ইসলামের দৃষ্টিতে স্ত্রীর জন্য কি শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করা বাধ্যতামূলক

ইসলামের দৃষ্টিতে শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামীর পরিবারের সেবার বিধান এবং সকল পরিবারের প্রতি বিশেষ বার্তা।
ইসলামের দৃষ্টিতে স্ত্রী তার স্বামীর মা, বাবা, ভাই-বোন ইত্যাদির কারও সেবা করতে বাধ্য নয়। তবে শ্বশুর-শাশুড়ি এবং তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সেবা করা একদিকে যেমন স্বামীর প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ অন্যদিকে নেকির কাজ তাতে কোন সন্দেহ নাই। কোন স্ত্রী যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তার শ্বশুর-শাশুড়ি বা তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের খেদমত করে তবে আল্লাহ তাকে আখিরাতে পুরষ্কার প্রদান করবেন ইনশাআল্লাহ। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে যে যত বেশি মানুষের উপকার করবে সে তত বেশি উত্তম। বিশেষ করে যখন রোগ-ব্যাধি, শারীরিক অক্ষমতা, বয়োঃবৃদ্ধ হওয়া ইত্যাদি কারণে শশুর-শাশুড়ির প্রতি যত্ন নেওয়ার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন কারণে মানুষ একে অন্যের সেবা বা সহযোগিতার মুখাপেক্ষী হয়।

এক্ষেত্রে স্বামীদেরও উচিত,‌ আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় তার শ্বশুর-শাশুড়িদের প্রতি যথাসম্ভব সুদৃষ্টি রাখা এবং প্রয়োজন দেখা দিলে যথাসম্ভব তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করা। এতে তিনিও আল্লাহর কাছে পুরস্কৃত হবেন ইনশাআল্লাহ।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,

أَحَبُّ النَّاسِ إِلَى اللهِ تَعَالَى أَنْفَعُهُمْ لِلنَّاسِ وَأَحَبُّ الأَعْمَالِ إِلَى اللهِ تَعَالَى سُرُورٌ تُدْخِلُهُ عَلَى مُسْلِمٍ أَوْ تَكَشِفُ عَنْهُ كُرْبَةً أَوْ تَقْضِي عَنْهُ دَيْنًا أَوْ تَطْرُدُ عَنْهُ جُوعًا, وَلأَنْ أَمْشِيَ مَعَ أَخِ فِي حَاجَةٍ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَنْ أَعْتَكِفَ فِي هٰذَا الْمَسْجِدِ – يَعْنِي مَسْجِدَ الْمَدِينَةِ – شَهْرًا وَمَنَ كَفَّ غَضَبَهُ سَتَرَ اللهُ عَوْرَتَهُ وَمَنْ كَظَمَ غَيْظَهُ وَلَوْ شَاءَ أَنْ يُمْضِيَهُ أَمْضَاهُ مَلأَ اللهُ قَلْبَهُ رَجَاءً يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَمَنْ مَشَى مَعَ أَخِيهِ فِي حَاجَةٍ حَتّٰـى يُثْبِتَهَا لَهُ أَثْبَتَ اللهُ قَدَمَهُ يَوْمَ تَزُولُ الأَقْدَامِ وَإِنَّ سُوَّء الْخُلُقِ لَيُفْسِدُ الْعَمَلَ كَمَا يُفْسِدُ الْخَلّ الْعَسَل
“আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় মানুষ হল সে ব্যক্তি যে মানুষের সবচেয়ে বেশি উপকার করে। আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল হল, একজন মুসলিমের অন্তরে আনন্দ প্রবেশ করানো অথবা তার দুখ-কষ্ট লাঘব করা, অথবা তার পক্ষ থেকে তার ঋণ পরিশোধ করা ও তার ক্ষুধা নিবারণ করা।

আর আমার এই মসজিদে (মদিনার মসজিদে নববীতে) একমাস ব্যাপী ইতিকাফ করার থেকে আমার একজন ভাইয়ের কোনও প্রয়োজন মেটানোর জন্য তার সাথে গমন করা আমার নিকট অধিক পছন্দনীয়। যে ব্যক্তি তার ক্রোধ সংবরণ করবে আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটি গোপন করবেন। যে ব্যক্তি ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করবে অথচ সে ইচ্ছা করলে তা প্রয়োগ করতে পারত, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার অন্তরকে সন্তুষ্ট করবেন। যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য তার সাথে গমন করবে এবং তা পূরণ করে দেবে, আল্লাহ সেদিন তার পদযুগলকে সুদৃঢ় রাখবেন, যে দিন মানুষের পাগুলো পিছলে যাবে। আর মন্দ চরিত্র আমলকে নষ্ট করে যেমন সিরকা (ভিনেগার) মধুকে নষ্ট করে দেয়।” [সহিহ তারগিব, হা/২০৯০, সিলসিলা সহীহা, হা/৯০৬, সহীহুল জামে, হা/১৭৬]

