Q/A

কাফির কাদেরকে বলা হয়

কাফির কাদেরকে বলা হয়?
ইহুদি-খ্রিষ্টানরা আহলে কিতাব, তারাও কি কাফির?
বর্তমান সময়ে এই বিষয়টা খুব ভালোভাবে জেনে রাখা দরকার। প্রথমে জেনে নিই, ‘কাফির’ কে এবং কী করলে কাফির হয়।

আরবি (ك – ف – ر) তিনটি হরফের সমন্বয়ে اَلْكُفْرُ (কু’ফর) মাসদার (root) থেকে কাফির শব্দটি এসেছে। কুফর শব্দের অর্থ হলো, অবিশ্বাস করা, অস্বীকার করা ইত্যাদি। পরিভাষায়, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে এবং ইসলাম ও ঈমানের রুকন (মৌলিক বিষয়)-গুলোকে অস্বীকার করাকে কুফর বলা হয়। আর যে ব্যক্তি এই কুফরের কাজটি করে, তাকে কাফির বলা হয়।

এবার উদাহরণে আসি। আমরা বলেছি, কেউ ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোকে অস্বীকার করলে সে কাফির বলে গণ্য হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‘‘আর যারা কুফরি করে, তাদের জন্য রয়েছে দুর্ভোগ এবং তিনি তাদের আমলসমূহ ব্যর্থ করে দেবেন। তা এজন্য যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তারা তা অপছন্দ করে। অতএব, তিনি তাদের আমলসমূহ বিনষ্ট করে দেবেন।’’1

কুফরের প্রকারভেদ

কুফর প্রধানত দুই প্রকার

কুফরে আকবার বা বড় কুফর

এই ধরনের কুফরের মাধ্যমে ব্যক্তি কাফির সাব্যস্ত হয়; ঈমান থাকা অবস্থায় কেউ এমন কুফর করলে সে বেঈমান হয়ে যায়। যেমন: কেউ হিজাব নিয়ে কটাক্ষ ও উপহাস করে বললো,
‘‘এটা পরলে ভূতের মতো লাগে!’’ ইসলামের মৌলিক বিধান হিজাব নিয়ে উপহাস করায় ব্যক্তির কু’ফর হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‘‘(হে নবি) আপনি বলুন, তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর বিধি-বিধান এবং তাঁর রাসুলের সাথে ঠাট্টা করছিলে? তোমরা অজুহাত দেখাবে না; (কারণ) ঈমান আনার পর তোমরা কু'ফরি করেছো।’’2

কুফরে আসগার বা ছোট কুফর

এই ধরনের কুফরের কারণে ব্যক্তি গুনাহগার হলেও কাফির হয় না। যেমন: কাউকে হত্যা করা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
‘‘কোনো মুসলিমকে গালি দেওয়া পাপ এবং তাকে হত্যা করা কুফর।’’3

কাউকে হত্যা করা নিঃসন্দেহে মস্ত বড় কবিরা গুনাহ। তবে, এর দ্বারা কেউ কাফির হয়ে যাবে না। এ ব্যাপারে আলিমগণ একমত। ইসলামের স্বর্ণযুগেও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে; তার শাস্তিও হয়েছে, কিন্তু হত্যাকারীকে কাফির আখ্যা দেওয়া হয়নি।

ইহুদি-খ্রিষ্টানরা কি কাফির

প্রথমে ‘আহলে কিতাবসম্পর্কে একটু বলে নিই। আহলে কিতাব শব্দ দুটোর সম্মিলিত অর্থ হলো, কিতাবের অধিকারী। অর্থাৎ, যে সম্প্রদায় আসমানি বা ঐশী কিতাবপ্রাপ্ত, তাদেরকে আহলে কিতাব বলা হয়। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ হলো তাওরাত আর খ্রিষ্টানদের ইঞ্জিল (বাইবেল)। তাওরাত অবতীর্ণ হয়েছিলো মুসা (আ.)-এর উপর আর ইঞ্জিল ঈসা (আ.)-এর উপর। এই দুটো কিতাবের মৌলিকত্ব হেফাজতের দায়িত্ব ছিলো তাদের নিজেদের উপর। যুগে যুগে তাদের পাদ্রী-রাব্বাইরা এগুলোতে ম্যাসিভ পরিবর্তন এনেছে।

