ইসলাম এমন একটি ধর্ম যে ধর্ম শুধু নিজে ভালো থাকার শিক্ষা দেয় না অন্যকেও ভালো রাখার শিক্ষা দেয়, অন্যের ভালো নিয়েও চিন্তা করার শিক্ষা দেয়। এটা ইসলামের একটি সৌন্দর্য বটে। আর সেই ভালো রাখার এবং ভালো নিয়ে চিন্তা করার অংশ হিসেবে যারা এক আল্লাহকে স্বীকার করে অর্থাৎ ঈমানদার, যারা শিরকমুক্ত জীবনযাপন করে তাদের কল্যাণ কামনা করার জন্য আল্লাহ আমাদেরকে পবিত্র কুরআনে কিছু দোয়ার শিক্ষা দিয়েছেন যেন কিয়ামত পর্যন্ত তার সকল আগত ও অনাগত বান্দারা এইসব দোয়ার মাধ্যমে তাদের ঈমানদার ভাই-বোনদের জন্য কল্যাণ কামনা করে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে,
رَبَّنَا اغۡفِرۡ لَنَا وَ لِاِخۡوَانِنَا الَّذِیۡنَ سَبَقُوۡنَا بِالۡاِیۡمَانِ وَ لَا تَجۡعَلۡ فِیۡ قُلُوۡبِنَا غِلًّا لِّلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا رَبَّنَاۤ اِنَّکَ رَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ
অর্থঃ ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন; এবং যারা ঈমান এনেছিলো তাদের প্রতি আমাদের অন্তরে কোনো বিদ্বেষ রাখবেন না; হে আমাদের রব, নিশ্চয় আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু।'
[সূরা আল হাশর: ১০]
رَبِّ اغۡفِرۡ لِیۡ وَ لِوَالِدَیَّ وَ لِمَنۡ دَخَلَ بَیۡتِیَ مُؤۡمِنًا وَّ لِلۡمُؤۡمِنِیۡنَ وَ الۡمُؤۡمِنٰتِ ؕ وَ لَا تَزِدِ الظّٰلِمِیۡنَ اِلَّا تَبَارًا
অর্থঃ ‘হে আমার রব! আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, যে আমার ঘরে ঈমানদার হয়ে প্রবেশ করবে তাকে এবং মুমিন নারী-পুরুষকে ক্ষমা করুন এবং ধ্বংস ছাড়া আপনি যালিমদের আর কিছুই বাড়িয়ে দেবেন না।’
[সূরা আন নূহ: ২৮]
লক্ষণীয়, দুটো দোয়াতেই বর্তমান ও গতো হওয়া সকল ঈমানদারদের জন্য অর্থাৎ যারা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী, যারা শিরক থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারে সবসময় তৎপর তাদের জন্য মোটাদাগে দোয়া করা হয়েছে। এছাড়া, ঈমানদারদের প্রতি যেন মনে কোনো হিংসা কাজ না করে, অকল্যাণের চিন্তা না আসে সেই দোয়াও চাওয়া হয়েছে।
ঈমানদারদের জন্য দোয়া করা হয় এমন আরেকটি দোয়া হচ্ছে,
رَبَّنَا اغۡفِرۡ لِیۡ وَ لِوَالِدَیَّ وَ لِلۡمُؤۡمِنِیۡنَ یَوۡمَ یَقُوۡمُ الۡحِسَابُ অর্থ : হে আমাদের প্রতিপালক! হিসাব গ্রহণের দিন আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে আর মু’মিনদেরকে ক্ষমা করে দিও। [সূরা ইব্রাহিম: ৪১]
দোয়াগুলোর কথা কত চমৎকার, সুবহান’আল্লাহ! আমাদের ঈমানদার ভাই-বোনদের জন্য আমাদের এই দোয়াগুলো সবসময় করা উচিত। কারণ কারো অনুপস্থিতিতে তার জন্য দোয়া করার ব্যাপারে রাসূল (সাঃ) উৎসাহ দিয়ে বলেছেন, যখন কোনো ব্যক্তি তার অন্য ভাইয়ের আড়ালে তার জন্য দু’আ করে, তখন ফেরেশতাগণ বলেন, আমীন এবং তোমার জন্যও তা-ই হোক যা তোমার ভাইয়ের জন্য তুমি দোয়া করলে।
[সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস নং : ১৫৩৪]
এই হাদীস বলছে, আপনি যখন ঐ দোয়ার মাধ্যমে আপনার আরেক ঈমানদার ভাই বোনের জন্য ক্ষমার দোয়া করছেন তখন ফেরেশতারা আপনার জন্য ঠিক একই দোয়া করছেন। অর্থাৎ ফেরেশতারা আল্লাহকে বলছেন, হে আমাদের রব, তোমার যে বান্দা তার আরেক ভাইয়ের ক্ষমা প্রার্থনা করেছে, তার আরেক ভাইয়ের কল্যাণ কামনা করছে তাকেও তুমি ক্ষমা করে দাও, তাকেও তুমি কল্যাণ দান করো। সুবহান’আল্লাহ!