আমাদের সমাজে শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করাকে একজন নারীর প্রশংসনীয় দিক বিবেচনা করা হয়। তাই সামাজিক এই সুন্দর রীতিটি বজায় রাখার ব্যাপারে আমাদের সচেষ্ট হওয়া উচিৎ।

তাছাড়া এটাও মনে রাখা দরকার যে, একজন মহিলার জীবনেও একদিন এমন সময় আসতে পারে যখন তার পুত্রবধূর সেবার প্রয়োজন দেখা দিবে। তাই সে যদি এখন সন্তুষ্ট চিত্তে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তার শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করে তবে সে যখন শাশুড়ি হবে তখন আশা করা যায়, তার পুত্রবধূরা তার সেবা করবে।

সৌদি আরবের ফতোয়া বোর্ডকে শাশুড়িকে সহায়তা করার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তারা বলেন,

ليس في الشرع ما يدل على إلزام الزوجة أن تساعد أم الزوج ، إلا في حدود المعروف ، وقدر الطاقة ؛ إحساناً لعشرة زوجها ، وبرّاً بما يجب عليه بره
“শরিয়তে এমন কিছু নেই যা নির্দেশ করে যে, স্ত্রী স্বামীর মাকে সাহায্য করতে বাধ্য। তবে স্বামীর প্রতি ইহসান এবং তার প্রতি অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্যপরায়ণতার স্বার্থে যতটুকু সামাজিকতার সীমার মধ্যে পড়ে সেটা ভিন্ন কথা।”
[ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ, ১৯/২৬৪ ও ২৬৫]

আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রাহ. কে প্রশ্ন করা হয়, স্ত্রীর উপর কি স্বামীর মা’র কোনও হক আছে?

তিনি উত্তরে বলেন,

لا ، أم الزوج ليس لها حق واجب على الزوجة بالنسبة للخدمة ؛ لكن لها حق مِن المعروف ، والإحسان ، وهذا مما يجلب مودة الزوج لزوجته ، أن تراعي أمه في مصالحها ، وتخدمها في الأمر اليسير ، وأن تزورها من حين لآخر ، وأن تستشيرها في بعض الأمور ، وأما وجوب الخدمة : فلا تجب ؛ لأن المعاشرة بالمعروف تكون بين الزوج والزوجة .
“না, খেদমতের ব্যাপারে স্ত্রীর ওপর স্বামীর মায়ের কোনও হক নেই সামাজিকতা ও ইহসানের হক ছাড়া। এ জিনিসটা স্ত্রীর প্রতি স্বামীর প্রেম-ভালোবাসা সৃষ্টি যে, সে তার মায়ের প্রতি যত্ন নেয়, সাধারণ ছোটখাটো বিষয়ে সেবা করে, সময়ে সময়ে তার সাথে দেখা করে এবং তার বিভিন্ন বিষয়ে তার নিকট পরামর্শ নেয়। কিন্তু খেদমত আবশ্যক হওয়ার ব্যাপারে কথা হল, তা আবশ্যক নয়। কারণ সততা ও কল্যাণের সাথে দাম্পত্য জীবন হবে কেবল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে।”
[লিকাআতুল বাবিল মাফতুহ, পৃষ্ঠা নং ৬৮, প্রশ্ন নং ১৪]

আমাদের সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে পরিবারগুলোর প্রতি বিশেষ বার্তা

যদি পুত্রবধূ তার শ্বশুর-শাশুড়ির এতটুকু সেবা করে বা কোনোভাবে তার উপকার করে তাহলে তাদের কর্তব্য, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করা এবং তার কাজের মূল্যায়ন করা। স্বামীর কর্তব্য, স্ত্রীর এ কাজের জন্য কৃতজ্ঞতা আদায়ের পাশাপাশি তার প্রশংসা করা এবং তার প্রতি আরও বেশি আন্তরিকতা, যত্ন, সম্মান ও ভালোবাসা বৃদ্ধি করা। মাঝে মধ্যে এ জন্য তাকে আলাদা উপহার দেওয়াও ভালো। এতে সে খুশি হবে এবং আরও বেশি সেবা দিতে উৎসাহ বোধ হবে।

স্বামীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

مَنْ لَم يَشْكُرِ اَلناسَ لَمْ يَشْكُرِ اللهِ
“যে ব্যক্তি (উপকারী) মানুষের কৃতজ্ঞতা আদায় করল না, সে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করল না।”
[আহমদ, হ/১১২৮০, তিরমিযী ১৯৫৫-সহিহ]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

تَهَادُوا تَحَابُّوا
“তোমরা উপহার বিনিময় কর তাহলে তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হবে।’’
[বুখারীর আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/ ৫৯৪, সহীহুল জামে’, হা/ ৩০০৪]

কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজে শ্বশুর-শাশুড়ি সহ পরিবারের সকল সদস্যের প্রতি পুত্রবধূর পক্ষ থেকে সেবা পাওয়াকে ‘অধিকার’ মনে করা হয়। যার কারণে তার এহেন ত্যাগ ও সেবাকে যথার্থ মূল্যায়ন তো করা হয়ই না বরং তার কাজে সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে তার সাথে নানা অপমান সুলভ আচরণ করা হয়, তার প্রতি নানাভাবে জুলুম-অত্যাচার করা হয় ও কষ্ট দেওয়া হয়। যা সামাজিক ভাবে যেমন অমানবিক আচরণ তেমনি শরিয়তের দৃষ্টিতেও হারাম