যার ফলে, এ দুটোর মৌলিকত্ব আর নেই। আল্লাহ বলেন,

‘‘নিশ্চয়ই আমি তাওরাত অবতীর্ণ করেছিলাম; এতে ছিলো হিদায়াত ও নুর (আলো)। অনুগত নবিগণ তাদেরকে সেই অনুসারে ফয়সালা দিতেন এবং রব্বানি (আল্লাহওয়ালা) ও বিদ্বানগণও (এর আলোকে ফয়সালা দিতো), কারণ তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের রক্ষক করা হয়েছিলো। আর তারা ছিল এর উপর সাক্ষী।4

পক্ষান্তরে, কুরআনের হেফাজতের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ নিয়েছেন। তিনি বলেন,

‘‘নিশ্চয়ই আমিই কুরআন নাযিল করেছি আর আমিই এর সংরক্ষক।’’5 

পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলোতে (তাওরাত, বাইবেল) শেষ নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তারা অহংকারবশত নবিজিকে মেনে নেয়নি। নবিজিকে মেনে না নেওয়া বড় কুফ’র। কারণ নবিজিকে না মানা মানে কুরআনকে অস্বীকার করা, পুরো ইসলামকেই অস্বীকার করা। এই কাজগুলো নিঃসন্দেহে কুফরি। এজন্যই তারা যতদিন নবিজিকে গ্রহণ না করবে এবং ইসলামকে মেনে না নেবে, ততদিন ঈমানদার হতে পারবে না। ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো অস্বীকার করার কারণে তাদেরকে কা’ফির হিসেবেই বিবেচনা করা হবে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
‘‘সেই সত্তার কসম! যাঁর হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ, ইহুদি হোক আর খ্রিষ্টান হোক, যে ব্যক্তিই আমার ব্যাপারে শুনেছে কিন্তু আমি যা নিয়ে এসেছি (আমার রিসালাত), তার উপর ঈমান না এনে মৃত্যুবরণ করবে, অবশ্যই সে জাহান্নামি হবে।6

ইহুদি-খ্রিষ্টানরা যে কাফির, এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম থেকে শুরু করে প্রত্যেক যুগের আলিমগণ একমত পোষণ করে এসেছেন। ইদানীং তথাকথিত কিছু উদারমনা মানুষ তাদেরকে কা’ফির বলতে সংকোচবোধ করেন। আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগতে থাকা এ সকল লোকের কথার পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।

সুতরাং জেনে রাখবেন, ইসলামের মৌলিক কোনো বিধানের ব্যাপারে সংশয় পোষণকারী, কোনো মৌলিক বিধানকে অস্বীকার বা অপছন্দকারী ব্যক্তি মাত্রই কাফির। হোক সে ইহুদি, খ্রিষ্টান, হিদু, বৌদ্ধ, নাস্তিক, মুরতাদ, মুশরিক বা অন্য কেউ। সবারই কমন পরিচয় হলো, তারা কাফির।

আপনারা কি জানেন, ইহুদি-খ্রিষ্টানরাও যে মুসলিম ছিলো

আপনারা কি জানেন, ইহুদি-খ্রিষ্টানরাও যে মুসলিম ছিলো? এমনকি সকল নবির ধর্মই ছিলো ইসলাম! বিস্তারিত জানুন দলিলসহ।

নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
‘‘নবিগণ একে অপরের বৈমাত্রেয় ভাই। তাঁদের মা (শরিয়ত) ভিন্ন, কিন্তু দ্বীন বা ধর্ম (বাবা) এক।’’7

অর্থাৎ, নবিগণের দ্বীন (ধর্ম) একটিই, তা হলো ইসলাম। তবে, তাঁদের শরিয়ত বা জীবনব্যবস্থা ভিন্ন ভিন্ন ছিলো। ধরুন, কোনো ব্যক্তি ৪ জন নারীকে বিয়ে করলো। এই চার নারীর সকল সন্তানের বাবা কিন্তু একজনই। কিন্তু মা ভিন্ন ভিন্ন। এখানে বাবা হলেন দ্বীন বা ধর্ম (ইসলাম), যেটি সব নবির একই, আর মা হলেন শরিয়ত বা জীবনবিধান, যেটি একেক নবির একেক রকম ছিলো।

