পারিবারিক এরেঞ্জমেন্টে বিয়ের প্রস্তাবে পাত্রী যেমন ‘হ্যাঁ’ বলতে পারে, তেমনি পাত্রীর ‘না’ বলারও অধিকার আছে। পাত্র রাজি, পাত্রীর পরিবারও রাজি শুধু পাত্রী রাজি না। পাত্র হয়তো সুদ-ঘুষের সাথে সম্পৃক্ত পেশায় লিপ্ত, দ্বীন মানার ব্যাপারে কোনো আন্তরিক আগ্রহ নেই; এই ব্যাপারগুলো নিয়েও পাত্রীর পরিবারের মাথা ব্যথা নেই।
এক্ষেত্রে পাত্রীর ভোকাল হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। ‘আমি রাজি না’ এই কথাটি পাত্রীকে যেমন বলতে হবে, পাত্রীর অসম্মতি পরিবারকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
অনেক মেয়ে চায় ‘হুজুর পাত্র’ বিয়ে করতে। আবার অনেক মেয়ে ‘হুজুর পাত্র’ পছন্দ করে না। এসব ক্ষেত্রে পাত্রীর মেজাজ, রুচি বিবেচনা করতে হবে।
উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী। তাঁর দ্বীনদারিতা নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিলো না। তিনি যখন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর মেয়ে উম্মে কুলসুম রাহিমাহাল্লাহকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, উম্মে কুলসুম খলিফার প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। কারণ, তাঁর মতে উমর রা. যেমন রুক্ষ্ম লাইফ লিড করতেন সেটা তাঁর পছন্দ না। খলিফার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে কেউ তাঁকে ‘জোর’ করেনি।
ইসলামে বিয়ের সংস্কৃতির অন্যতম সৌন্দর্য হলো- ইসলাম পাত্র-পাত্রী দুজনের পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দেয়। লাভ ম্যারেজ, ডেটিং ছাড়াও যে পাত্র-পাত্রী নিজেদেরকে পছন্দ-অপছন্দের সুযোগ আছে, মুসলিম ইতিহাসে বিয়ের সংস্কৃতি দেখলে সেটা বুঝা যায়।
জাফর ইবনে আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুর বংশের এক মেয়ে আশঙ্কা করলেন যে, তাঁর পরিবার সম্মতি ছাড়া তাঁকে বিয়ে দিতে পারে। তাঁর পরিবার এমন একজন পাত্র নিয়ে আসতে পারে, যাকে তিনি পছন্দ করেন না। বিয়ের জন্য পরিবার তাঁকে চাপ প্রয়োগ করতে পারে। মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়ে করার জন্য তাঁকে বলা হতে পারে।
তিনি বুঝতে পারলেন, এমনটা হতে দেয়া যায় না। সারাজীবন একজন মানুষের সাথে সংসার করবেন। সেই মানুষটি যদি তাঁর অপছন্দের কেউ হয়, সেই মানুষের সাথে যদি জোর করেই বিয়ে দেয়া হয়, তিনি কি সুখী হতে পারবেন?
সারাজীবন যাতে আফসোস করতে না হয় সেজন্য মেয়েটি দুজন মুরব্বির সাথে কথা বলতে গেলেন। মুরব্বি দুজন ছিলেন আনসারি সাহাবী। তাঁদের নাম আব্দুর রহমান রাদিয়াল্লাহু আনহু ও মুজামমি রাদিয়াল্লাহু আনহু। মেয়েটি তাঁদের কাছে গিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
আমাদের সমাজে মুরব্বিরা এরকম ক্ষেত্রে সাধারণত বলেন, ‘মা রে, বাপ-মা যা বলে শুনে নাও। সারাজীবন তারা তোমার জন্য কতো কষ্ট করেছেন, নিজেরা না খেয়ে তোমাকে খাইয়েছেন, নিজেরা না পরে তোমাকে পরিয়েছেন। তাদের মুখের দিকে চেয়ে মেনে নাও। মেয়ে হয়ে জন্মেছো, এতোটুকু ছাড় তো দিতেই হবে।’
ঐ দুজন আনসারি মুরব্বি কী বলেন? তারাও কি আমাদের সমাজের মুরব্বিদের মতো কথা বলেন?
না। তারা দুজন মেয়েটির কথা শুনে তাঁকে আশ্বস্ত করলেন যে, এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। কেনো চিন্তা করতে হবে না সেটার একটি কারণও তারা বলেন।
‘তোমার ভয়ের কোনো কারণ নেই। কেননা খানসা বিনতে খিযাম রাদিয়াল্লাহু আনহাকে তাঁর পিতা তাঁর অসম্মতিতে বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই বিয়ে ভেঙে দেন।’ [সহিহ বুখারি: ৬৯৬৯]
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়ের ঘটনা। একজন মেয়েকে তাঁর বাবা নিজের ভাতিজার সাথে বিয়ে দেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, এতে করে তাঁর ভাতিজা দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার উন্নতি হবে। ফলে, মেয়েটির বিয়ে হলো তাঁর চাচাতো ভাইয়ের সাথে।
চাচাতো ভাইকে কি সে পছন্দ করত? মেয়েটি কি স্বামী হিসেবে তাঁর চাচাতো ভাইকে চিন্তা করত?
মেয়েটি সরাসরি চলে গেল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে। তাঁর কাছে গিয়ে নিজের অবস্থা খুলে বললো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মন দিয়ে তাঁর কথা শুনলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, বিয়ের সময় যথাযথভাবে মেয়ের মতামত নেয়া হয়নি।
তিনি বললেন যে, এটা এখন মেয়ের নিজের এখতিয়ার। মেয়েটি চাইলে বিয়ে বহাল রাখতে পারে, নতুবা বিয়ে ভেঙে ফেলতে পারে।
মেয়েটি বিয়ে বহাল রাখলো। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, বিয়ে যদি বহাল রাখতেই হয়, তাহলে এতোকিছু করার দরকার কী ছিল? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিজের বাবার ব্যাপারে অভিযোগ দেবার দরকার কী ছিল?
এর উত্তর মেয়েটি প্রদান করে। সে বললো, ‘আমার উদ্দেশ্য ছিল, মেয়েরা জেনে নিক যে, বিয়ের (সিদ্ধান্ত গ্রহণের) ব্যাপারে বাবাদের কোনো এখতিয়ার নেই।’ [সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৮৭৪]
বিয়ের ক্ষেত্রে একজন মেয়ের মতামত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মেয়ের অনুমতি না নিয়ে তাকে বিয়ে দেয়া যাবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে এটা সবাই জানতো। যারা জানতো না, তাদেরকে জানানো হতো।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
‘কুমারি নারী বিয়ে দেয়া যাবে না, যতোক্ষণ পর্যন্ত তার অনুমতি গ্রহণ করা হবে।’
[সহিহ বুখারি: ৬৯৬৮]