জীবনে যিনি ঘর থেকে তিন বারের বেশি বের হননি!
এক বোনের ব্যাপারে তাঁর আপন ভাই সাক্ষ্য দিচ্ছেন, ইমাম ইবনুল জাওযী (৫০৮-৫৯৭ হি) রহিমাহুল্লাহ বলেন,
وحدثني أخوها صاحب المخزن أنها كانت كثيرة التعبد شديدة الخوف ما خرجت في عمرها من بيتها إلا ثلاث مرات لضرورة وما كانت تلتفت الى زينة الدنيا
“তাঁর কোষাধ্যক্ষ ভাই আমাকে বর্ণনা করেন, তিনি ছিলেন অধিক ইবাদাতগুজার এবং (আল্লাহর ভয়ে) ভীতকম্পিত। তিনি তাঁর জীবনে ঘর থেকে তিন বারের বেশি বের হননি। তাও অত্যধিক জরূরত দেখা দিয়েছিলো বলে। আর দুনিয়ার চাকচিক্যের দিকে তিনি চোখ তুলেও তাকাননি।”1
এই নারীর পরিচয় কী?
তিনি হলেন ষষ্ঠ হিজরী শতকের এক মহীয়সী নারী। তাঁর নাম ফাতিমাহ বিনতু নাসর ইবনুল আত্তার আল-বাগদাদিয়্যাহ (৫৭৩ হি) রহিমাহাল্লাহ।2 ইমাম ইবনু কাসীর (৭০০-৭৭৪ হি) রহিমাহুল্লাহ এই মহীয়সী নারীর সম্পর্কে বলেন,
كَانَتْ مِنْ سَادَاتِ النِّسَاءِ، وَهِيَ مِنْ سُلَالَةِ أُخْتِ صَاحِبِ الْمَخْزَنِ، وَكَانَتْ مِنَ الْعَابِدَاتِ الْمُتَوَرِّعَاتِ الْمُخَدَّرَاتِ
“তিনি ছিলেন প্রভাবান্বিতকারী এক নারী। ছিলেন তৎকালীন কোষাধ্যক্ষের বোনকূল। ইবাদাতগুজার, পরহেযগার এবং পর্দাশীনাদের অন্যতম।”3
এই মহীয়সী নারী ছিলেন আল্লাহ রব্বুল ‘আলামীনের নিম্নোক্ত নির্দেশনার পূর্ণ বাস্তবায়নকারী:
وَقَرۡنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجۡنَ تَبَرُّجَ ٱلۡجَٰهِلِيَّةِ ٱلۡأُولَىٰۖ
"আর তোমরা তোমাদের ঘরেই অবস্থান করো এবং প্রাক-জাহেলী যুগের সৌন্দর্য প্রদর্শনীর মতো নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়িও না।"4
মহীয়সী এই নারী যেন ছিলেন নিম্নোক্ত হাদীসের পূর্ণ প্রতিচ্ছবি, নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِنَّ الْمَرْأَةَ عَوْرَةٌ، فَإِذَا خَرَجَتِ اسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ، وَأَقْرَبُ مَا تَكُونُ مِنْ وَجْهِ رَبِّهَا وَهِيَ فِي قَعْرِ بَيْتِهَا
“মহিলারা হচ্ছে আওরাত (আবরণীয় বস্তু)। সে বাইরে বের হলে শয়তান তার দিকে চোখ তুলে তাকায় এবং তখনই সে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিকটতর হয় যখন সে নিজ গৃহের অন্দরমহলে অবস্থান করে।”5
ইমাম যাহাবী (৬৭৩-৭৪৮ হি) রহিমাহুল্লাহ এই মহীয়সী নারীর সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন,
أخت صاحب المخزن. امْرَأَة محتشمة، زاهدة، عابدة، كبيرة القدر.
