ইসলামে ঘোড়ার মাংস খাওয়ার বিধান

আলহামদুলিল্লাহ। অধিকাংশ ইসলামি বিদ্বান ঘোড়ার মাংস খাওয়াকে বৈধ বলেছেন। কারণ এ বিষয়ে সহিহ হাদিস রয়েছে।
হাদিসের দলিল:
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত:

نَهَى رَسولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ يَومَ خَيْبَرَ عن لُحُومِ الحُمُرِ الأهْلِيَّةِ، ورَخَّصَ في الخَيْلِ
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাইবারের দিনে গৃহপালিত গাধার মাংস খেতে নিষেধ করেছেন এবং ঘোড়ার মাংস খাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন।”
[সহিহ বুখারি (৩৯৮২), সহিহ মুসলিম (১৯৪১)]

আসমা বিনতে আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন:

نحَرْنا على عهد النبي صلى الله عليه وسلم فرساً فأكلناه
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে আমরা একটি ঘোড়া জবাই করে খেয়েছিলাম।”
[সহিহ বুখারি (৫১৯১), সহিহ মুসলিম (১৯৪২)]

জাবির (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত:

سافرنا مع رسول الله صلى الله عليه وسلم وكنا نأكل لحم الخيل ونشرب ألبانها
“আমরা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সঙ্গে সফর করছিলাম এবং ঘোড়ার মাংস খেয়েছি ও এর দুধ পান করেছি।”
[দারকুতনি, বায়হাকি – ইমাম নববী বলেছেন: এটি সহিহ সনদ বিশিষ্ট]

বিরোধী মতামত

কিছু বিদ্বান—যেমন ইমাম আবু হানিফা ও তাঁর দুই শিষ্য—ঘোড়ার মাংস খাওয়াকে মাকরুহ বলেছেন এবং তারা একটি আয়াত ও একটি হাদিস দ্বারা প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন।
আয়াতের দলিল:

الْخَيْلَ وَالْبِغَالَ وَالْحَمِيرَ لِتَرْكَبُوهَا وَزِينَةً
"আর তিনি সৃষ্টি করেছেন ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা যাতে তোমরা এগুলোর উপর সওয়ার হতে পারো এবং এগুলো তোমাদের জন্য শোভাস্বরূপ।"
[সূরা আন-নাহল: ৮]

তারা বলেন, এখানে ঘোড়া, খচ্চর ও গাধাকে কেবল বাহনের জন্য উল্লেখ করা হয়েছে, খাদ্য হিসেবে নয়। অথচ এর আগের আয়াতে চতুষ্পদ জন্তুর (গরু, উট, ছাগল) মাংস খাওয়ার কথা বলা হয়েছে।

এর জবাব:

ইসলামি স্কলাররা বলেন, এই আয়াতে বাহনের বিষয়টি মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়ায় তা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মানে এই নয় যে, এগুলোর অন্য কোনো উপকারিতা নেই। যেমন: আল্লাহ বলেছেন:

حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيرِ
"তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত প্রাণী, রক্ত, শুকরের মাংস।"
[সূরা মায়েদা: ৩]

এখানে কেবল মাংসের কথা বলা হলেও, সবাই একমত যে শুকরের চর্বি, রক্ত ও অন্যান্য অংশও হারাম

হাদিসের দলিল: খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত:

نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن لحوم الخيل والبغال والحمير وكل ذي ناب من السباع
“রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোড়া, খচ্চর, গাধা ও হিংস্র দাঁতওয়ালা প্রাণীর মাংস খেতে নিষেধ করেছেন।” [আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ]

এর জবাব: এই হাদিসটি দুর্বল।
শাইখ আলবানি জইফ আবু দাউদে এটিকে জয়িফ বলেছেন।
বিশিষ্ট মুহাদ্দিস হাফিজ মুসা ইবনে হারুন (মৃত্যু: ২৯৪ হিজরি) বলেছেন: “এই হাদিসটি দুর্বল।”
ইমাম বুখারি বলেছেন: “এই হাদিসটি সন্দেহযুক্ত।”
ইমাম বায়হাকি বলেছেন: “এই হাদিসটির সনদ অসংগত এবং এটি বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনাকারীদের হাদিসের (যা ঘোড়ার মাংসের বৈধতার পক্ষে) বিপরীত।”
ইমাম খাত্তাবি বলেছেন: “এই হাদিসটির সনদে সন্দেহ রয়েছে।”
ইমাম আবু দাউদ বলেছেন: “এই হাদিসটি রহিত (মানসুখ)।”
ইমাম নাসাঈ বলেছেন: “ঘোড়ার মাংসের বৈধতার হাদিসই বেশি সহিহ।” তিনি আরও উল্লেখ করেছেন: “যদি নিষেধাজ্ঞার হাদিসটি সহিহ হয়, তবে এটি রহিত (নাসিখ) বলে মনে হয়। কারণ সহিহ হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোড়ার মাংস খাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। এটি সেই অনুমতিরই প্রমাণ।” (তথ্যসূত্র: আল মাজমু)
[islamqa থেকে অনুদিত]

আল্লামা আব্দুল আজিজ বিন বায রাহ.-এর ফতোয়া:

শাইখকে প্রশ্ন করা হয়:

আমাদের অঞ্চলের একটি গ্রামে লোকজন একটি ঘোড়া জবাই করে তার মাংস মানুষের মাঝে বিতরণ করে এই দাবিতে যে, এটি ইসলামে বৈধ। এটি কি সত্য?
উত্তরে তিনি বলেন:
উত্তরে তিনি বলেন:

