জানাযার নামাজ (পর্ব-২)
এখন আমি জানাজার যে বিশেষ দিকটি নিয়ে কথা বলতে চাই তা হলো – জানাজা একজন মুসলমানের উপর অন্য মুসলমানের অধিকার। এটি একটি সামাজিক অধিকার, এবং আমরা প্রায়শই সেভাবে চিন্তা করি না। রাসুল (ﷺ) বলেছেন, একজন মুসলমানের অন্য মুসলমানের উপর পাঁচটি হক্ব রয়েছে।
সালামের জবাব দেওয়া
কেয়ামতের আলামতগুলোর একটি সম্পর্কে রাসুল (ﷺ) কি বলেছেন?
লোকেরা কেবল তাদেরই সালাম দিবে যাদের তারা জানে। সালাম শুধুমাত্র মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে অভিবাদন নয়, এটা মুসলমানদের মধ্যে থাকা চক্রের জন্য অভিবাদন। কাজেই আপনি সেগুলিকে অবহেলা করেন, যেন আপনি বলতে চান – মুসলিম হওয়ার সাথে যদি আপনার কিছু যোগ না থাকে তবে আপনি আমার সালামের যোগ্য নন।
রাসুল (ﷺ) বলেছেন একজন মুসলিমের উপর অন্য মুসলিমের দ্বিতীয় হক্বটি হল-
অসুস্থদের দেখতে যাওয়া। আমি জানি মহামারীর কারণে ব্যাপারটি এখন কিছুটা জটিল, কিন্তু আমি চাই স্বাভাবিক সময়ে আপনি চিন্তা করে করে দেখুন – অসুস্থ ব্যক্তিদের দেখতে যাওয়া সম্পর্কে সুন্নাহটি এখন কতটা অবহেলিত। এ কারণে আপনি অসুস্থদের দেখতে যাবেন না যে এটা আপনার দায়িত্ব, বা তারা আপনার পরিবার পরিজন, এই কারণে নয় যে রোগীর পাশে আপনি প্রত্যাশিত, বা আপনার সাথে তাদের ঘনিষ্ঠতা আছে, আপনি রোগীকে দেখতে যাবেন শুধুমাত্র আল্লাহ সুবহানা তা’লার সন্তুষ্টির জন্য। অসুস্থদের দেখতে যাওয়া, তাদের সান্ত্বনা দেওয়া এবং তাদের জন্য দু’য়া করা – একটি সুন্দর সামাজিক অভ্যাস যা আজ অবহেলিত সুন্নাহ গুলোর একটি।
তৃতীয় যে হক্বটির কথা রাসুল (ﷺ) বলেছেন তা হল * জানাযার অনুসরণ। আমি আগে যে হক্ব দুটির কথা উল্লেখ করেছি তার আলোকে এটি চিন্তা করুন। আপনি জানাজা পড়ুন এবং মৃত ব্যক্তিকে সঠিকভাবে দাফন করুন। জানাজা পড়ে জানাজার পরবর্তী কার্যক্রম অনুসরণ করুন।
এরপর রাসুল (ﷺ) *দাওয়াত কবুল করার কথা বলেছেন। আমরা সাধারণত কাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করি? কাদের আমন্ত্রণ জানাই? একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষ? যাদের সাথে আমাদের সুনিদৃষ্ট সংযোগ আছে তাদের?
রাসুলের (ﷺ) উল্লেখিত ৫ম হক্বটি হল *আপনি মানুষের হাঁচির জবাব দিবেন। যখন কেউ হাঁচি দেয় এবং আলহামদুলিল্লাহ বলে, তখন আপনি ইয়ারহামুকাল্লাহ বলবেন – অর্থাৎ আল্লাহ আপনার প্রতি রহম করুন।
সুতরাং কারো জানাজায় শরিক হওয়া আপনার উপর মৃত ব্যক্তির একটি অধিকার। আপনি যে কেবলমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জানাজায় অংশগ্রহণ করবেন তা কিন্তু নয়। সালাতুল জানাজা ফরজে কিফায়া, এটি কাউকে না কাউকে আদায় করতেই হবে এটি একটি সামাজিক বাধ্যবাধকতা, তবে ফরজে আইন নয় আর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তির উপর তা ফরজ নয়।
আপনি কি মাঝে মাঝে অসঙ্গতি লক্ষ্য করেন এমন দুজনের মধ্যে যিনি সুপরিচিত এবং আরেকজন যাকে কেউ চিনে না, এবং এমন কেউ যার সম্প্রদায়ে একটি বড় পরিবার রয়েছে এবং যার পরিবার পরিজন কেউ নেই তার মধ্যে? আবিসিনিয়ান সেই মহিলার বর্ণনা সম্পর্কে চিন্তা করুন যিনি মসজিদ পরিষ্কার করতেন এবং আমরা সর্বদা মসজিদ পরিষ্কার করার ফজিলত সম্পর্কে তার উদাহরণ দিয়ে থাকি। আসুন এবার ভিন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ঘটনাটা দেখি।
