরমিযী, ৩/১৫৮।
(৭) কেউ কিছু পান করালে বা খাওয়ালে তার জন্য দুআঃ
اللَّهُمَّ أَطْعِمْ مَنْ أَطْعَمَني وَاسْقِ مَنْ سَقَاني
উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা আত্বইম মান আত্বআমানী অসকি মান সাক্বা-নী।।
অর্থ – হে আল্লাহ! তাকে তুমি খাওয়াও, যে আমাকে খাওয়াল এবং তাকে পান। করাও, যে আমাকে পান করাল।
(মুঃ ৩ ১২৬)
(৮) ডান হাত দিয়ে খাওয়া।
(বুখারী ৫৩৭৬)
আমর বিন আবু সালামা থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন:হে বৎস! বিসমিল্লাহ বল এবং ডান হাত দিয়ে খাও। আর খাবার পাত্রের যে অংশ তোমার সাথে লাগানো সে অংশ থেকে খাও।
[বোখারি : ৪৯৫৮]
(৯) খাদ্য এক ধরনের হলে নিজের সম্মুখ হতে খাওয়া।
(বুখারী ৫৩৭৬)
বান্দা খাবার পাত্রের যেদিক তার সাথে লাগানো সেদিক থেকে খাবে। উপরে বর্ণিত উমর বিন আবু সালামা রা.-এর হাদীসের কারণে। আর খাবার যদি বিভিন্ন ধরনের হয় তা হলে অন্যদিক -যা তার সাথে লাগোয়া নয়- থেকে খাওয়াতে কোন দোষ নেই।
(১০) খানার মজলিসে বয়সের দিক দিয়ে যিনি বড় এবং বয়স্ক, তাঁর দ্বারা খানা শুরু করানো।
(মুসলিম ২০১৭)
যখন অনেক লোকের সাথে বসে পান করবে আর পান করার পর কাউকে দিতে চাইবে তাহলে ডান পাশ্বে বসা ব্যক্তিকে দিবে, সে যদি বয়সে ছোট হয় আর বাম পার্শ্বস্থজন তার থেকে বড়, তবুও। হ্যাঁ; যদি ছোট থেকে অনুমতি নিয়ে বড়কে দেওয়া হয় তাহলে কোন দোষ নেই। আর যদি অনুমতি না দেয় তাহলে তাকেই দিবে কারণ সেই আগে পাওয়ার বেশি অধিকার রাখে।
এর প্রমাণ হল সাহাবী সাহল বিন সা’দ রা.-এর হাদীস :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট কিছু পানীয় আনা হল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পান করলেন। রাসূলের ডান দিকে একটি ছোট ছেলে বসা ছিল এবং বামদিকে বয়স্ক লোক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছেলেটিকে বললেন―তুমি কি আমাকে তোমার আগে তাদেরকে দেয়ার অনুমতি দিবে ? তখন ছেলেটি বলল, না, কখনও নয়। আল্লাহ শপথ! আমি আমার অংশের উপর আপনি ব্যতীত অন্য কাউকে প্রাধান্য দেব না। বর্ণনাকারী বলেন―রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (পানপাত্র) ছেলেটির হাতে দিয়ে দিলেন।
[ বোখারি : ২৪১৫]
(১১) খাদ্যের কোন অংশ পড়ে গেলে উঠিয়ে (প্রয়োজনে পরিষ্কার করে) খাওয়া।
(মুসলিম ২০৩৩)
যদি খাবারের কোন লোকমা পড়ে যায় তবে উঠিয়ে খাবে, যদি ময়লা লাগে ধুয়ে ময়লা মুক্ত করে খাবে। কারণ এটিই সুন্নত এবং এর মাধ্যমেই রাসূলুল্লাহর নির্দেশের অনুসরণ করা হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :-
অর্থাৎ, যদি তোমাদের কারো খাবারের লোকমা পড়ে যায় তবে তার থেকে ময়লা দুর করবে এবং তা খেয়ে ফেলবে, শয়তানের জন্য রেখে দেবে না।
[মুসলিম : ৩৭৯৪]
(১২) হেলান দিয়ে বসে না খাওয়া।
(বুখারী ৫৩৯৮)
(১৩) খাদ্যের ত্রুটি বের না করা।
(বুখারী ৫৪০৯)
