ইসলামি সঙ্গীত গান-গজল পরিবেশন ও শ্রবণ করার বিধান
নাশিদ তথা ইসলামি সঙ্গীত, গান-গজল ইত্যাদি চর্চা, পরিবেশন ও শ্রবণ করার বিধান: এ বিষয়ে বিজ্ঞ আলেমদের অভিমত
বর্তমান সময়ে নাশিদ বা ইসলামি সংগীত, ইসলামি গান, গজল ইত্যাদি যেন এক শ্রেণীর ইসলামপন্থী যুবকদের মন-মস্তিষ্কে গেঁথে গিয়েছে।
এগুলোর পেছনে তারা নেশার মত বুদ হয়ে থাকে। কথিত ইসলামি সঙ্গীত ও গান ছাড়া যেন তাদের জীবন শুষ্ক মরুভূমি। এই সুযোগে এটিকে রীতিমত একটি শিল্প বা প্রফেশন হিসেবে গ্রহণ করার হিড়িক পরিলক্ষিত হচ্ছে। গড়ে তোলা হচ্ছে নানা শিল্পীগোষ্ঠী। বিভিন্ন ইসলামী অনুষ্ঠান এমন কি ওয়াজ মাহফিল গুলোতেও আনা হচ্ছে ভাড়া করা কথিত নাশিদ শিল্পী। বর্তমানে নাশিদ এর ব্যান্ড দলের মাধ্যমে কনসার্ট পরিবেশিত হচ্ছে! ইউটিউবে এইসব গান-গজলের ভিউ সংখ্যা অকল্পনীয়।
যাহোক, এ পর্যায়ে এই সব নাশিদ বা ইসলামি সংগীত বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কি তা জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
প্রথমত বলব, একজন সচেতন ও কর্তব্য পরায়ন সচেতন মুমিনের জন্য এইসব কথিত সংগীত গজল ও নাশিদ থেকে দূরে থাকা কর্তব্য। কারণ এগুলো মূলত শিয়া, বিদআতি ও সুফিদের মাধ্যমে উৎপত্তি হয়েছে এবং কাল পরিক্রমায় বর্তমান যুগে এই আধুনিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। ইসলামের প্রথম যুগে এগুলোর কোনও অস্তিত্ব ছিল না।
এগুলো শোনার নানা ক্ষতিকর দিক রয়েছে। যেমন:
কুরআন তেলাওয়াত বা শোনার প্রতি অন্তরে গাফিলতি বা অমনোযোগিতা সৃষ্টি হওয়া, দুআ এবং জিকির-আজকার পাঠে অলসতা সৃষ্টি হওয়া, দীনের ইলম চর্চায় অবহেলা করা ইত্যাদি।
এসব কথিত নাশিদ বা ইসলামি সংগীত চর্চা করা ও পরিবেশনার জন্য শিল্পী গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করা বা এ কাজকে প্রফেশন হিসেবে গ্রহণ করা এবং শোনার প্রতি নেশা সৃষ্টি হওয়া গর্হিত কাজ। বিশেষ করে যেগুলোতে নারী কণ্ঠ, বিভিন্ন মিউজিক্যাল বা সিনেমার গানের সুর নকল, শিরক-বিদআত, অতিরঞ্জন ও শরিয়তে বিকৃতি মূলক কথাবার্তা হয়েছে। সেই সাথে যদি তাতে বাদ্যযন্ত্রের সংযোগ ঘটে তাহলে তা হারাম হওয়ার দিকটি আরও জটিল হবে-তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বাস্তবতা হচ্ছে, এ নাশিদ শিল্পীদের মন-মস্তিষ্কে সার্বক্ষণিক সঙ্গীত, নাশিদ, গান, সূর, তাল, লয়, ভোকাল, গায়কি ইত্যাদি বিষয়গুলো ঘুরপাক খায়। তাদের চিন্তা জগতে যে বিষয়টা কাজ করে তা হলো, কিভাবে নাশিদ বা সঙ্গীত পরিবেশ করে মানুষের চিত্ত রঞ্জন করা যায়, গলার সুর দ্বারা কিভাবে শ্রোতা-দর্শককে মুগ্ধ করা যায়, কিভাবে আরও বেশি আকর্ষণ সৃষ্টি করা যায়, কিভাবে প্রশংসা ও বাহবা কুড়ানো যায়, কিভাবে আরও জনপ্রিয়তা অর্জন করা যায় ইত্যাদি।
আর যারা নাশিদের সুরকার বা সুর ডিজাইনার তারা সাধারণত: সুর সৃষ্টির জন্য হারমোনিয়াম, সারেগামা এবং বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সাহায্য নিয়ে থাকে। অন্যথায় আকর্ষণীয় সুর সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।
নাশিদ শোনার ব্যাপারে ইসলামি স্কলারদের অভিমত:
এসব নাশিদ বা ইসলামি গান-গজল শোনা যাবে কি না সে ব্যাপারে আলেমদের মাঝে দু ধরণের অভিমত পাওয়া যায়। কতিপয় আলেম কিছু শর্ত সাপেক্ষে সেগুলো শোনা যাবে বলে মতামত দিয়েছে। যেমন: যেসব সঙ্গীত বা নাশিদে চরিত্র গঠন, ভালো কাজে উৎসাহ প্রদান, মানব কল্যাণে উদ্দীপনা সৃষ্টি, তাওহিদ ও সন্নাহর দিকে আহ্বান, শিরক বিদআত ও অন্যায়-অপকর্মের বিরুদ্ধাচরণ, অন্যায়ের প্রতিবাদ, সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিকারী বা শিক্ষা মূলক ইসলামি কথাবার্তা আছে। এগুলো যদি মিউজিক, দফ বা হারাম বিষয়াদি থেকে মুক্ত হয় তাহলে তা সীমিত পরিসরে কখনো শুনলে গুনাহ হবে না ইনশাআল্লাহ। তবে তাদের কথাবার্তা থেকে স্পষ্ট যে, এগুলো শোনা পছন্দনীয় কাজ নয়।
পক্ষান্তরে কোনও কোনও আলেম, এগুলোকে বিদআতি ও হিজবীদের আলামত হিসেবে উল্লেখ করে প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়েছেন।
অবশ্য কবিতা আবৃত্তি করা বা শোনা শরিয়তে অনুমোদিত। কবিতা ও নাশিদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
নাশিদ বা ইসলামি সঙ্গীত বিষয়ে আধুনিক বিশ্বের কয়েকজন ইসলামি স্কলারের মতামত তুলে ধরা হল:
১. যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা নাসিরুদ্দিন আলবানি রাহ. বলেন,
إذا كانت هذه الأناشيد ذات معانٍ إسلامية ، و ليس معها شيء من المعازف و آلات الطرب كالدفوف و الطبول و نحوِها ، فهذا أمرٌ لا بأس به ، و لكن لابد من بيان شرطٍ مهم لجوازها ، وهو أن تكون خالية من المخالفات الشرعية ؛ كالغلوّ ، و نَحوِه ، ثم شرط آخر ، و هو عدم اتخاذها دَيدَناً ، إذ ذلك يصرِفُ سامعيها عن قراءة القرآن الذي وَرَدَ الحضُّ عليه في السُنَّة النبوية المطهرة ، و كذلك يصرِفُهُم عن طلب العلم النافع ، و الدعوة إلى الله سبحانه ) [العدد الثاني من مجلة الأصالة ، الصادر بتاريخ 15 جمادى الآخرة 1413هـ ]
“যদি এই নাশিদগুলো ইসলামিক অর্থবোধক হয় এবং তাতে কোনও মিউজিক ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার-যেমন: দফ, তবলা/ড্রাম ইত্যাদি না থাকে তাহলে এতে সমস্যা নেই। তবে তা জায়েজ হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শর্ত অবশ্যই স্পষ্ট করা উচিত। তা হল, শরিয়ত বিরোধী বিষয়াদি থেকে মুক্ত হওয়া। যেমন: অতিরঞ্জন মূলক কথাবার্তা ইত্যাদি।
আরও আরেকটি শর্ত হল, তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকা যাবে না। কারণ শ্রোতাদেরকে এগুলো কুরআন তেলাওয়াত থেকে দূরে সরিয়ে দেয় অথচ কুরআন শোনাার প্রতি সুন্নতে নববীতে উৎসাহিত করা হয়েছে। অনুরূপভাবে তা তাদেরকে উপকারী জ্ঞান অন্বেষণ এবং আল্লাহর পথে দাওয়াত থেকেও দূরে সরিয়ে দেয়।” [আল আসালা ম্যাগাজিন, সংখ্যা ২, তারিখ: ১৫/৬/১৪১৩]
২. সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি ও বিশ্বনন্দিত ফকিহ আল্লামা আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ. বলেন,
الأناشيد الإسلامية تختلف فإذا كانت سليمة ليس فيها إلا الدعوة إلى الخير والتذكير بالخير وطاعة الله ورسوله والدعوة إلى حماية الأوطان من كيد الأعداء والاستعداد للأعداء ونحو ذلك فليس فيها شيء ، أما إذا كانت فيها غير ذلك من دعوة إلى المعاصي واختلاط النساء بالرجال أو تكشف عندهم أو أي فساد فلا يجوز استماعها ) اهـ “مجموع فتاوى ومقالات متنوعة” (3/437) .
