জুমার দিন ৮০ বার দরুদ পাঠে ৮০ বছরের গুনাহ মোচন
‘জুমার দিন ৮০ বার দরুদ পাঠে ৮০ বছরের গুনাহ মোচন’ সম্পর্কিত হাদিসগুলো বানোয়াট এবং অত্যধিক দুর্বল (সনদ বিশ্লেষণ সহ)।
জুমার দিন ৮০ বার দরুদ পাঠে ৮০ বছরের গুনাহ মোচন সম্পর্কিত হাদিসগুলো কোনটি সহিহ নয়। তবে সাধারণভাবে এ দিনে অধিক পরিমাণে দরুদ পাঠ অত্যন্ত ফযিলত পূর্ণ আমল।
নিম্নে এ বিষয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হল: وبالله التوفيق
এ প্রসঙ্গে প্রায় সমার্থবোধক তিনটি হাদিস পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে দুটি হল, موضوع বা বানোয়াট এবং অপরটি ضعيف جداً বা অত্যধিক দুর্বল।
এ তিনটি হাদিস সম্পর্কে বিজ্ঞ মুহাদ্দিস ও রিজাল শাস্ত্রবিদগণের মতামত ও সনদ বিশ্লেষণ নিম্নরূপ:
১ম হাদিস: (জাল বা বানোয়াট)
আনাস রা. বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সামনে দণ্ডায়মান ছিলাম। তখন তিনি বললেন,
مَنْ صَلَّى عَلَيَّ يَوْمَ الْجُمُعَةِ ثَمَانِينَ مَرَّةً غَفَرَ اللَّهُ لَهُ ذُنُوبَ ثَمَانِينَ عَامًا
فَقِيلَ لَهُ : كَيْفَ الصَّلاةُ عَلَيْكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟
قَالَ : تَقُولُ اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ عَبْدِكَ ونبيك ورسولك النبي الأمي، وتعقد واحدا .
“যে ব্যক্তি জুমার দিন আমার প্রতি ৮০ বার দরুদ পাঠ করবে আল্লাহ তার আশি বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।
তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার প্রতি কীভাবে দরুদ পাঠ করবো হে আল্লাহর রাসুল?
তিনি বললেন, বলবে: “আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিন আবদিকা ওয়া নাবিয়্যিকা ওয়া রাসূলিকান নাবিয়্যিল উম্মী।”
অর্থ: “হে আল্লাহ! তুমি সালাত পেশ করো (রহমত নাজিল করো) তোমার বান্দা, তোমার নবী, এবং তোমার রাসুল উম্মী নবী (নিরক্ষর নবী) এর প্রতি” এবং একবার গিরা দিবে।
হাদিসের মান: হাদিসটি জাল-বানোয়াট।
হাদিসের সনদ বিশ্লেষণে মুহাদ্দিসগণের মতামত নিম্নরূপ:
ক. এটি খাতীব বাগদাদী তারিখে বাগদাদ [১৩/৪৬৪] এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। এর সনদে ওয়াহাব ইবনে দাউদ ইবনে সুলায়মান আয-যারীয নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছেন। যাহাবী বলেন, খাতিব বাগদাদী তার ব্যাপারে বলেছেন, “তিনি নির্ভরযোগ্য ছিলেন না।” অত:পর, তার বানানো একটি হাদিস পেশ করেছেন। [তথ্য সূত্র: আল মুগনী ফিয যুয়াফা ২/৭২৭]
গ. ইবনুল জাওযী হাদিসটিকে তার বিখ্যাত বানোয়াট হাদিস সংকলন ‘আল-আহাদীসুল ওয়াহিয়া’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন [হাদিস নং ৭৯৬]।
