ইসলামের দৃষ্টিতে মা দিবস
‘মা দিবস’ অর্থ: সারা দিন, দিনমান, অহোরাত্র। তাই মা দিবস অর্থ দাঁড়ায়, মার জন্য একটি পুরো দিন। অর্থাৎ বছরের এক দিন মায়ের জন্য নিবেদন করবেন। তাঁর সেবায় কাটাবেন। তাঁকে খুশী রাখবেন। সেই দিনটিতে তাঁর পাশে থাকবেন। বিভিন্ন কার্য-কলাপের মধ্য দিয়ে সেই দিনটি পালন করবেন। কিছু লোকের পরিভাষায় একেই বলা হচ্ছে মা দিবস।
মায়ের জন্য এমন একটি দিন আবিষ্কারের পিছনে কারণ কি?
তা খোঁজ করলে, জানা যায়, পৃথিবীতে মায়ের সন্তানাদি নাকি এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, তাদের হাতে মায়ের সেবা করার মত ও মায়ের পাশে থাকার মত কোন সময় নেই। অবশ্য অন্য কিছুর জন্য তাদের যথেষ্ট সময় থাকে! তাই প্রয়োজন হয়েছে একটি দিবসের। কারণ বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে একটি দিনও যদি মায়ের জন্য নির্দিষ্ট না করা যায় তো, লোকেরা কী বলবে?!
জগত কী ভাববে?!
মায়ের সম্মানের কী হবে?!
জননীর ঋণ শোধ হবে কী ভাবে?!
Table of Contents
মা দিবসের ইতিহাস
উইকিপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী‘একটি গোষ্ঠীর মতে এই দিনটির সূত্রপাত প্রাচীন গ্রীসের মাতৃ আরাধনার প্রথা থেকে। গ্রিক দেবতাদের মধ্যে এক বিশিষ্ট দেবী সবিলে-এর উদ্দেশ্যে পালন করা হত এই উৎসব। এশিয়া মাইনরে মহাবিষ্ণুব -এর সময়ে এবং তারপর রোমে আইডিস অফ মার্চ (১৫ই মার্চ) থেকে ১৮ই মার্চের মধ্যে এই উৎসবটি পালিত হত।
প্রাচীন রোমানদের ম্যাত্রোনালিয়া নামে দেবী জুনোর প্রতি উৎসর্গিত আরও একটি ছুটির দিন ছিল, সেদিন মায়েদের উপহার দেওয়া হত।
মাদারিং সানডের মতো ইউরোপ এবং যুক্তরাজ্যে দীর্ঘকাল ধরে বহু আচার-অনুষ্ঠান ছিল যেখানে মায়েদের এবং মাতৃত্বকে সম্মান জানানোর জন্য একটি নির্দিষ্ট রবিবারকে আলাদা করে রাখা হত। মাদারিং সানডের অনুষ্ঠান খ্রিষ্টানদের অ্যাংগ্লিকানসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পঞ্জিকার অঙ্গ। ক্যাথলিক পঞ্জিকা অনুযায়ী একটিকে বলা হয় লেতারে সানডে যা লেন্টের সময়ে চতুর্থ রবিবারে পালন করা হয় ভার্জিন মেরি বা কুমারী মাতার ও “প্রধান গির্জার” সম্মানে প্রথানুযায়ী দিনটিকে সূচিত করা হত প্রতীকী উপহার দেওয়া এবং কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রান্না আর ধোয়া-পোছার মত মেয়েদের কাজগুলো বাড়ির অন্য কেউ করার মাধ্যম।’
মা দিবস যাদের জন্য কান্না দিবস!
এই দিবসের পিছনে ইতিহাস যাই থাক না কেন এর অভ্যন্তরে একটি করুণ রহস্য লুকাইত আছে, যা অনেকে আঁচ করে না আর অনেকে ভ্রুক্ষেপ দেয় না। তা হল, এই দিনে মাতৃহীন এতিম ভাই-বোনদের অবস্থা। যাদের মা আছে তারা এই দিনে যখন নিজ মাকে খুশী করবে এবং নিজেও আনন্দে মেতে থেকে দিনটি উদযাপন করবে তখন এতিমদের মনে কত বড় ব্যথার সঞ্চার হবে?
