ঈসা (আঃ) মানবতার জন্য প্রেরিত পাঁচজন সর্বশ্রেষ্ঠ রসূলের মধ্যে একজন – যাদের সম্মিলিতভাবে উলুল আযম বলা হয়। তিনি ছিলেন আমাদের রাসুলের (ﷺ) পূর্বে সর্বশেষ রাসূল। ইমাম আস-সুয়ূতির মতে, তিনি সাহাবাদের মধ্যেও সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে পরিগণিত, কারণ তাকে জীবিত অবস্থায় তুলে নেওয়া হয়েছিল।
মি’রাজের রাতে যখন রাসুল (ﷺ) তার সাথে সাক্ষাৎ করেন, তখনও তিনি মারা যাননি। যে ব্যক্তি রাসুলের (ﷺ) সাথে সাক্ষাত করে, তাকে বিশ্বাস করে এবং সেই বিশ্বাস নিয়েই মৃত্যুবরণ করে তাকে সাহাবা বলে গণ্য করা হয়। ঈসার (আঃ) কাছ থেকে কী শিক্ষা নিতে পারি?
আসলে শত শত শিক্ষা আছে! এখানে আমরা দশটি উল্লেখ করবো ইনশাআল্লাহ।
লোকেরা যখন বিবাহ বহির্ভূত সন্তান ধারণ করার জন্য মরিয়মকে (আঃ) ধিক্কার দিয়েছিল (তারা জানত না যে এই শিশুটি অলৌকিক ছিল), তখন আল্লাহ ঈসাকে (আঃ) অলৌকিকতা দান করলেন এবং তিনি দোলনা থেকে কথা বললেন।
قَالَ إِنِّى عَبۡدُ ٱللَّهِ ءَاتَىٰنِىَ ٱلۡكِتَٰبَ وَجَعَلَنِى نَبِيًّا
শিশুটি বলল, ‘আমি তো আল্লাহর বান্দা; তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী বানিয়েছেন’।
[১৯:৩০]
وَجَعَلَنِى مُبَارَكًا أَيۡنَ مَا كُنتُ وَأَوۡصَٰنِى بِٱلصَّلَوٰةِ وَٱلزَّكَوٰةِ مَا دُمۡتُ حَيًّا
আর যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন এবং যতদিন আমি জীবিত থাকি তিনি আমাকে সালাত ও যাকাত আদায় করতে আদেশ করেছেন’।[১৯:৩১]
وَبَرًّۢا بِوَٰلِدَتِى وَلَمۡ يَجۡعَلۡنِى جَبَّارًا شَقِيًّا
আর আমাকে মায়ের প্রতি অনুগত করেছেন এবং তিনি আমাকে অহঙ্কারী, অবাধ্য করেননি’।
[১৯:৩২]
وَٱلسَّلَٰمُ عَلَىَّ يَوۡمَ وُلِدتُّ وَيَوۡمَ أَمُوتُ وَيَوۡمَ أُبۡعَثُ حَيًّا
আর আমার উপর শান্তি, যেদিন আমি জন্মেছি এবং যেদিন আমি মারা যাব আর যেদিন আমাকে জীবিত অবস্থায় উঠানো হবে’।[১৯:৩৩]
ذَٰلِكَ عِيسَى ٱبۡنُ مَرۡيَمَۚ قَوۡلَ ٱلۡحَقِّ ٱلَّذِى فِيهِ يَمۡتَرُونَ এই হচ্ছে মারইয়াম পুত্র ঈসা। এটাই সঠিক বক্তব্য, যে বিষয়ে লোকেরা সন্দেহ পোষণ করছে। [১৯:৩৪]
Table of Contents
১. দাসত্বই সবচেয়ে বড় সম্মান।
মানব ইতিহাসে দাসত্ব শব্দটির নেতিবাচক অর্থ এবং প্রভাব রয়েছে। ইসলাম এসেছে মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বের দিকে পরিচালিত করার জন্য। আর যে কোনো মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় সম্মান হল স্বেচ্ছায় আল্লাহর দাসত্ব করা। আল্লাহ আমাদের প্রভু, তিনি যা সিদ্ধান্ত নেন, আমরা তাই শুনি এবং মান্য করি। এটাই চুক্তি, আর আল্লাহ দয়াশীলদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দয়াময়। তিনিই দান করেন এবং তাঁর বান্দাদের কাছ থেকে খুব কমই চান। নবীগণকে সম্মানিত করা হয়েছে কারণ তারাই আল্লাহর দাসত্বে সর্বশ্রেষ্ঠ। আর এটাই আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় – আমরা আল্লাহর দাস।
২. কিতাব ও নবুওয়াত বরকতের দিকে পরিচালিত করে।
ঈসা (আঃ) উল্লেখ করেছেন যে তাকে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তাকে নবী করা হয়েছে এবং তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, তিনি বরকতময়। এটা আমাদের জন্যও একটি ইঙ্গিত যে আমরা আল্লাহর প্রেরিত ধর্মগ্রন্থ (কুরআন) এবং আমাদের নবীদের পথের যত কাছাকাছি থাকবো, আমরা যেখানেই থাকি না কেন আমাদের জীবন বরকতময় হবে। আল্লাহর কাছ থেকে বরকত অর্জনের এবং একটি বরকতময় অস্তিত্বের চাবিকাঠি হল কিতাব এবং নবীদের পথের সাথে আমাদের সম্পর্ক।
৩. সঠিক জ্ঞান সঠিক কর্মের দিকে পরিচালিত করে।
ঈসা (আঃ) তাঁর সময়ে সেরা মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন নবী এবং তাকে কিতাব দেওয়া হয়েছিল। এবং এর পরপরই, তিনি উল্লেখ করেছেন যে তাকে প্রার্থনা করতে এবং দান-খয়রাত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কাজেই ইসলাম আমাদের শিখায় ইলম মানুষকে আমলের দিকে পরিচালিত করে।