ঘ. আলবানী বলেন, এটি তিনি (ইবনুল জাওযী) তার আরেকটি বানোয়াট হাদিস সংকলন ‘আহাদীসুল মাওযুআত’ গ্রন্থেও উল্লেখ করেছেন। এটিই অধিক উপযোগী। কারণ এর মধ্যে জাল হাওয়ার চিহ্ন সুস্পষ্ট। আর সহীহ হাদিসে দরূদ পাঠের যে সব ফযিলত এসেছে তাতে এ জাতীয় (জাল-জইফ) হাদিসের প্রয়োজন নাই। যেমন: রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, من صلى علي مرة واحدة صلى الله عليه بها عشراً
“যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার বিনিময়ে তার উপর দশবার রহমত নাজিল করবেন।” [সহিহ মুসলিম ইত্যাদি]
২য় হাদিস: (অত্যধিক দুর্বল)
এ জাতীয় আরেকটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এ হাদিসটিকে পূর্বোক্ত হাদিসের শাহেদ (সাক্ষ্য হাদিস বলা যায়)। কিন্তু তাও অধিক বিশুদ্ধ মতে সনদগতভাবে অত্যধিক দুর্বল। (যদিও কোনও কোনও মুহাদ্দিস এটিকে হাসান বলেছেন)। তা হল:
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
الصَّلَاةُ عَلَيَّ نُورٌ عَلَى الصِّرَاطِ ، فَمَنْ صَلَّى عَلَيَّ يَوْمَ الْجُمُعَةِ ثَمَانِينَ مَرَّةً ، غُفِرَتْ لَهُ ذُنُوبُ ثَمَانِينَ عَامًا
“সালাত হল, পুল সিরাতের আলো। সুতরাং যে ব্যক্তি জুমার দিন আমার উপরে আশি বার সালাত (দরুদ) পেশ তার আশি বছরের গুনাহ মোচন করা হবে।”
হাদিসটির মান: এটি ضعيف جداً বা অত্যধিক দুর্বল।
মুহাদ্দিসগণের মতামত:
এর হাদিসের সনদে তিনজন দুর্বল রাবী (বর্ণনাকারী) রয়েছে। যথা:
১. আলি বিন যায়েদ বিন জুদআন আল বাসরী:
ক. এই বর্ণনাকারীর ব্যাপারে হাম্মাদ বিন যায়েদ বলেন, كَانَ يقلب الْأَحَادِيث “তিনি হাদিস উল্টিয়ে দিতেন (হাদিসের সনদে না মতনে শব্দের মধ্যে পরিবর্তন বা আগে-পিছে করতেন)।”
খ. শুবা বলেন, أَنه اخْتَلَط “তার হাদিসের মধ্যে ওলট-পালট বা সংমিশ্রণ ঘটে গিয়েছিলো।”
গ. আহমদ বলেন, لَيْسَ بِشَيْء “এ ব্যক্তি কিছুই নয়।” অর্থাৎ মোটেও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি নয়। মুহাদ্দিসদের পরিভাষায় এমন ব্যক্তি কর্তৃক বর্ণিত হাদিস ‘মারাত্মক পর্যায়ের দুর্বল’ অথবা ‘মিথ্যাচার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
ঘ. আবু যুরয়া বলেন, لَيْسَ بِقَوي يهم ويخطئ “তিনি শক্তিশালী নন। তিনি অনুমান ভিত্তিক হাদিস বর্ণনা করতে গিয়ে ভুল করতেন।”
ঙ. আবু হাতিম বলেন, “ لَا يحْتَج بِهِ “তার বর্ণিত হাদিস দ্বারা দলিল গ্রহণ করা যাবে না।”
চ. দারাকুতনী বলেন, আমার নিকট, তার মধ্যে অদ্য বধী দুর্বলতা আছে। [সূত্র: ইমাম যাহাবী রচিত আল মুগনী ফিয যুয়াফা ২/৪৪৭]
২. হাজ্জাজ বিন সিনান:
তার ব্যাপারে আযদী বলেন, متروك “পরিত্যাজ্য।” (এমন বর্ণনাকারীকে متروك মাতরূক বা পরিত্যাজ্য বলা হয় যে, যে মিথ্যাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত অথবা যে ব্যক্তি মুহাদ্দিসগণের সর্বসম্মতিক্রমে দুর্বল।)
[সূত্র: লিসানুল মিযান-ইবনে হাজার। ২/৫৬৩]
৩. আউন বিন উমরা আল কায়সী:
ক. আবু যুরয়া বলেন, منكر الحديث (হাদিস বর্ণনায় উদ্ভট হাদিস বর্ণনার কারণে প্রত্যাখ্যাত ব্যক্তি)
খ. হাকিম বলেন, أدركته ولم أكتب عنه ، وكان منكر الحديث ضعيف الحديث “আমি তার সাক্ষাত পেয়েছি। কিন্তু তার হাদিস লেখিনি। তিনি হাদিসের ক্ষেত্রে মুনকার এবং দুর্বল ছিলেন।”
গ. আবু দাউদ বলেন, ضعيف (দুর্বল)।
[সূত্র: তাহযীবুত তাহযীব, ৮/১৭৩]
এ হাদিসটিকে ইমাম দারাকুতনী, হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী, সাখাবী, মুনাবী, শাইখ আলবানী প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ জইফ (দুর্বল) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
[উপরোক্ত আলোচনাটির মূল প্রতিবাদ্য Islam QA থেকে অনুবাদ ও সংক্ষেপায়ন করা হয়েছে।]
৩য় হাদিস: (বানোয়াট)
কিছু বৃদ্ধি সহ প্রায় সমার্থবোধক আরেকটি হাদিস হল:
“যে ব্যক্তি জুমার দিন আসরের নামাজের পর ওই স্থানে বসা অবস্থায় ৮০ বার নিম্নে উল্লেখিত দরুদ শরীফ পাঠ করবে, তার ৮০ বছরের গুনাহ মাফ হবে এবং ৮০ বছরের নফল ইবাদতের সওয়াব তার আমল নামায় লেখা হবে। তা হল: “আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিনিন নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি ওয়া আলা আলিহি ওয়া সাল্লিম তাসলিমা।” [এহিয়া উলুমিদ্দীন-গাজালাী]
হাদিসটির মান: এটিও মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে ভিত্তিহীন, বানোয়াট:
সৌদি আরবের স্থায়ী ফতোয়া বোর্ডকে উক্ত হাদিস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে (প্রশ্নকারী বলেন, এ হাদিসটি পাকিস্তানের এক টেলিভিশনে সারা রমজান মাস ব্যাপী ব্যবসায়িক এড হিসেবে প্রচারিত হয়েছে)। তারা উত্তরে বলেন,
هذا الحديث المذكور لا أصل له، فلا يجوز العمل به
اللجنة الدائمة للبحوث العلمية والإفتاء(24/162- 163)
“উল্লেখিত হাদিসের কোনও ভিত্তি নাই। সুতরাং তার উপর আমল করাও বৈধ নয়…।”
[সংক্ষেপিত। উৎস: ফাতাওয়া লাজনা দায়েমা ২৪/১৬২-১৬৩]
জুমার দিনে দরূদ পাঠের মর্যাদা:
জুমার দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর অধিক পরিমাণে দরুদ পাঠ কা অত্যন্ত ফযিলত পূর্ণ আমল। যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
প্রখ্যাত সাহাবি আউস বিন আউস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
إِنَّ مِنْ أَفْضَلِ أَيَّامِكُمْ يَوْمَ الْجُمُعَةِ ، فِيهِ خُلِقَ آدَمُ عَلَيْهِ السَّلَام ، وَفِيهِ قُبِضَ ، وَفِيهِ النَّفْخَةُ ، وَفِيهِ الصَّعْقَةُ ، فَأَكْثِرُوا عَلَيَّ مِنْ الصَّلَاةِ فَإِنَّ صَلَاتَكُمْ مَعْرُوضَةٌ عَلَيَّ
