ইতিহাস ও সাহিত্যে লায়লা-মজনু
রোমান্টিক কোনো জুটির উদাহরণ দিতে গেলে সবার আগে আপনার কাদের কথা মনে পড়ে? পাশ্চাত্যে প্রবাদতুল্য রোমান্টিক জুটি হলো ‘রুমিও-জুলিয়েট’। উপমহাদেশ তথা প্রাচ্যে রোমান্টিক জুটির উদাহরণ দিতে গিয়ে বেশিরভাগ সময় ‘লায়লা-মজনু’র উদাহরণ দেয়া হয়।
ইংরেজ কবি লর্ড বায়রন ‘লায়লা-মজনু’ জুটিকে ‘The Romeo and Juliet of the East’ বা ‘প্রাচ্যের রুমিও-জুলিয়েট’ বলে অভিহিত করেছেন [Byron, The Giaour, a fragment of a Turkish tale, Page 61]। তবে, ‘লায়লা-মজনু’ শুধুমাত্র প্রাচ্যের সাহিত্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বিশ্ব সাহিত্যে এটা স্থান করে নিয়েছে।
Table of Contents
এক
কায়স ইবনে আল-মুলাওয়িহ আরবের সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটোবেলায় মক্তবে পড়তে গিয়ে এক মেয়ের প্রেমে পড়েন। মেয়ের নাম ছিলো ‘লায়লা’ (বাংলাতে লায়লী নামে পরিচিত)। বাল্য প্রেম বা প্রথম ভালোবাসা বেশিদিন স্থায়ী হবার কথা না। কিন্তু, কায়সের ক্ষেত্রে ঘটে ব্যতিক্রম। লায়লার প্রেমে তিনি এতোই বিভোর হোন যে, অন্য সবদিক থেকে তার মনোযোগ ভাটা পড়ে। তার চিন্তায়, কথাবার্তায় থাকতো শুধুই লায়লা।
তিনি তার প্রিয়তমাকে উৎসর্গ করে কবিতা রচনা করতেন, মানুষকে সেসব কবিতা শুনাতেন। লায়লার প্রতি তার প্রেম নিবেদন লায়লা গ্রহণ করেন। লায়লার প্রতি নিবেদিত কবিতা বাড়তেই থাকে।
এখানে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, কায়স ও লায়লার সময়কাল ছিলো তাবেয়ীদের সময়কাল। তখনো অনেক সাহাবী জীবিত ছিলেন। নবিজী (সা:) যেসব যুগকে ‘সর্বোত্তম যুগ’ কায়স ও লায়লা ছিলেন সেই যুগে। সমাজের বেশিরভাগ মানুষ যেখানে দ্বীনদার, সেখানে কায়সের লায়লার প্রতি এমন আসক্তি ছিলো সমাজের মানুষের চোখে বাড়াবাড়ি।
একজন মেয়ের জন্য এক যুবক এভাবে কবিতা আবৃত্তি করে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরবে, সেটা সে যুগে অনেকটা অকল্পনীয় ছিলো। নারী-পুরুষের সামাজিক সম্পর্কের বাইরে গিয়ে, সমাজবিরুদ্ধ এমন প্রেম নিবেদনকে কায়সের গোত্র বনু আমির ভালো চোখে দেখেনি। লায়লার প্রতি কায়েসের এমন ভালোবাসাকে বনু আমির গোত্র ‘পাগলামি’ বলে অভিহিত করে। সেজন্য তারা তাকে ডাকে ‘মাজনু’ বলে।
‘মাজনু’র দুটো সম্ভাব্য অর্থ হতে পারে। একটি হলো পাগল (অর্থাৎ, ‘মাজনুন লায়লা’ বা লায়লার জন্য পাগল)। আরেকটি হলো জ্বীনে ধরা (অর্থাৎ, কায়সের এমন কার্যকলাপ নিশ্চয়ই তাকে জ্বীনে ধরার ফলে হয়েছে)। সমাজের লোকেদের দেয়া উপাধি অনুযায়ী কায়স ইবনে আল-মুলাওয়িহ নিজ নামের চেয়ে ‘মজনু’ নামে খ্যাতি লাভ করেন।
তার পরিবারের বেশ সুনাম ছিলো, অর্থবিত্ত ছিলো। লায়লার পরিবার বিয়েতে রাজি হবার কথা। স্বাভাবিকভাবে প্রস্তাব দেয়া হলো লায়লার বাবার কাছে। তখন আশেপাশের মানুষ পাত্রীর বাবাকে শুনালো- “কার সাথে মেয়ের বিয়ে দেবেন? আপনি জানেন না, ও একটা পাগল? পাগলের সাথে মেয়ে বিয়ে দিলে লোকজন আপনাকে কী বলবে ভেবে দেখেছেন?”