: نعم، لحم الخيل مباح هذا الذي عليه جمهور أهل العلم وهو الصحيح، والرسول ﷺ أذن في لحوم الخيل، وروت أسماء بنت أبي بكر رضي الله عنهما: أنهم نحروا فرسًا على عهد النبي ﷺ في المدينة وأكلوها، فالمقصود: أن لحوم الخيل مباح، هذا هو الصواب الذي عليه جمهور أهل العلم

“হ্যাঁ, ঘোড়ার মাংস খাওয়া ইসলামে বৈধ। এ বিষয়ে অধিকাংশ ইসলামি স্কলারের ঐকমত্য রয়েছে। এই মতটাই সঠিক। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোড়ার মাংস খাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। আসমা বিনতে আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) বর্ণনা করেছেন যে, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে আমরা মদিনায় একটি ঘোড়া জবাই করেছিলাম এবং তা খেয়েছিলাম।” [সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম]

প্রশ্নকারী: আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন। এটি কি উটের মতো জবাই করতে হয় নাকি গরুর মতো জবাই করতে হয়?

উত্তর:
تذبح كالبقر، بخلاف البغال والحمير لا، البغال والحمير هذه محرمة الحمر الأهلية المعروفة هذه محرمة، أما الخيل فإنها مباحة، الرسول ﷺ نهى عن الحمر والبغال وأذن في لحوم الخيل.

“ঘোড়া গরুর মতো জবাই করতে হয়। তবে খচ্চর ও গৃহপালিত গাধার মাংস খাওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গৃহপালিত গাধা ও খচ্চরের মাংস খেতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু ঘোড়ার মাংসের ক্ষেত্রে অনুমতি দিয়েছেন।”

ঘোড়ার মাংস খাওয়া হালাল। তবে জিহাদের প্রয়োজন হলে জবাই করা উচিত নয়

শাইখক এ বিষয়ে আরেকটি প্রশ্নের উত্তরে বলেন,

الخيل مباحة قد أذن فيها النبي ﷺ، ورخص في لحم الخيل، وقالت أسماء بنت أبي بكر رضي الله تعالى عنهما: نحرنا على عهد النبي ﷺ فرساً، فأكلناه ونحن في المدينة رواه الشيخان في الصحيحين.

فالخيل مباحة، لكن إذا احتيج إليها في الجهاد لا تذبح .. لا تنحر، وإذا لم يحتج إليها وذبحت فهي حلال كالضباء وكالوعل، وكالأرنب، وكغيرها من الصيود النافعة،

أما الحمر والبغال لا، ليست بحلال، محرمة، الحمر والبغال.. الحمر الأهلية والبغال المعروفة هذه محرمة لا يجوز أكلها، أما الحمر الوحشية المعروفة هذه لا بأس بها، يسمونها الوضيحي فهذه مباحة، وهي حمر منقشة لها نقش عجيب، فليست مثل الحمر الأهلية بل لها شكل آخر، ولون آخر، وخلق آخر، فلا بأس بها، أما الحمر الأهلية فإنها تحرم، المعروفة اللي كان الناس يركبونها ويستعملونها في الحرث، والسني عليها، هذه معروفة، وقد ذبحها الناس يوم خيبر، فأنكر عليهم النبي ﷺ وأكفأ القدور، وبين تحريمها عليه الصلاة والسلام.

وهكذا البغال المعروفة لا يحل أكلها، ولكن تستعمل، تركب وتستعمل في

الحمل عليها كالحمير

“ হ্যাঁ, ঘোড়ার মাংস খাওয়া বৈধ। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটি খাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন এবং এটিকে হালাল ঘোষণা করেছেন।

আসমা বিনতে আবু বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে আমরা মদিনায় একটি ঘোড়া জবাই করে তা খেয়েছিলাম।” [সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম]

ঘোড়া হালাল। তবে যদি জিহাদের জন্য প্রয়োজন হয় তাহলে এটিকে জবাই করা উচিত নয়। যদি জিহাদের প্রয়োজন না থাকে তাহলে তা হরিণ, বন্য ছাগল (ঘুরাল), খরগোশ এবং অন্যান্য উপকারী শিকারযোগ্য প্রাণীর মতোই বৈধ।

গৃহপালিত গাধা ও খচ্চর গৃহপালিত গাধা এবং খচ্চরের মাংস খাওয়া হারাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাইবার যুদ্ধে গৃহপালিত গাধার মাংস খেতে নিষেধ করেন এবং রান্নার হাঁড়িগুলো উল্টে দেন। [সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম]

বন্য গাধা: (নীলগাভি/নীলগাই) বন্য গাধার মাংস খাওয়া বৈধ। এটি গৃহপালিত গাধার মতো নয় এবং এটিকে খাওয়া জায়েজ।

খচ্চরের মাংস খাওয়া হারাম হলেও এগুলো বাহন হিসেবে ব্যবহার করা এবং মাল বহনের কাজে লাগানো বৈধ যেমন গৃহপালিত গাধার ক্ষেত্রে হয়।”

সংক্ষিপ্ত কথা হলো, ঘোড়ার মাংস খাওয়া জায়েজ। হবে জিহাদের প্রয়োজন হলে, তা গণহারে খাওয়া উচিত নয়। হানাফি মাজহাবে তা মাকরুহ বলা হলেও এ মর্মে দলিল প্রমাণিত না হওয়ায় তা গ্রহনযোগ্য নয়।

Exit mobile version