আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করার নাম ই’তিকাফ। ই’তিকাফ অত্যন্ত ফযিলতপূর্ণ আমাল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
من اعتكف يوما ابتغاء وجه الله تعالى جعل الله بينه و بين النار ثلاث خنادق أبعد ما بين الخافقين.
“যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একদিন ই’তিকাফ করবে, আল্লাহ তায়ালা তার মাঝে এবং দোযখের মাঝে তিন খন্দকের দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন; যার দূরত্ব জমীন থেকে আসমান পর্যন্ত।
[শুআবুল ঈমান, বাইহাকী : ৩৯৬৫; আততারগীব ওয়াত তারহীব ২/৯৬]
ই’তিকাফ ৩ প্রকার :
১. ওয়াজিব : কোন ব্যক্তি যদি ই’তিকাফ করার মান্নত করে, তা হলে তার উপর ইতিকাফ করা ওয়াজিব।
২. সুন্নাত মুআক্কাদা কিফায়া : রমাযানের শেষ দশকে ই’তিকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদা কেফায়া। [ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/৩৮৯]
৩. মুস্তাহাব : উপরুক্ত দুটি ছাড়া আর সব ধরনের ইতিকাফ মুস্তাহাব।
মাসআলা : এমন মসজিদ যেখানে জামাআত অনুষ্ঠিত হয় এবং ইমাম মুয়াজ্জিন নির্ধারিত আছে; সেখানে রমাযানের শেষ দশকের পুরো সময় ই’তিকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদা। মহল্লাবাসীর এক বা একাধিক ব্যক্তি ই’তিকাফ করলে সবার পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে।
[আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী : ৮৬৫৭; আদ্দুররুল মুখতার ৩/৪২৯; তাতারখানিয়া ৩/৪৪২]
মাসআলা : ই’তিকাফের জন্য কাউকে পারশ্রমিক দিয়ে রাখার দ্বারা ই’তিকাফ আদায় হবে না; বরং এই লেনদেনের জন্য গুনাহগার হবে।
[আদ্দুররুল মুখতার ৯/৭৬; রাসাইলে ইবনে আবেদীন ১/১৫৭; আলমাউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ ১/২৯১]
মাসআলা : মান্নত ই’তিকাফের সময় হল ঠিক তা-ই, যা মান্নতকারী মান্নতের সময় নির্ধারণ করেছে।
মাসআলা : সুন্নাত ই’তিকাফ রমাযানের শেষ দশকের পুরো সময়।
[ ফাতাওয়া শামী ৩/৪৩০-৪৩১; আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৪৯৮; হিন্দিয়া ১/২১১]
মাসআলা : নফল ই’তিকাফের জন্য কোন নির্ধারিত সময় নেই। বছরের যেকোন সময় হতে পারে; যদিও তা এক মুহূর্তের জন্যেও হয়।
মাসআলা : মহিলারা ইতিকাফের জন্য তার নামাযের স্থানে অবস্থান করবে; মসজিদে নয়।
[ফাতাওয়া আলমগীরী ১/২১১; তাবয়ীনুল হাকাইক ২/২২৫; কাযীখান ১/২২১]
মাসআলা : বালিগ যেকোন পুরুষ, চাই সে তরুণ, যুবক বা বৃদ্ধ হোক; সবার জন্য ই’তিকাফ করা সুন্নত।
মাসআলা : ই’তিকাফের জন্য জুমুআর মসজিদ হওয়া জরুরী নয়। ইমাম-মুআযযিন নির্ধারিত যেকোনো মসজিদে ই’তিকাফ করা যেতে পারে।
মাসআলা : ই’তিকাফের জন্য সর্বোত্তম স্থান হল মক্কায় অবস্থানকারীর জন্য মসজিদে হারাম, মদীনায় অবস্থানকারীর জন্য মসজিদে নববী, কুদসে অবস্থানকারীর জন্য মসজিদে আকসা। এছাড়া অন্য সবার জন্য নিজ নিজ এলাকার মসজিদ। [বাদায়েউস সানায়ে ২/২৮০]