“ইসলামি নাশিদ বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। যদি সেগুলো দোষমুক্ত হয়- যেগুলোতে কল্যাণের পথে আহ্বান, ভালো কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য, শত্রুদের চক্রান্ত থেকে দেশ রক্ষা ও শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি গ্রহণের প্রতি উৎসাহ প্রদান ইত্যাদি ছাড়া অন্য কিছু না থাকে তাহলে তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু যদি তাতে এসব ছাড়া পাপাচারের দিকে আহ্বান, নারী-পুরুষ অবাধ মেলামেশা, পর্দা হীনতা অথবা কোনও ধরণের খারাপ বিষয় থাকে তাহলে সেগুলো শোনা জায়েজ নাই।” [মাজমু ফাতাওয়া ওয়া মাকালাত মুতানাওয়িয়াহ (ফতোয়া ও বিবিধ প্রবন্ধ সমগ্র) ৩/৪৩৭]
৩. বিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকিহ আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রাহ. বলেন,
ولا يمكن للإنسان أن يفتي بإنها جائزة على كل حال و لا بإنها ممنوعة على كل حال ، لكن إن خلت من الأمور التي أشرت إليها فهي جائزة ، أما إذا كانت مصحوبة بدُفٍ ، أو كانت مختاراً لها ذوو الأصوات الجميلة التي تَفتِن ، أو أُدِّيَت على نغمات الأغاني الهابطة ، فإنّه لايجوز الاستماع إليها
“কারও পক্ষে ফতোয়া দেওয়া সম্ভব নয় যে, এটি সর্বাবস্থায় জায়েজ অথবা সর্বাবস্থায় হারাম। তবে আমি যে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছি (দফ ব্যবহার, ফিতনা সৃষ্টি করে, ফিতনা সৃষ্টিকারী সুন্দর কণ্ঠস্বর, হারাম গানের সূর ইত্যাদি) যদি সেগুলো থেকে মুক্ত হয় তাহলে তা জায়েজ। কিন্তু যদি তাতে দফ বাজানো হয়, ফিতনা সৃষ্টিকারী সুন্দর কণ্ঠ নির্বাচন করা হয় অথবা নিকৃষ্ট গানের সূরে পরিবেশন করা হয় তাহলে সেগুলো শ্রবণ করা জায়েজ নাই।”
[আস সাহওয়াহতুল ইসলামিয়াহ (ইসলামিক জাগরণ), ১৬৮ পৃষ্ঠা]
৪. অপরপক্ষে বর্তমান সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকিহ এবং সৌদি আরবের সিনিয়র স্কলার্স বোর্ডের সদস্য শাইখ ফাওযান (হাফিজাহুল্লাহ) নাশিদের ব্যাপারে বলেন,
ما في الإسلام أناشيد, هذا اسم مُحدَث, والأناشيد الغالب عليها إما أن تكون للصوفية لأنهم يتعبدون بالأناشيد وإما أن تكون للحزبيين الذين لهم مناهج خاصة ويشجعون أتباعهم بهذه الأناشيد على متابعتهم, فهي شعار إما للصوفية وإما للحزبيين
“ইসলামে নাশিদ বলে কিছু নেই। এটি একটি বিদআতি নাম। প্রধানত নাশিদ সুফিদের। কারণ তারা নাশিদ দ্বারা ইবাদত করে অথবা হিজবিদের (দল পন্থীদের)- যাদের বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। তারা এ নাশিদগুলোর মাধ্যমে তাদের অনুসারীদেরকে তাদের অনুসরণ করতে উত্সাহিত করে।
সুতরাং তা হয় সুফিদের অথবা হিজবিদের আলামত।” [ar.alnahj-শাইখের ভয়েস রেকর্ড থেকে অনুদিত]
আল্লাহু আলাম।