রাসুল (ﷺ) মসজিদে আসলেন এবং তিনি লক্ষ্য করেন যে আবিসিনিয়ান সেই মহিলা সেদিন মসজিদে অনুপস্থিত। এমন নয় যে তাঁর মৃত্যুর পর তখন এক মাস অতিবাহিত হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গেই রাসুল (ﷺ) বললেন, ‘সেই মহিলা কোথায় যিনি মসজিদ পরিষ্কার করতেন? রাসুল (ﷺ) তাঁর অনুপস্থিতি অনুভব করলেন, এবং তারা বললেন ‘হে রাসুলুল্লাহ, তিনি গত রাতে মারা গেছেন।’
রাসুল (ﷺ) বললেন, ‘তোমরা আমাকে কেন বলোনি, আমাকে কেন ডাকলে না, আমিও তাঁর জানাজা পড়তে পারতাম।’ তারা বলল, ‘হে রাসুলুল্লাহ, আমরা আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি তাই আমরা নিজেরাই করেছি।’ সাহাবীরাই তাঁকে গোসল করিয়েছে, তাঁর জানাজা পড়িয়েছে এবং তাঁকে কবরস্থানে নিয়ে গেছে। আবিসিনিয়ান সেই বৃদ্ধা রাতের বেলায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তাই সাহাবীরা বলেছিল, ‘ আমরা আপনাকে বিরক্ত করতে চাই না হে রাসুলুল্লাহ।’
রাসুল (ﷺ) বলতে পারতেন لا حول ولا قوه الا بالله – আহা! আমি তাঁর জানাজায় শামিল হতে পারিনি, বরং তিনি বললেন, ‘আমাকে তাঁর কবরে নিয়ে যাও, যেখানে তোমরা তাঁকে কবর দিয়েছো সেখানে আমাকে নিয়ে যাও।’ সাহাবারা বেরিয়ে পড়লো এবং তারা রাসুলকে (ﷺ) অনুসরণ করলো। তিনি আরো একবার সেই বৃদ্ধার জানাজা আদায় করলেন এবং তিনি বলেন, ‘এই কবরগুলো অন্ধকার প্রকোষ্ঠ এবং আমার সালাতের দ্বারা সেগুলো আলোকিত হয়।’ এ ঘটনার সুন্দর শিক্ষাটি হল – মৃতের সাথে এমন আচরণ করা উচিত নয় যে সালাতুল জানাজার জন্য সে অতি নগণ্য।
বিশেষ করে এমন সময়ে যখন অনেক জানাজা থাকে, আপনি অসঙ্গতি দেখতে পাবেন। এমনকি আপনি যদি এই ধারণার বাইরেও চলে যান যে কেউ আপনার জানাজার যোগ্য নয়, শুধুমাত্র এই কারণে আপনি তার জানাজায় অংশগ্রহণ করবেন সে ইসলামে আপনার ভাই বা বোন। দ্বিতীয়ত আপনার নিজের ব্যক্তিগত উদ্দীপনা। দেখুন আমাদের দ্বীন কতটা সুন্দর এটা এমন কিছুকে উৎসাহিত করে যা আমাদের যেভাবেই হোক করা উচিত।
রাসুল (ﷺ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সালাতুল জানাজা পড়বে সে তার এই নেক আমলের জন্য এক ওহুদের পরিমাণ সওয়াব পাবে এবং যে জানাজার অনুসরণ করবে সে তার নেক আমলের জন্য দুটি ওহুদের পরিমাণ সওয়াব পাবে।’ যারা ওহুদ পাহাড় দেখেছেন, তারা জানেন এটি বিশাল একটি পাহাড়। তাই যদি আপনি মনে করেন যে মৃত ব্যক্তি অতি তুচ্ছ ও নগণ্য, তাহলে আপনার নিজের ব্যক্তিগত পুরস্কারের জন্য হলেও তার জানাজায় অংশগ্রহণ করুন।
তৃতীয়ত, ইবনে আব্বাসের (রা:) ছেলে যখন মারা যায় তিনি বললেন, ‘আমি কুরাইবকে বাইরে যেতে বলেছিলাম এবং জানাজার জন্য কে কে জড়ো হয়েছে তা দেখতে বলেছিলাম। কুরাইব ফিরে এসে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ অনেক লোক।’ আব্বাস (রা:) বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ আমি রাসুলকে (ﷺ) বলতে শুনেছি কোনো মুসলিম মারা গেলে, তার জানাজায় যদি এমন চল্লিশজন দাঁড়িয়ে যায় যারা আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করে না তবে মহান আল্লাহ তার (মৃতব্যক্তির) অনুকূলে তাদের প্রার্থনা কবূল করেন।’ [মুসলিম]
তাই আসুন আমরা বৃহৎ এবং আন্তরিক জানাজা পড়ার চেষ্টা করি কারণ কেউই তুচ্ছ নয়। আমাদের ধর্মে জানাজার নামাজ আদায়ের ব্যাপারে প্রচুর উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।এছাড়া আমাদের ভাই ও বোনদের বিদায় জানাতে তাদের জন্য আমরাও হতে পারি সুপারিশকারী। আল্লাহুম্মা আমীন!
জানাজার নামাজ (পর্ব : ২)
মূল: ড. ওমর সুলাইমান