মাসআলা : ইতিকাফের জন্য জুমআ মসজিদ হওয়া জরুরী নয়।
যেসব কারণে ই’তিকাফ ভেঙ্গে যায়
১. কোন উযর ছাড়া মসজিদ থেকে বের হয়ে গেলে। [ফাতাওয়া আলমগীরী ১/২১২; কাযীখান ১/২২২]
২. মহিলার হায়েয ও নিফাস দেখা দিলে। [বাদায়েউস সানায়ে ২/২৮৭]
৩. স্ত্রী সহবাস ও যেকোন যৌন আচরণে লিপ্ত হলে। [ফাতাওয়া কাযীখান ১/২২২; হিন্দিয়া ১/২১৩; তাতারখানিয়া ৩/৪৪৭; আদ্দুররুল মুখতার ৩/৪৪২]
মাসআলা : স্বপ্নদোষের কারণে ই’তিকাফ ভঙ্গ হয় না।
যেসব কারণে মসজিদ থেকে বের হওয়ার অনুমতি রয়েছে
১. প্রাকৃতিক প্রয়োজনে : যেমন পেশাব, পায়খানা ও ফরয গোসল করার জন্য।
২. শরয়ী প্রয়োজনে : যেমন জুমুআর নামায আদায়ের জন্য। [ফাতাওয়া কাযীখান ১/২২২; হিন্দিয়া ১/২১৩; তাতারখানিয়া ৩/৪৪৭; আদ্দুররুল মুখতার ৩/৪৪২]
৩. জরুরী প্রয়োজনে : যেমন মসজিদ অবস্থান করার দ্বারা নিজের জীবনের হুমকি বা সামানপত্রের নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে।
মাসআলা : প্রাকৃতিক প্রয়োজনে যদি মসজিদ থেকে বের হয়, তা হলে প্রয়োজন পূরণের অতিরিক্ত সময় বাইরে কাটানো জায়িয নয়।
মাসআলা : যদি ই’তিকাফ এমন মসজিদে হয়, যেখানে জুমুআর নামায হয় না; তা হলে নিকটস্থ জুমুআর মসজিদে জুমুআর জন্য গমন করা জায়িয; বরং ওয়াজিব।
মাসআলা : কোন বিপদ বা দুর্ঘটনার কারণে যদি ই’তিকাফকারী মসজিদ ছাড়তে বাধ্য হয়; তা হলে বের হয়ে তৎক্ষণাত অন্য মসজিদে গিয়ে অবস্থান করবে। এতে তার ই’তিকাফ পূর্ণ হয়ে যাবে।
মাসআলা : ওয়াজ শোনার জন্য, কিংবা জানাযায় অংশ গ্রহণের জন্য মসজিদ থেকে বের হলে ই’তিকাফ ভেঙ্গে যাবে। যদিও এগুলো পুন্যের কাজ।
মাসআলা : ই’তিকাফকারীর জন্য মসজিদে খাবার-দাবার করা জায়িয। বরং খাবার-দাবারের জন্য বাড়িতে না-গিয়ে মসজিদে তা সম্পন্ন করা উত্তম।
মাসআলা : ব্যবসায়িক মালামাল মসজিদে না-এনে বেচাকেনা করার দ্বারা ইতিকাফ ভঙ্গ হবে না; তবে মাকরূহ হবে।
মাসআলা : যে ব্যক্তি নিজের জন্য কিংবা পারিবারিক জরুরী প্রয়োজন মেটানোর জন্য কোনো জিনিস বেচাকেনা করতে হয়; তা হলে তার এ বেচাকেনা মাকরূহ নয়। তবে বিক্রির পণ্য মসজিদে আনা জায়িয নয়। [আলমগীরী ১/২১৩; আদ্দুররুল মুখতার ৩/৪৪০]
ই’তিকাফের আদাবসমূহ
১. ভাল ছাড়া কোন মন্দ কথা বা অনর্থক কথা না-বলা।
২. কুরআন তেলাওয়াত করা, মাসনুন যিকির, দরূদ শরীফ পড়া। অথবা ধর্মীয় কিতাবপত্র অধ্যয়নে সময় কাটানো।
মাসআলা : চুপথাকাকে ইবাদত মনে করে চুপ করে থাকা মাকরূহ। [কাযীখান ১/২২২; আলমগীরী ১/২১৩]
মাসআলা : গোনাহ বা অহেতুক কথা থেকে বাঁচার জন্য চুপ থাকা মাকরূহ নয়।
মাসআলা : ই’তিকাফকারীগণ পরস্পর দীনি বিষয়ে আলোচনা করা, তা’লীম করা, একজন বয়ান করা এবং অন্যেরা শোনা জায়িয; বরং উত্তম কাজ।
মাসআলা : ই’তিকাফকারী মসজিদের যেকোন অংশে হাটাচলা করা বা অবস্থান করা জায়িয।