ব্যাস, লায়লার বাবা বিয়েতে রাজি হলেন না। মেয়েকে বিয়ে দিলেন তায়েফের ওয়ারদ আস-সাখাফীর সাথে। স্বাভাবিক অবস্থায় যে প্রেমিক ‘পাগল’ উপাধি পায়, যখন তার প্রিয়তমার বিয়ে হবে, তখন তার কী অবস্থা হবে?
ইতিহাসের বেশিরভাগ বিখ্যাত প্রেম-কাহিনীর পরিণতি হলো বিরহ-বিচ্ছেদ। রোমিও-জুলিয়েট, দেবদাস-পারু বা শিরি-ফরহাদ; সবগুলোর মধ্যে ঐ বিরহের সুর। এমনকি মিথ্যা, বানোয়াট কাহিনী অবলম্বনে ইউসুফ-জুলেখার যে প্রেমকাহিনী (!) দেখানো হয়, সেখানেও বিরহের সুর ফুটে উঠে।
লায়লার বিয়ের পর মজনু পরিবার ছেড়ে চলে যান। ইতিমধ্যে তার মা-বাবা মারা যান, তবুও তিনি ফিরে আসেননি। লায়লার স্বামী মারা যাবার পর সবাই ভেবেছিলো এবার হয়তো তিনি ফিরে আসবেন। তাকে খবর দেয়া হলো। তিনি যখন ফিরে আসেন, তখন দেখা গেলো যে মজনুর বিরহে লায়লা মারা যান। মজনু চলে যান লায়লার কবরের পাশে। সেখানে গিয়ে একটি পাথরে তিন লাইনের একটি কবিতা লিখেন আর কাঁদতে থাকেন।
৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে মজনুর মৃতদেহ লায়লার কবরের পাশে পাওয়া যায়। তার কবিতাগুলোর আলাদা সংকলন আছে। সেটার নাম- ‘দীওয়ানু কাইস ইবনিল মুলাওয়িহ’।
লায়লা-মজনুর ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির সময়কাল ছিলো ইসলামের ইতিহাসেও এক মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি-কাল। ঠিক সেই সময়ে ঘটে ইসলামের ইতিহাসে লোমহর্ষক ঘটনা- কারবালায় হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু আনহু) –এর শাহাদাত, মক্কায় আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইরকে (রাদিয়াল্লাহু আনহু) শূলে চড়িয়ে হত্যা, মক্কা-মদীনায় ইয়াযিদ বাহিনীর গুলাবর্ষণ, ‘আল-হাররার’ যুদ্ধ।
দুই
একবার এক লোক কায়েসকে একটি কুকুরের সেবা করতে দেখে। লোকটি অবাক! একজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের যুবক একটি রাস্তার কুকুরকে আদর করবে? তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “ব্যাপার কী?” কায়েস বললেন, “আমি একদিন এই কুকুরকে লায়লার পাশে ঘুরতে দেখেছিলাম!”
কায়েসের আরেকটি কবিতায় তিনি বলেন-
“আমি এই শহরে হাঁটছি, যে শহরে লায়লা থাকতো
আমি শহরের দেয়ালে-দেয়ালে চুমো দিচ্ছি
এটা এজন্য নয় যে, শহরটাকে আমি ভালোবাসি
বরং, এটা এজন্য যে- এই শহরে লায়লা বাস করতো!”