سمعها أرباب الدّولة لأجل أخيها، وخلْق كثير
“কোষাধ্যক্ষের ভগিনী। লজ্জাবতী। যাহিদা (দুনিয়াবিমুখ), আবিদা (ইবাদাতগুজার) এবং বিরাট ভাগ্যবতী। ভাইয়ের উঁচ্চ মর্যাদার বদৌলতে তাঁর নাম-যশ দেশ-বিদেশের নেতৃর্স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এবং এর বাইরেও বহু মানুষের কর্ণকুহরে ছড়িয়ে পড়ে।”6
এই মহিয়সী নারীর মৃত্যুর পর বাগদাদের পথঘাট লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। সমসাময়িক আলিম ও ঐতিহাসিক ইমাম ইবনুল জাওযী রহিমাহুল্লাহর ভাষায়-
توفيت يوم الأربعاء سادس عشر رمضان واخرجت جنازتها بكرة الخميس إلى جامع القصر ونحي شباك المقصورة لأجلها وحضر جميع أرباب الدولة [سوى] الوزير وصلى عليها أخوها صاحب المخزن وامتلأت الأسواق والشوارع بالناس أكثر من يوم العيد وشيعها إلى مقبرة أحمد بن حنبل خلق كثير من الأكابر ودفنت عند أبيها وشاع عنها الذكر الجميل والزهد في الدنيا،
“তাঁর ইন্তেকাল হয় ১৬ রমজান রোজ বুধবার। বৃহস্পতিবার প্রভাতে তাঁর জানাযার খাটিয়া বাইরে বের করে এনে জামিউল কসর (কসর বিশ্ববিদ্যালয়) প্রাঙ্গণে রাখা হয়। তাঁর সম্মানের দিকে তাকিয়ে তাঁর লাশবাহী খাটিয়া অন্তঃপুরের ছোট্ট এক কামরার জানালার সামনে আড়াল করে রাখা হয়েছিলো। তাঁর জানাযায় সমস্ত রাজ্যের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, বিশেষত রাজ্যসমূহের মন্ত্রীবর্গ উপস্থিত হন। তাঁর কোষাধ্যক্ষ আপন ভাই তাঁর জানাযা পড়ান। লোক সমাগমের ফলে বাজারঘাট ও সড়কপথগুলো কানায় কানায় ভর্তি হয়ে গিয়েছিলো। জনতার উপস্থিতি ছিলো ঈদের দিন এবং অন্যান্য সম্মিলনের চেয়েও বেশি। জনস্রোত আহমাদ ইবনু হাম্বাল (১৬৪-২৪১ হি / রহিমাহুল্লাহ) এর কবরের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলো। বড় বড় মানুষেরা তাঁর জানাযায় শরীক হন। পিতার কবরের পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর সুন্দর স্মৃতি এবং দুনিয়াবিমুখতা দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।”7
একজন নারীর জানাযায় এই পরিমাণ উপস্থিতির ঘটনা ইসলামী ইতিহাসে বোধ হয় খুব কমই পাওয়া যাবে। মূল ব্যাপারটি হলো তা’আল্লুক মা’আল্লাহ বা আল্লাহর সাথে সম্পর্ক। যার মাধ্যমে ঘরের অন্দরমহল হতেও আসমানের সাথে সম্পর্ক হতে পারে। প্রিয় নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إِذَا أَحَبَّ اللهُ عَبْدًا نَادَى جِبْرِيلَ: إِنَّ اللهَ يُحِبُّ فُلَانًا فَأَحِبَّهُ، فَيُحِبُّهُ جِبْرِيلُ، فَيُنَادِي جِبْرِيلُ فِي أَهْلِ السَّمَاءِ: إِنَّ اللهَ يُحِبُّ فُلَانًا فَأَحِبُّوهُ، فَيُحِبُّهُ أَهْلُ السَّمَاءِ، ثُمَّ يُوضَعُ لَهُ الْقَبُولُ فِي أَهْلِ الْأَرْضِ
“আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন, তখন তিনি জিবরীলকে ডেকে বলেন,
“নিশ্চয়ই আল্লাহ অমুককে ভালোবাসেন, অতএব তুমিও তাকে ভালোবাসো।”
সুতরাং জিবরীলও তাকে ভালোবাসেন। তারপর জিবরীল আসমানবাসীদের মধ্যে ঘোষণা করে দেন যে,
“নিশ্চয়ই আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন, কাজেই তোমরাও তাকে ভালোবাসো।”
তখন আসমানবাসীরাও তাকে ভালোবাসে। অতঃপর যমীনবাসীদের মধ্যেও তার জন্যে কবুলিয়ত (গ্রহণযোগ্যতা) রেখে দেয়া হয়।”8
ফাতিমাহ আল-বাগদাদিয়্যাহ রহিমাহাল্লাহ সম্পর্কে ইমাম ইবনু কাসীর (৭০০-৭৭৪ হি) রহিমাহুল্লাহ বলেন,
وَقَدْ أَثْنَى عَلَيْهَا الْخَلِيفَةُ وَغَيْرُهُ
“আর খলীফারাও তাঁর ব্যাপারে প্রশংসা করেছেন এবং অন্যরাও।”9
ইল্মের প্রাণকেন্দ্র বাগদাদ নগরীতে ফাতিমাহ আল-বাগদাদিয়্যাহর এই জানাযা স্মরণ করিয়ে দেয় এই নগরীর আরেক জানাযাকে। হ্যাঁ, ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল রহিমাহুল্লাহর জানাযা। তিনি নিজেই জীবদ্দশায় নিজের জানাযার দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন,
بيننا وبينكم يومُ الجنائزِ
“জানাযার দিনটিই তোমাদের আর আমাদের পার্থক্য পরিস্কার করে দেবে।”10
ঐতিহাসিকগণ ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন যে, ইমাম আহমাদ রহিমাহুল্লাহর জানাযায় জনস্রোতের ঢেউ নেমেছিলো। ১২০০ বছরের আগের সেই জানাযায় দশ লাখ লোকের উপস্থিতির কথাও ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন।11
ফাতিমাহ আল-বাগদাদীয়্যাহ রহিমাহাল্লাহ কোন তিনটি দিন ঘর থেকে বের হয়েছিলেন?