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لَا يَظْلِمُهُ وَلَا يَخْذُلُهُ وَلَا يَحْقِرُهُ التَّقْوَى هَهُنَا» . وَيُشِير إِلَى صَدره ثَلَاث مرار بِحَسْبِ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ: دَمُهُ ومالهُ وَعرضه
“এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। কোনও মুসলিম অপর মুসলিমের ওপর অবিচার করবে না, তাকে অপদস্থ করবে না এবং অবজ্ঞা করবে না। আল্লাহ ভীতি এখানে! এ কথা বলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজের বুকের দিকে তিনবার ইঙ্গিত করে বললেন, একজন মানুষের জন্য এতটুকু অন্যায়ই যথেষ্ট যে, সে নিজের মুসলিম ভাইকে হেয় জ্ঞান করবে। এক মুসলিমের জন্য অপর মুসলিমের রক্ত, ধন-সম্পদ ও মান-সম্মান হারাম।” [সহিহ মুসলিম]

শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি অহংকার করা বা তাদের প্রতি কষ্ট দায়ক আচরণ করা হারাম:

এর বিপরীতেও আমাদের সমাজে আরেকটি কষ্ট দায়ক চিত্র দেখা যায়। তাহলো, কতিপয় মহিলা শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-যোগ্যতা, সৌন্দর্য বা বাবার বাড়ির অর্থ-সম্পদ বা বংশগত গৌরবের কারণে তার শ্বশুর-শাশুড়ি বা স্বামীর পরিবারকে অবজ্ঞা করে, তাদেরকে নানাভাবে অপমান সুলভ কথা বলে ও কষ্ট দেয়। এটিও হারাম

অনুরূপভাবে অনেক স্বামীও তার শশুর-শাশুড়ির সাথে অসদাচরণ করে বা তাদেরকে অপমান-অপদস্থ করে। এটিও হারাম।

সর্বাবস্থায় শ্বশুর-শাশুড়ি সম্মান ও শ্রদ্ধা পাওয়া হকদার। কেননা তারা বয়সে বড়। আর বয়োঃবৃদ্ধ, মুরুব্বি বা বড়দেরকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করা ইসলামি শিষ্টাচারের অন্তর্ভুক্ত। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

ﻟَﻴْﺲَ ﻣِﻨَّﺎ ﻣَﻦْ ﻟَﻢْ ﻳَﺮْﺣَﻢْ ﺻَﻐِﻴﺮَﻧَﺎ ﻭَﻳُﻮَﻗِّﺮْ ﻛَﺒِﻴﺮَﻧَﺎ
“যে ছোটদেরকে দয়া এবং বড়দেরকে শ্রদ্ধা করেনা সে আমাদের দলভুক্ত নয়।“
[তিরমিযী, সহিহুল জামে, হা/৫৪৪৫]

সুতরাং প্রতিটি মহিলার জন্য তার শ্বশুর-শাশুড়ি ও তার স্বামীর পরিবারের বড়দের প্রতি যথার্থ সম্মান-শ্রদ্ধা করা এবং ছোটদের প্রতি দয়া ও স্নেহশীল আচরণ করা আবশ্যক। কোন অবস্থায় কাউকে হেয় বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, অহংকার প্রদর্শন, অসম্মান জনক আচরণ করা বা কষ্ট দেওয়া জায়েজ নেই।

নারী-পুরুষ সকলের জন্য একই কথা প্রযোজ্য।

পুত্র সন্তানকে জীবিকা অর্জনের জন্য বাইরে থাকতে হয়। কন্যা সন্তানও বিয়ের পরে শ্বশুর বাড়ি চলে যায়। এ অবস্থায় পুত্রবধূও যদি শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখাশুনা না করে তাহলে বৃদ্ধ মানুষগুলোকে কে দেখাশুনা করবে?

আল্লাহ তাআলা পিতামাতার সেবা করাকে তার সন্তানদের জন্য অপরিহার্য করেছেন; পুত্রবধূর জন্য নয়। সুতরাং স্বামী পিতামাতার সেবা এবং তার জীবন-জীবিকার মধ্যে সমন্বয় সাধন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে যদি তিনি তার এ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে না পারেন তাহলে এ ক্ষেত্রে একজন ভালো মনের দ্বীনদার স্ত্রী তার স্বামীর অবস্থা বিবেচনা করে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এবং স্বামীকে সহায়তার স্বার্থে তার শ্বশুর-শাশুড়ির যথাসাধ্য সেবা দিবে। এতে আল্লাহ তাকে পুরস্কৃত করবেন ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক জ্ঞান ও বুঝ দান করুন এবং তাঁর নির্দেশিত পথে জীবন পরিচালনার তওফিক দান করুন।
আমিন।


Exit mobile version