সাহিত্যে লায়লা-মজনুকে জনপ্রিয় করেন পারস্যের কবি নিজামী গজনবী। আরবি, পারসিক, উর্দু এমনকি বাংলা সাহিত্যেও ‘লায়লা-মজনু’র কাহিনী নিয়ে অনেক কাব্য রচিত। মধ্যযুগের বাংলা কবি দৌলত উজির বাহরাম খান বাংলাভাষীদের কাছে লায়লা-মজনুর কাহিনী তুলে ধরেন। তার কাব্যের উৎস ছিলো পারস্যের কবি জামীর লায়লা-মজনু কাব্যের ভাবানুবাদ।
লায়লা-মজনু চরিত্রটি ঐতিহাসিক চরিত্র নাকি কল্পিত সাহিত্যিক চরিত্র এই নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন। প্রশ্নটি নতুন না, ইমাম আয-যাহাবীর (রাহি:) সময়েও প্রশ্নটি উঠতো। তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা’ –তে সাহাবী, তাবে’ঈ, ইমাম, কবি, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, খলিফাদের জীবনী তুলে ধরেন। এই বইটিকে ধরা হয় জীবনী-বিশ্বকোষ। ইমাম আয-যাহাবী সেই বইয়ে কায়স ইবনে আল-মুলাওয়িহ বা মজনুর জীবনীও লিখেন।
তিনি বলেন, “কেউ কেউ লায়লা-মজনুর ব্যাপারটি অস্বীকার করছে। এটা জোরপূর্বক অস্বীকারের নামান্তর। যে ব্যক্তি অজ্ঞ, সে জ্ঞানী ব্যক্তির বিপরীতে প্রমাণ নয়।…এই ঘটনায় যেমন অস্বীকার করার মতো বাড়াবাড়ি হয়, তেমনি তাতে চোখের অশ্রুও ঝরে।”
[সিয়ারু আ’লাম আন-নুবালা: ৪/৫]
তিন
নবিজীর (সা:) সময়ে মদীনাতেও একটি ট্র্যাজেডির ঘটনা পাওয়া যায়। তবে সেটা লায়লা-মজনুর মতো বিবাহ-পূর্ব বিচ্ছেদ ছিলো না, সেটা ছিলো বিবাহ-উত্তর বিচ্ছেদ। দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হবার পর ব্যক্তিগত সম্পর্কের মত পরিবর্তনের অধিকার।
মদীনার অলিতে-গলিতে এক যুবক ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। যেই তাঁকে এভাবে দেখছে তার মায়া লাগছে। মদীনার সমাজে একজন মেয়ের পেছনে কেউ এভাবে কেঁদে কেঁদে বেড়ায়?
তাঁর নাম মুগীস। রাসূলের (সা:) সাহাবী এবং একজন দাস। বারীরা নামের এক মেয়ের পিছু পিছু তিনি ঘুরছেন। বারীরা ছিলো তাঁর স্ত্রী। বারীরা মুগীসকে ছেড়ে চলে যান। কিন্তু, বারীরার চলে যাওয়া মুগীস মেনে নিতে পারেননি। বাচ্চা ছেলেদের মতো বারীরা পিছু পিছু ঘুরছেন। কান্না করতে করতে তাঁর দাড়ি পর্যন্ত ভিজে গেছে।
মুগীসকে এই অবস্থায় দেখে রাসূলেরও (সা:) মায়া হলো। মুগীসের আবেগটি তিনি অনুভব করলেন। তাঁর সাথে থাকা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে জিজ্ঞেস করলেন,
“ও আব্বাস! বারীরার প্রতি মুগীসের ভালোবাসা এবং মুগীসের প্রতি বারীরার অনাসক্তি দেখে তুমি কি আশ্চর্যান্বিত হওনা?”
মুগীসের কান্না দেখে রাসূলুল্লাহ (সা:) তাঁর পক্ষ নিয়ে বারীরার কাছে গেলেন। বারীরারকে গিয়ে বললেন, “তুমি যদি তাঁর কাছে আবার ফিরে যেতে!”
বারীরা ছিলেন বেশ বুদ্ধিমতী। তিনি রাসূলকে (সা:) জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি আমাকে আদেশ দিচ্ছেন?”
অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ (সা:) যদি তাঁকে নির্দেশ দেন, তাহলে তাঁর না মেনে উপায় নেই। নবীর নির্দেশ মানতেই হবে।
রাসূলুল্লাহ (সা:) তাঁর কথাটি পরিস্কার করেন। “না, আমি কেবল সুপারিশ করছি।”
বারীরা যখন বুঝলেন এটা রাসূলের (সা:) নির্দেশ না, তিনি চাইলে নিজের মতের উপর চলতে পারেন তখন বললেন, “আমি তাঁকে (মুগীসকে) আর চাই না।”
[সহীহ বুখারী: ৫২৮৩]
ইসলামের শাস্ত্রীয় বাউন্ডারির মধ্যে যদি কোনো বিরহ-ট্র্যাজেডির ঘটনা উল্লেখ করতে হয়, তাহলে বারীরা-মুগীসের (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) ঘটনাটি অন্যতম।
তবে, ‘True Love’ সংক্রান্ত উদাহরণ দিতে গিয়ে পূর্ববর্তী আলেমগণ লায়লা-মজনুর ‘শাস্ত্রীয় নিষিদ্ধ’ প্রেমেরও উদাহরণ দিয়েছেন। অনেকেই দাবি করে যে, সে আল্লাহকে ভালোবাসে, রাসূলকে (সা:) ভালোবাসে। কিন্তু, আল্লাহকে ভালোবাসা বা রাসূলকে (সা:) ভালোবাসা প্রকাশে কোনো আমল করা হয় না; শুধু মৌখিক দাবি করা হয়। এটা নিয়ে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতও আছে যে, মৌখিক দাবি করলেই হবে না।
একজন কবি লায়লা-মজনুর প্রেক্ষাপটেও শুধুমাত্র মৌখিক দাবির বিষয়টি তুলে ধরেন। কবিতাটির নজীবানুবাদ হলো:
“সবাই করছে এই দাবি- আমি প্রিয়জন লায়লার
লায়লা তাদের এই দাবিটাকে করেন অস্বীকার।”
[জোছনাফুল, পৃষ্ঠা ৫৩]
আমল না করে অর্থহীন ভালোবাসার দাবি করার উদাহরণ দিতে গিয়ে ইমামগণ লায়লা-মজনু সংক্রান্ত আরবি কবিতার এই পংক্তির উদ্ধৃতি দেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন- মোল্লা আলী কারী (রাহি:), ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহি:), ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রাহি:)
[শারহুশ শিফা লিল কাদি ইয়াদ: ২/৪৫, মাজমু আল-ফাতাওয়া: ৪/৭১]
শুধুমাত্র বিরহ, অভিমান আর বিচ্ছেদের কবিতা যেসব কবির সৃষ্টিকর্মের প্রধান উপাদান, তাদের মধ্যে একজন হলেন মীর্জা গালিব। তাকে ডাকা হয় ‘মুশকিল-পছন্দ’ কবি বলে। অভিমানের কবিতা কিভাবে একজন কবির মূল উপাদান হয় সেটা অনেকেই উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হোন। যার ফলে পাশ্চাত্যে তাকে ডাকা হয় ‘লাভ এঙ্গার পোয়েট’!