মা হারানোর পুরোনো তিক্ত কষ্টকর অনুভূতি তাদের মনে কেমন প্রভাব ফেলবে?
তারা কি পালন করবে সে দিন?
প্রকৃতপক্ষে মাতৃহারারাই তো বেশী সহানুভূতির হকদার। তাই কল্পিত এই প্রথা যদিও এক দিকে ভাল মনে হয় কিন্তু অন্য দিকে তা দারুণ করুণও বটে। মা দিবস উদযাপনকারীরা যদি সত্যিকার অর্থে ন্যায়পরায়ণ হোন তবে সেই দিনেই প্রয়োজন আছে ‘অনাথ দিবস’ পালন করার। আজ মা দিবস আবিষ্কৃত হয়েছে বটে কিন্তু অনাথ দিবস আবিষ্কৃত হয় নি!
ইসলামের দৃষ্টিতে মা দিবস
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ইসলাম আত্মীয়তা সম্পর্ক বজায় রাখার আদেশ দেয়। তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং সম্পর্কচ্ছেদ থেকে সতর্ক করে। তবে সদ্ব্যবহারের শ্রেষ্ঠতা মায়ের জন্য নিবেদন করে, মাকেই বেশী হকদার মনে করে এবং পিতা-মাতা সহ সকল আত্মীয়ের সাথে ধারাবাহিক অবিচ্ছিন্ন সম্পর্কের আদেশ দেয়। তাই মায়ের সেবার জন্য কোন একদিন নির্দিষ্ট করা আর অন্য দিনে গুরুত্ব না দেয়া ইসলাম স্বীকার করে না। যেমন এটা মায়ের জন্য স্বীকার করে না। অনুরূপভাবে পিতা সহ অন্যান্য আত্মীয়দের সাথেও সমীচীন মনে করে না। আল্লাহ তাআলা বলেন:
و قضى ربّك ألا تعبدوا إلاّ إيّاه و بالوالدين إحسانا
“তোমার প্রতিপালক হুকুম জারি করেছেন যে, তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না, আর পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো।”1
তিনি আরও বলেন:
وَ وَصّيْنا الإنسانَ بوالديهِ حملته أمّه وهْناً على وهنٍ و فصاله في عامينِ أن اشكر لي ولوالديك إليّ المصير
“মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করে। তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে, (নির্দেশ দিচ্ছি) যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই কাছে।”2
মহান আল্লাহ আরও বলেন:
“ক্ষমতা পেলে সম্ভবত: তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে আর আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। এদের প্রতিই আল্লাহ অভিসম্পাত করেন, অতঃপর তাদের বধির করেন আর তাদের দৃষ্টি শক্তিকে করেন অন্ধ।”3
একদা এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করেন:
” من أحق الناس بحسن صحابتي؟ قال أمك، قال ثم من؟ قال: ثم أمك، قال: ثم من؟ قال: ثم أمك، قال: ثم من؟ قال ثم أبوك.”
“আমার ভাল ব্যবহারের সবচেয়ে বেশী হকদার কে? নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: তোমার মা। সে লোক বলল: তারপর? তিনি (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবার বললেন: তোমার মা। সেই লোক বলল: অতঃপর? নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তোমার মা। অতঃপর তোমার পিতা।”4
তিনি (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:
” لا يدخل الجنة قاطع” رواه البخاري
“আত্মীয়তা-সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।”5
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহ তায়ালা আত্মীয়তা-সম্পর্ককে সম্বোধন করে বলেন: “যে তোমাকে বহাল রাখে আমিও তার সাথে সম্পর্ক বহাল রাখব; আর যে তোমার হতে সম্পর্ক ছিন্ন করে, আমিও তার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করব এতে কি তুমি খুশী নও?