দিনগুলো সম্পর্কে চাউর আছে যে,
- যেদিন তিনি বিবাহ করেছিলেন,
- যেদিন তিনি হজ্বে গিয়েছিলেন,
- যেদিন তিনি মারা গিয়েছিলেন;
এই তিন দিন।
কিন্তু আমাদের অনুসন্ধান মতে এ ধরণের কোনো বক্তব্য কোনো কিতাবে খুঁজে পাওয়া যায় না। কথাটি ইমাম যাহাবীর ‘তারীখুল ইসলাম’ এর বরাতে চালিয়ে দেয়া হলেও এর প্রসিদ্ধ ৩টি নুসখা বা পাণ্ডুলিপিতে অনেক খোঁজাখুজি করেও এ ধরণের কোনো বক্তব্য আমরা খুঁজে পাইনি।12 উপরন্তু ইযযুদ্দীন আইকাল নামক একজন গবেষক এই বর্ধিত অংশকে বানোয়াট বলে অভিহিত করেছেন। সুতরাং দিনগুলো সম্পর্কে আল্লাহই সর্বাধিক অবহিত।
মহান রব ফাতিমাহ আল-বাগদাদিয়্যাহ রহিমাহুল্লাহর কবরকে আলোকিত করুন এবং আমাদের মুসলিম বোনদের জন্য তাঁর জীবনী হতে আলো নেয়ার তাওফীক দান করুন।
- আল-মুনতাযিমু ফী তারীখিল মুলূকি ওয়াল উমাম, ইবনুল জাওযী, ১৮/২৪৫ ↩︎
- তারীখুল ইসলাম (বাশশার তাহকীককৃত), যাহাবী, ১২/৫২৬ ↩︎
- আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া (আত-তুর্কী তাহকীককৃত), ইবনু কাসীর, ১৬/৫২৭ ↩︎
- সূরাতুল আহযাবঃ ৩৩ ↩︎
- আস-সহীহ, ইবনু খুযাইমাহ, ১৬৮৫; ইহকামুন নাযারি ফী আহকামিন নাযার, ইবনুল ক্বাত্তান, পৃঃ ১৭২-১৭৩; আলবানী ও ইবনুল ক্বাত্তানের মতে সহীহ ↩︎
- তারীখুল ইসলাম (বাশশার তাহকীককৃত), যাহাবী, ১২/৫২৬ ↩︎
- আল-মুনতাযিমু ফী তারীখিল মুলূকি ওয়াল উমাম, ইবনুল জাওযী, ১৮/২৪৫ ↩︎
- আস-সহীহ, বুখারী, ৬০৪০ ↩︎
- আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া (আত-তুর্কী তাহকীককৃত), ইবনু কাসীর, ১৬/৫২৭ ↩︎
- সুওয়ালাতুস সুলামী, দারাক্বুতনী, পৃঃ ৩৬১ ↩︎
- ইসলাম কিউ এ, প্রশ্ন নংঃ 266488 ↩︎
- বাশশার তাহকীককৃত ‘তারীখুল ইসলাম’, তাদমুরী তাহকীককৃত ‘তারীখুল ইসলাম’ এবং মাকতাবাতুত তাওফীকীয়্যাহ প্রকাশিত ‘তারীখুল ইসলাম’ ↩︎