খাবারের প্রশংসা করা মুস্তাহাব, কেননা এর মাধ্যমে খাবার আয়োজন ও প্রস্তুত কারীর উপর একটা ভাল প্রভাব পড়বে। সাথে সাথে আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কখনো এমন করতেন―জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় পরিবারের নিকট তরকারী চাইলেন। তারা বললেন, আমাদের কাছে সিরকা ছাড়া আর কিছু নেই। তিনি সিরকা আনতে বললেন এবং তার দ্বারা খেতে লাগলেন। অতঃপর বললেন, সিরকা কতইনা উত্তম তরকারী; সিরকা কতইনা উত্তম তরকারী।
(১৪) জুতা পরিহিত থাকলে জুতা খুলে খানা খাওয়া।
(মুস্তাদরাকে হাকেম ৭১২৯)
(১৫) খানার সময় তিনভাবে বসা যায়ঃ
ক. উভয় হাঁটু উঠিয়ে এবং পদ যুগলে ভর করে।
(মুসলিম-২০৪৪)
খ. এক হাঁটু উঠিয়ে এবং অপর হাঁটু বিছিয়ে।
(শরহুস্ সুন্নাহ-৩৫৭৭)
গ. উভয় হাঁটু বিছিয়ে অর্থাত নামাযে বসার ন্যায় বসে সামান্য সম্মুখ পানে ঝুঁকে আহার করা।
(আবু দাউদ ৩৭৭৩)
(১৬) খাবার গ্রহণ শেষে খাবার পাত্রসমূহ আঙ্গুল দ্বারা ভালভাবে চেটে পরিস্কার করে খাওয়াঃ
জাবের রা. থেকে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আঙুল এবং বর্তন চেটে খেতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং বলেছেন তোমরা জানো না কোনটায় বরকত রয়েছে।
[মুসলিম : ৩৭৯২]
আনাস রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থকে বর্ণনা করেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমরা যেন বর্তন পরিষ্কার করে খাই। তিনি বলেন―তোমরা জানো না তোমাদের খাবারের কোন অংশে বরকত রয়েছে। বরকত দ্বারা উদ্দেশ্য হল যার দ্বারা উপকার এবং পুষ্টি লাভ হয়।
[তিরমিজি : ১৭২৫]
প্লেট পরিস্কার করে খাওয়া মানে মুখ লাগিয়ে চেটে খাওয়া নয় বরং আঙ্গুল দিয়ে পরিস্কার করে খাবে
(১৭) আঙুল ধোয়ার পূর্বে চেটে খাওয়াঃ
কা’ব বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন : আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি, তিনি তিন আঙুল দিয়ে খাচ্ছেন এবং খাওয়া শেষে আঙুল চেটে খাচ্ছেন।
[মুসলিম : ৩৭৯০]
আবু হুরাইরা রা. থেকে মারফু হাদীসে বর্ণিত, যখন তোমরা কেউ খাবার খাবে তার উচিত আঙুল চেটে খাওয়া কেননা সে জানে না কোন আঙুলে বরকত রয়েছে।
[ মুসলিম : ৩৭৯৩]
(১৮) খাবার খাওয়া শেষ করার পর দোয়াঃ
(ক)
«الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَطْعَمَنِي هَذَا، وَرَزَقَنِيهِ، مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِنِّي وَلاَ قُوَّةٍ».
(আলহামদু লিল্লা-হিল্লাযী আত‘আমানী হা-যা ওয়া রাযাকানীহি মিন গাইরি হাউলিম মিন্নী ওয়ালা কুওয়াতিন)।
“সকল প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য, যিনি আমাকে এ আহার করালেন এবং এ রিযিক দিলেন যাতে ছিল না আমার পক্ষ থেকে কোনো উপায়, ছিল না কোনো শক্তি-সামর্থ্য।
(”হাদীসটি নাসাঈ ব্যতীত সকল সুনান গ্রন্থকারগণ সংকলন করেছেন। আবূ দাউদ, নং ৪০২৫; তিরমিযী, নং ৩৪৫৮; ইবন মাজাহ, নং ৩২৮৫। আরও দেখুন, সহীহুত তিরমিযী ৩/১৫৯।)
(খ) দস্তরখানা ও অবশিষ্ট খাবার উঠানোর সময় এই দু‘আ পড়াঃ
«الْحَمْدُ لِلَّهِ حَمْداً كَثِيراً طَيِّباً مُبَارَكاً فِيهِ، غَيْرَ [مَكْفِيٍّ وَلاَ ] مُوَدَّعٍ، وَلاَ مُسْتَغْنَىً عَنْهُ رَبَّنَا».