নবিজির উপর অবতীর্ণ কুরআন একটি শরিয়ত (জীবনব্যবস্থা), মুসা (আ.)-এর উপর অবতীর্ণ তাওরাত একটি শরিয়ত, ঈসা (আ.)-এর উপর অবতীর্ণ ইঞ্জিল (বাইবেল) একটি শরিয়ত। কোনো শরিয়ত বিকৃত ও রহিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এর উপর আমল করা আবশ্যক। পূর্ববর্তীদের এসব শরিয়ত বিকৃত হওয়ার ফলে এখন আর তারা মুসলিম বলে গণ্য হবে না।8

প্রশ্ন আসতে পারে, সকল শরিয়ত (জীবনবিধান) যদি আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে, তাহলে এগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয় কী করে?
উদাহরণ দিলে বিষয়টি সহজে বুঝে আসবে। ইহুদিদের জন্য সপ্তাহের শনিবার দিনটি ছিলো ইবাদতের দিন। এ দিন নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিলো।9

এটা ছিলো দাউদ (আ.)-এর সময়ের শরিয়ত। সেই সময়ের উম্মতদের জন্য এই বিধান মেনো চলা বাধ্যতামূলক ছিলো। কিন্তু আমাদের শরিয়তে এটি নেই। বিভিন্ন নবির শরিয়তের বিধানে এরকম বিভিন্ন পার্থক্য ছিলো।
যাহোক, ইহুদি-খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্মগ্রন্থগুলো বিকৃত করেছে। নিজেদের মতো করে বিধি-বিধানে পরিবর্তন এনেছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‘‘সুতরাং দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা নিজ হাতে কিতাব রচনা করে, অতঃপর সামান্য মূল্য পাওয়ার জন্য বলে, ‘এটা আল্লাহর কাছ থেকে’।’’10

সাহাবি ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন,
‘‘তোমরা কোনো ব্যাপারে আহলে কিতাবদের জিজ্ঞাসা করো, অথচ তোমাদের কাছে রয়েছে নবির উপর অবতীর্ণ আল্লাহর নতুন (Latest) বাণীসংবলিত কিতাব। তোমরা সেটা পড়ছো, যেটিতে কোনো কিছুর মিশ্রণ নেই। আল্লাহ তোমাদের জানিয়েছেন যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছিলেন, আহলে কিতাবরা সেগুলো পরিবর্তন করেছে এবং তাদের নিজ হাতে কিতাব বিকৃত করে ফেলেছে আর বলেছে, ‘এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে।’’11

যেহেতু বর্তমানে পূর্বের সকল আসমানি কিতাব বিকৃত হয়ে গেছে এবং আল্লাহ তা‘আলা নতুন শরিয়ত দিয়ে নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণ করেছেন, সেহেতু এখন সবাইকে মুহাম্মাদি শরিয়ত অনুসরণ করতে হবে। এমনকি এই যুগে যদি মুসা (আ.)-ও আসেন, তাঁকেও নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করতে হবে। কারণ নতুন করে মুসা (আ.)-কে আর শরিয়ত দেওয়া হবে না এবং কুরআন আসায় আগের সকল শরিয়তের বিধান রহিত হয়ে গেছে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘‘যাঁর হাতে আমার প্রাণ, তাঁর শপথ! আমি তোমাদের নিকট নিয়ে এসেছি স্বচ্ছ ও নির্মল বিষয় (শরিয়ত)।…যদি মুসা (আ.)-ও জীবিত থাকতেন, তাহলে তাঁকেও আমাকে অনুসরণ করতে হতো।’’12

  1. সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৮-৯ ↩︎
  2. সুরা তাওবাহ, আয়াত: ৬৫-৬৬ ↩︎
  3. ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৬০৪৪ ↩︎
  4. সুরা মায়িদাহ, আয়াত: ৪৪ ↩︎
  5. সুরা হিজর, আয়াত: ৯ ↩︎
  6. ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ২৭৯ ↩︎
  7. ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৩৪৪৩ ↩︎
  8. ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহর ফাতাওয়া মিসরিয়্যাহ (পৃষ্ঠা: ৫০৯-৫১০) অবলম্বনে ↩︎
  9. সুরা বাকারা, আয়াত: ৬৫ ↩︎
  10. সুরা বাকারা, আয়াত: ৭৯ ↩︎
  11. ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ২৬৮৫ ↩︎
  12. ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ: ১৪৭৩৬; হাদিসটি হাসান ↩︎

লিখেছেন

Picture of নুসুস টিম

নুসুস টিম

কুরআন ও হাদিসের মূল পাঠকে নুসুস (text) বলা হয়। নুসুসের উপর ভিত্তি করেই আমরা লেখালেখি করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন
Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button