৪. মানুষের জন্য কাজ এবং আল্লাহর জন্য কাজ।
ইসলামের আরেকটি সুন্দর দিক হল আধ্যাত্মিকতা এবং বাস্তবতার অনুপম সমন্বয়। আল্লাহ ঈসাকে (আঃ) তার নিজের আধ্যাত্মিক উপকারের জন্য আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করাতে বলেছেন। আবার মানুষকে দান করতে আদেশ করেছেন, আধ্যাত্মিকভাবে উন্নীত হওয়ার জন্য এবং আল্লাহ ও মানুষ উভয়ের সাথে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করার জন্য। ইসলাম একটি অত্যন্ত মানবিক ধর্ম এবং এটি আধ্যাত্মিকতার সাথে বাস্তবতার সমন্বয় করে।
৫. উত্তম আচরণ ইসলামের বৈশিষ্ট্য।
ঈসা (আঃ) বলেছেন যে তিনি উদ্ধত এবং করুণাহীন নন। রাসুল (ﷺ) বলেছেন, “কিয়ামত দিবসে মুমিনের দাড়িপাল্লায় সচ্চরিত্র ও সদাচারের চেয়ে বেশি ওজনের আর কোন জিনিস হবে না।”
[তিরমিজি -২০০২]
আমাদের আমল গুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল উত্তম আচরণ। যদিও লোকেরা ঈসার (আ:) মা সম্পর্কে খুব ভয়ঙ্কর কথা বলেছিল, তবুও তিনি সুন্দর ব্যবহার এবং কর্তৃত্বের সাথে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন এবং কাউকে হেয় করেনি। তিনি আগুন দিয়ে আগুনের জবাব দেননি, তিনি সুন্দর বক্তৃতার মাধ্যমে অসুস্থ বক্তব্যের জবাব দিয়েছিলেন।
৬.মা, মা, এবং মা।
এই কঠিন কথাবার্তার মাঝে, ঈসা (আঃ) উল্লেখ করার সময় পেয়েছেন যে তাকে তার মায়ের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ করা হয়েছে। আমাদের জীবনে মায়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কেউ নেই, এর চেয়ে পবিত্র কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের ভালবাসা এবং আনুগত্যের বেশি যোগ্য আর কেউ নেই। আর কোথাও না হলেও, তাদের কাছে রয়েছে আমাদের বিশেষ এক অবস্থান। তারাই আমাদের জান্নাতের সবচেয়ে সহজ পথ, তারাই সেই ফল্গুধারা যেখান থেকে উৎসরিত হয় বিশুদ্ধতম প্রবাহ।
إِنَّ ٱللَّهَ رَبِّى وَرَبُّكُمۡ فَٱعۡبُدُوهُۗ هَٰذَا صِرَٰطٌ مُّسۡتَقِيمٌ
নিশ্চয় আল্লাহ আমার রব ও তোমাদের রব। অতএব তোমরা তাঁর ইবাদাত কর। এটি সরল পথ’।
[৩:৫১]
৭. তাকওয়া সাফল্যের মাপকাঠি।
আল্লাহ আমাদের বিচার করার জন্য অনেক নির্ধারককে বেছে নিতে পারতেন, কিন্তু তিনি এমন একটি মাপকাঠি বেছে নিয়েছেন যা আমরা কেউ দেখতে পাই না, আর তা হল- তাকওয়া। রাসুল (ﷺ) তার বুকের দিকে ইশারা করে বলেছিন, “তাকওয়া এখানে”। ঈসার (আঃ) কাছ থেকেও এই আদেশ আমরা পাই — সৃষ্টিকর্তার প্রতি সচেতন হোন। আমরা কিভাবে তাকওয়া অর্জন করব? সর্বোত্তম এবং সহজ উপায় হল আমাদের প্রতিদিনের লেনদেনে আল্লাহকে স্মরণ করা এবং প্রতিটি পদক্ষেপে নিজেকে জিজ্ঞাসা করা, “আল্লাহ কি এর জন্য আমার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন?”
৮. সরল পথটাই সবচেয়ে সহজ।
আমাদের বিষয়গুলি জটিল করার দরকার নেই। সরল পথই সহজ- আল্লাহ আমাদের পালনকর্তা এবং আমরা তাঁর আনুগত্যকারী। আমরা তাঁর দাস এবং তিনি যা চান আমরা তাই করি। এটাই সরল পথ।
৯. অনুসরণকারীর সংখ্যা সাফল্যের মাপকাঠি নয়।
আমরা জানি যে খুব বেশি লোক ঈসার (আঃ) ডাকে সাড়া দেয়নি, কিন্তু এর মানে এই নয় যে তিনি সফল হননি। মানুষের অন্তর আল্লাহর হাতে। কাজেই আমাদের কাজ হচ্ছে দ্বীন সম্পর্কে মানুষকে অবগত করা। আর এ কারণেই তাৎক্ষণিকভাবে খুব অল্পসংখ্যক সাহাবী থাকা সত্ত্বেও ঈসা (আঃ) ইতিহাসের পাঁচজন মহান নবীর একজন।
১০. সত্যের পক্ষে লোক কম হলেও সত্যের সাথে থাকুন।
অল্প সংখ্যক লোক ইসলামের অনুশীলন করলেও আমাদের অনুশীলন করা উচিত। অনুগামী কম হলেও এর মানে এই নয় যে এটি সত্য নয়। সত্য সঠিক ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত, অনুসারীর সংখ্যার উপর নয়।