“তোমাদের দিন সমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হল জুমার দিন। এই দিনে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিনে তাকে মৃত্যু দেওয়া হয়েছে, এই দিনে শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়া হবে এবং মহা বিপর্যয় (কিয়ামত)ও ঘটবে এই দিনেই। তাই এই দিনে তোমরা বেশি বেশি আমার উপর দরুদ পাঠ কর। কেননা জুমার দিনে তোমাদের দরুদ আমার নিকট পেশ হয়…।”
[সহিহ আবু দাউদ, হা/৯২৫]
সহিহ সনদে বর্ণিত এ হাদিসের আলোকে আমদের কর্তব্য, জুমার দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর অধিক পরিমাণে সালাত (দরুদ) পাঠ করা।এটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ আমল। আর এ কথায় কোনও সন্দেহ নাই যে, সর্বশ্রেষ্ঠ দরুদ তো তাই যা আমরা প্রতিনিয়ত পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের শেষ বৈঠকে পাঠ করে থাকি (যাকে বলা হয়, দরুদে ইবরাহিম)। এমনকি আলোচ্য দরুদটিও পাঠ করা জায়েজ আছে। কারণ তার অর্থের মধ্যে কোনও সমস্যা নাই। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ৮০ বার সংখ্যা নির্দিষ্ট করা বা ৮০ বছরের গুনাহ মোচনের ফজিলতের উপর বিশ্বাস করা অথবা আসর সালাতের পর যথাস্থানে বসে পাঠ করা সংক্রান্ত বর্ণিত হাদিসগুলো বিশুদ্ধ সনদে প্রমাণিত না হওয়ার কারণে গ্রহণযোগ্য নয়। এগুলোর কোনোটি জাল ও বানোয়াট আর কোনও টি মারাত্মক পর্যায়ের জইফ-যেমনটি মুহাদ্দিসের পর্যালোচনা ও মতামতের আলোকে প্রমাণিত হয়েছে। (দু-একজন মুহাদ্দিস এ সংক্রান্ত হাদিসকে ‘হাসান’ বললেও তা মূলত: রাজেহ বা অগ্রাধিকার যোগ্য মত নয়)
আমাদের দেশে জুমার দিন বিশেষ করে আসর সালাতের পর অনেক মানুষকে জুমার দিন আসর সালাতের পরে মসজিদে বসে এই ভিত্তিহীন আমল করতে দেখা যায় অথচ সুন্নত ছিল, আসরের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত অধিক পরিমাণে আল্লাহর কাছে দুআ করা। কারণ হাদিস মোতাবেক জুমার দিন যে সময়টায় দুআ করলে আল্লাহর কাছে কবুল হওয়ার অধিক আশা করা যায় তা হল, আসর থেকে মাগরিবের মাঝের সময়।
কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, এ সব জাল-জইফ আমল দ্বারা মানুষকে সুন্নত থেকে ব্যস্ত করে রাখা হয়েছে। আর মানুষকে এভাবে বিদআতে লিপ্ত করার পেছনে অবদান রাখছেন আমাদের দেশের অনেক মুফতি ও মাওলানা এবং আমাদের সমাজে প্রচলিত ফাজায়েল ও অজিফা জাতীয় কিছু বই। (আল্লাহ আমাদেরকে হেদায়েত করুন। আমিন)
পরিশেষ বলব, খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে যেমন আমাদের কর্তব্য, নকল ও ভেজাল খাবার বর্জন করে নির্ভেজাল ও স্বাস্থ্য সম্মত খাবার গ্রহণ করে সুস্থ থাকার চেষ্টা করা তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত-বন্দেগির ক্ষেত্রে বানোয়াট, জাল-জইফ ও সন্দেহ পূর্ণ আমল থেকে দূরে থেকে আমাদের আমলনামাকে কলুষমুক্ত রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করা। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমিন।
আল্লাহু আলাম