(আলহামদু লিল্লা-হি হামদান কাসীরান তায়্যিবান মুবা-রাকান ফীহি, গইরা মাকফিয়্যিন ওয়ালা মুয়াদ্দা‘ইন, ওয়ালা মুসতাগনান ‘আনহু রব্বানা)।
“আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা; এমন প্রশংসা যা অঢেল, পবিত্র ও যাতে রয়েছে বরকত; [যা যথেষ্ট করা হয় নি], যা বিদায় দিতে পারব না, আর যা থেকে বিমুখ হতে পারব না, হে আমাদের রব্ব!”
বুখারী ৬/২১৪, হাদীস নং ৫৪৫৮; তিরমিযী, আর শব্দটি তাঁরই, ৫/৫০৭, নং ৩৪৫৬।
(১৯) আহারের আয়োজনকারীর জন্য মেহমানের দোয়াঃ
«اللَّهُمَّ بَارِكْ لَهُمْ فِيمَا رَزَقْتَهُم، وَاغْفِرْ لَهُمْ وَارْحَمْهُمْ».
(আল্লা-হুম্মা বা-রিক লাহুম ফীমা রাযাক্তাহুম ওয়াগফির লাহুম ওয়ারহামহুম)।
“হে আল্লাহ! আপনি তাদেরকে যে রিযিক দান করেছেন তাতে তাদের জন্য বরকত দিন এবং তাদের গুনাহ মাফ করুন, আর তাদের প্রতি দয়া করুন।”
মুসলিম ৩/১৬১৫, নং ২০৪২।
(২০) খাবার খাওয়া শেষে আগে দস্তরখানা উঠিয়ে তারপর নিজে উঠা।
(ইবনে মাজাহ-৩২৯৫)
(২১) খাবার খেয়ে উভয় হাত ধোয়া।
(তিরমিযী ১৪৬৪)
(২২) কুলি করে মুখ পরিষ্কার করা।
(বুখারী-৫৪৫৫)
(২৩) খাবার খাওয়ার সময় একেবারে চুপ থাকা মাকরূহ। এজন্য খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে পরস্পরে ভাল কথা আলোচনা করা। কিন্তু যে ধরনের কথা বা সংবাদে দুশ্চিন্তা বা ঘৃণার উদ্রেক হতে পারে, তা খানার সময় বলা অনুচিত।
(বুখারী-৫৩৭৬)
(২৪) পানি পান করার ৬টি সুন্নাতি পদ্ধতিঃ
১- ডান হাতে পান করা।
(মুসলিম-২০২০)
২- বসে পান করা।
(মুসলিম-২০২৫)
৩- পান করার পূর্বে বিসমিল্লাহ্ বলা।
(সহীহুত তিরমিযী, ২/১৬৭)
৪- পান করার পূর্বে পানি দেখে পানকরা।
(মুসলিম-১৬০৯)
৫- ৩ নিঃশ্বাসে পান করা অর্থাৎ এক ঢোকে পান না করে ৩ বারে পান করা উত্তম।
(মুসলিম-২০২৮)
৬- পান করা শেষে কমপক্ষে আলহামদুলিল্লাহ্ বলা।
(মুসলিম-২৭৩৪)
তিন শ্বাসে পান করা। একটু পান করার পর পাত্র মুখ থেকে দুরে সরিয়ে নিয়ে শ্বাস নিবে। অতঃপর দ্বিতীয়বার এরপর একই ভাবে তৃতীয়বার।
যেমন আনাস রা.-এর হাদীসে এসেছ―
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পান করার মাঝে তিনবার শ্বাস নিতেন। মুসলিম শরীফের অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি বলতেন: এইভাবে পান করা অধিক পিপাসা নিবারণকারী অধিক নিরাপদ অধিক তৃপ্তিদায়ক।
পানাহারের শেষে আল্লাহর নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ স্বরূপ তাঁর প্রশংসা করবে। সর্বনিম্ন স্তর হচ্ছে অন্তত আলহামদুলিল্লাহ বলা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : যে ব্যক্তি খাবারের পর আল্লাহর প্রশংসা করে।অনুরূপ পান করার পর আল্লাহর প্রশংসা করে। আল্লাহ সে বান্দার প্রতি সন্তুষ্ট হন।