সে বলল, নিশ্চয়, হে আমার প্রভু। আল্লাহ বললেন, যাও, তোমার জন্য তাই করা হল।”6
উপরে বর্ণিত কুরআনের তিনটি আয়াত ও তিনটি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এবং তাঁর রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পিতা-মাতা উভয়ের সম্মান করা এবং তাঁরা দু জন সহ সকল আত্মীয়দের সাথে আত্মীয়তা-সম্পর্ক বজায় রাখা সর্বাবস্থায় জরুরী করেছেন এবং তা ছিন্ন করাকে বড় গুনাহ, আল্লাহর ক্রোধ তথা জাহান্নামে প্রবেশের কারণ করেছেন।
তাই বছরের ৩৬৪ দিনকে উপেক্ষা করে কেবল ১টি দিন মায়ের জন্য নির্ধারণ করা এবং পিতা সহ সকল আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক না রাখা বা অবহেলা করা এটা পাশ্চাত্যদের শোভা দেয় কোন মুসলিমকে নয়।
দিবসের পর দিবস, আর কত দিবস!
অন্ধ অনুকরণ একটি এমন বিষয়, যেখানে দলিল-প্রমাণ অচল হয়ে যায়, সত্য গ্রহণ করা ও সত্যের সন্ধান করার ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়ে যায়, কারণ সে অন্তরে তালা বদ্ধ করে রাখে। এটি একটি এমন কুঅভ্যাস, যা থেকে আমাদের নবী (সা:) আমাদের সতর্ক করেছেন। বিশেষ করে ইহুদী ও খৃষ্টানদের অনুকরণ হতে সাবধান করেছেন। তাঁর সেই ভবিষ্যৎ বাণী সত্য হয়েছে। আমরা আজ কোন না কোন রূপে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছি, বিশেষ করে দিবস উদযাপনের ক্ষেত্রে। তারা মা দিবস পালন করে তাই আমরাও অনেকে এটা পালন করি। তারা বাবা দিবস পালন করে তাই আমরাও অনেকে তা পালন করি। ভাই দিবস পালন করে তাই আমরাও অনেকে পালন করি। বোন দিবস আবিষ্কার করেছে তাই আমরাও মানি। জন্ম দিবস পালন করে তাই আমরাও সানন্দে জন্ম দিবস পালন করি।
ভ্যালেন্টাইন ডে পালন করে তাই অনেকে তা পালন করি। জানি না, ভবিষ্যতে যখন কেউ আঙ্কেল দিবস, আন্টি দিবস, হাজবেন্ড দিবস, ওয়াইফ দিবস, সান দিবস, ডটার দিবস, গ্র্যান্ড ফাদার দিবস, গ্র্যান্ড মাদার দিবস, ফাদার ইন্ ল দিবস, মাদার ইন্ ল দিবস ইত্যাদি আবিষ্কার করবে, তখন হয়ত: সে সব দিবসও আমরা পালন করতে শুরু করবো। অতঃপর বছরের কোন একটি দিন দিবস ব্যতীত বাকি থাকবে না! তাই বলছিলাম আর কত দিবস!
নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
لتتبعنّ سنن من كان قبلكم حذو القذة بالقذة حتى لو دخلوا جحر ضب لدخلتموه، قالوا يا رسول الله اليهود والنصارى؟ قال: فمن?