বিখ্যাত ভ্রমণকাহিনী লেখক ও কবিতাপ্রেমী বুলবুল সরওয়ার গালিবকে এভাবে মূল্যায়ন করাকে হাস্যকর বলে অভিহিত করেন।
বুলবুল সরওয়ারের অনূদিত মীর্জা গালিবের গজলের একটি উদ্ধৃতি দিলে বুঝতে সুবিধা হবে।
“আমি নই এই দিলের মালিক
লাশের সঙ্গে তাকে
কবর না দিয়ে, দিয়ে দাও তারে
আগেই দিয়েছি যাকে।”
[হৃদয়ে আমার মির্জা গালিব, পৃষ্ঠা ৪৯]
চার
যারা প্রেমে লিপ্ত বা মাত্র প্রেম থেকে নিজেকে মুক্ত করলো, তাদের দিকে আমি ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকাই না। বিবাহ-পূর্ব প্রেমের পথে কাউকে যেমন উৎসাহিত করতে পারি না, তেমনি যারা লিপ্ত হয়ে গেছেন তাদেরকে দূরে ঠেলে দিতে পারি না।
মানুষ যখন প্রেমে লিপ্ত থাকে, তখন অনেকটা ঘোরের মধ্যে থাকে। আশেপাশের সমাজকে সে অস্বীকার করতে চায়, সে শৃঙ্খল ভাঙ্গতে চায়, সে নিয়মের কোনো তোয়াক্কা করতে চায় না। সব কথা প্রকাশ করে বেড়ায় খুব কম, বাকিরা চেপে যায়। যারা শৃঙ্খল ভাঙ্গার কথা বলে বেড়ায়, সমাজের কাছে এখনো তারা ‘পাগল-মজনু’।
প্রেমোত্তর ট্রামার মধ্যে যারা থাকে, যাঁদের কোনো কিছুতে মন বসে না, স্মৃতি যাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায়; তারাও উপাধি পায় ‘দেবদাস বা মজনু’।
প্রেমাসক্ত বা প্রেমে ব্যর্থ মানুষগুলো আমাদের সমাজেরই একটি অংশ, আমাদের সমাজ ব্যবস্থারই একটি প্রতিচ্ছবি। সেকালে সমাজে একজন প্রেমিকের উদ্ভট আচরণ দেখে মানুষ অবাক হয়েছে। আর এখন প্রায় প্রতিটি পরিবারে একেকজন ‘লায়লা-মজনু’ আছে।
আমার একটি সৌভাগ্য যে, খুব পরিচিত বা মোটামুটি পরিচিত অনেকেই তাদের টপ মোস্ট সিক্রেট আমার সাথে শেয়ার করেন। প্রেমাসক্তরা মন খুলে কথা বলে, প্রেমে ব্যর্থরাও তাদের অনুতপ্ত হৃদয়ে অনুশোচনার পথ খোঁজার গল্প বলে। আমি কানপেতে তাদের কথা শুনি। তাদের ‘আমানত’ আমার কাছে তাদের চেয়েও বেশি সংরক্ষিত রাখার চেষ্টা করি।
তাদের কথা শুনতে শুনতে মনে পড়ে আইরিশ কবি অস্কার ওয়াইল্ডের কথা। তিনি বলেছিলেন, “Every saint has a past and every sinner has a future.”
আজ যে দরবেশ, তারও তো একটি অতীত ছিলো। আজকের যে পাপী, তারও তো একটি ভবিষ্যৎ আছে।
গতো কয়েক বছরে চোখের সামনে এমন কয়েকটি ঘটনা দেখেছি, যার ফলে এইসব প্রেমিকদের জন্য আমার মনে ঘৃণা জাগে না। তার কাজটাকে আমি পছন্দ করতে পারি না, কিন্তু তাকে আমি দূরে ঠেলে দিতে পারি না।
ভালোবাসায় খুবই সিনসিয়ার যারা (যেটাকে এখন কেউ কেউ ‘ট্রু লাভ’ বলছেন), এমন প্রেমিকের তরী ডুবানোর ঘটনা অনেকেই শুনেছেন। বিপরীতে আমিও এমন উদাহরণ দেখেছি, যারা কোনোরকমে ভালোবাসার এক সমুদ্র থেকে তীরে ফিরেছেন। তীরে ফিরে তারা যেভাবে মানিয়ে নিয়েছেন, যেভাবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছেন, সেটা বিস্ময়কর। সেই মুহূর্তে তারা যদি ভালো ‘গাইড’ পান, তাহলে সত্যিকারার্থে ইলম-আমলের সাগরে তরী ফেলেন। তাদের মধ্যে যে নিষ্ঠা দেখতে পাই, যে আন্তরিকতা দেখতে পাই, আমি মুগ্ধ না হয়ে পারি না। মন চায় তাদের মানসিক শান্তি যদি আমি চুরি করতে পারতাম!
ডুবতে থাকা মানুষ যেমন খড়কুটোর আশায় হাত বাড়ায়, আমার খুব ইচ্ছে হয় আমার হাতটা তাদের দিকে বাড়িয়ে দিই। ঘৃণাভরে তাদের আহ্বান আমি প্রত্যাখ্যান করতে পারি না। কারণ, নজরুল আমাকে শেখাচ্ছেন-
“কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি? হয়ত উহারই বুকে ভগবান্ জাগিছেন দিবা-রাতি!”