“তোমরা তোমাদের পূর্বের লোকদের প্রথা ধাপে ধাপে পূর্ণরূপে অনুসরণ করবে। এমনকি তারা যদি শাণ্ডার গর্তে প্রবেশ করে তো তোমরাও তাতে প্রবেশ করবে। সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসূল, তারা কি ইহুদী-খৃষ্টান? নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: তারা ছাড়া আবার কারা?7
আমার মা আমার ভালবাসা:
আমরা যদি খেয়াল করি দেখব, ম ধ্বনীটি সবচেয়ে সহজ। হয়তবা এই কারণে পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষায় মা অর্থবোধক শব্দে ম অক্ষরটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কারণ, মানুষ তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে সবচেয়ে সহজ ভাষায় ডাকতে পছন্দ করে।
তাই এবার দেখব বিভিন্ন ভাষায় ‘মা’ কে কি বলে। এটি একটি এমন শব্দ, যা বিশ্বের যতগুলি প্রসিদ্ধ জীবন্ত ভাষা রয়েছে প্রায় সব ভাষায়‘মা’ শব্দটির সাথে ‘ম’ অক্ষরটি বা‘ম’ এর ধ্বনি লক্ষ্য করা যায়। আমি কোন ভাষাবিদ নই। আর এটা স্বীকার করতে আমার কোন দ্বিধা নেই। তবে কয়েকটি ভাষার অভিধান ও কিছু ওয়েবসাইট থেকে যা অবগত হলাম তারই কিছু বর্ণনা করার চেষ্টা করছি মাত্র।
- ইংরেজি ভাষায় বাংলা ‘মা’ এর শব্দ হল, মাদার। দেখা যাচ্ছে, ‘ম’ রয়েছে।
- আরবী ভাষায় ‘মা’ এর শব্দ হল,‘উম্ম ‘ । দেখা যাচ্ছে, ম আছে।
- উর্দু ভাষায় ‘মা’ এর শব্দ হল, ‘ মাঁ ’। ম আছে।
- সংস্কৃত এবং হিন্দি ভাষায় ‘মা’ এর শব্দ হল, ‘ মাতা ’। ম আছে।
- রাশিয়ান ভাষায় বলা হয়, ‘মাতি ’। ম রয়েছে।
- গ্রীক ভাষায় বলা হয়, ‘মাতা’। ম আছে।
- হলেন্ডী ভাষায় বলা হয়, ‘মড্যের’। ম আছে।
- ফ্রান্সী ভাষায় বলা হয়, ‘ম্যারে’। ম আছে।
- জার্মানি ভাষায় বলা হয়, ‘মুতার’। ম আছে।
- ফার্সি ভাষায় বলা হয়, ‘ মাদার ’। ম আছে।
- ল্যাটিন ভাষায় বলা হয়, ‘ম্যটার’। ম আছে।
- রোমানিয়ায় বলা হয়, ‘মামা’। ম আছে।
- ইস্পেনিস ভাষায় বলা হয়, ‘মাদ্র্’। ম আছে।
- ইতালি ভাষায় বলা হয়, ‘ম্যড্র’। এখানেও ম আছে।
তবে কিছু ভাষা এমনও রয়েছে যেখানে ‘ম’ নেই কিন্তু এসব ভাষার সংখ্যা খুবই কম। যেমন ফিলিপিনো ভাষায় মাকে বলা হয়, ‘নানায়’ এবং তুর্কী ভাষায় বলা হয়, ‘এন্নে’। যেখানে ম নেই।
এছাড়া আমাদের সমাজে মাকে আরও বলা হয়, আম্মা জান, মাম্মী বা মোম। এখানেও দেখা যাচ্ছে ‘ম’ আছে।
সুতরাং এত প্রিয় ব্যক্তিত্বের ভালবাসাকে যেন আমরা একটি দিনের সীমাবদ্ধ করে না ফেলি। মা শব্দটি যেমন অতি প্রিয় শব্দ তেমনি যেন তা আমাদের কাজের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়। কৃত্রিমতা নয়; ভালবাসতে হবে হৃদয়ের একান্ত গহীন থেকে। ভালবাসতে হবে একদিনে জন্য নয়: বরং প্রতিদিন ও সার্বক্ষণিক ভাবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
লেখক: আব্দুর রাকীব (মাদানী)
- সূরা ইসরা/২৩ ↩︎
- সূরা লোকমান/১৪ ↩︎
- সূরা মুহাম্মদ/২২-২৩ ↩︎
- বুখারী, অধ্যায়,আ্দব,নং৫৯৭১ ↩︎
- বুখারী, অধ্যায়, আদব,নং ৫৯৮৪ ↩︎
- বুখারী, অধ্যায়,আদব,নং ৫৯৮৭ ↩︎
- বুখারী,নং ৩২৬৯,৬৮৮৯ মুসলিম, নং ২৬৬৯ ↩︎