উপরের দ্বিতীয় দোয়ার শেষ অংশে দুনিয়ার সকল যালিমদের প্রতি ধ্বংস কামনা তথা অভিশাপের মতো বদদোয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এই যে চারিদিকে যারা এত এত এত যুলুম নির্যাতন, মানুষের হক নষ্ট ইত্যাদি বিভিন্নভাবে মানুষের ক্ষতি করে যালিমের ভূমিকা পালন করছে তাদের প্রতি আমাদের ঘৃণা প্রকাশ করা ছাড়া হয়ত তেমন কিছুই করার থাকছে না। আমরা হয়ত চাইলেও তাদেরকে শাস্তির মুখোমুখি করতে পারছি না। কিন্তু একটা জিনিস করতে পারব। সেটা হচ্ছে তাদের ধ্বংস কামনা যা ঐ দোয়ায় আল্লাহ আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছেন। আপনি যখন ঐ দোয়া পাঠ করছেন তখন পৃথিবীর সমস্ত যালিমদের কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি কামনা করছেন।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায় শুধুমাত্র তিন প্রকার আমল ছাড়া।
১. সাদকায়ে জারিয়াহ
২. এমন ইলম যার দ্বারা উপকার হয়
৩. পুণ্যবান সন্তান যে তার মা-বাবার জন্যে দু’আ করতে থাকে।
[সহীহ মুসলিম, হাদীস নং : ৪১১৫]
এখন যার সদকায়ে জারিয়ার জন্য কিছু করার সামর্থ্য নেই, ইলম দিয়ে অন্যকে উপকার করার মতোও যোগ্যতা নেই, এমনকি সন্তানও নেই যে তার জন্য দোয়া করবে তবে কি তার মৃত্যুর পর তার জন্য আমল পৌঁছার আর কোনো ব্যবস্থা থাকবে না? দেখুন, হাদীসে উল্লেখিত ঐ তিনটি বিষয় বান্দার হাতে নেই। কিন্তু একটা জিনিস আল্লাহ বান্দার হাতে দিয়ে রেখেছেন। এটার জন্য সে কোনো অজুহাত দেখাতে পারবে না। এটা তার মধ্যে থাকলে মৃত্যুর পরও তার আমলনামা বন্ধ হবে না বরং সওয়াব যুক্ত হতে থাকবে। তাই যারা জীবদ্দশায় ঐ তিন জিনিসের আমল করতে পারবে না তাদের দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেটা কী?
সেটা আর কিছু নয়, ঈমান।
ঈমান মানে কী?
ঈমান শব্দের অর্থ দৃঢ় বিশ্বাস। আল্লাহর পক্ষ থেকে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কিছু নিয়ে এসেছেন সেসব বিষয়কে অন্তরে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা, মুখে স্বীকার করা এবং সে অনুযায়ী আমল করাকে ঈমান বলে। মোটাদাগে, তিনটি জিনিসের নাম ঈমান। প্রথমত, অন্তর দিয়ে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা। উল্লেখ্য, যে ছয়টি বিষয়ের ওপর বিশ্বাস রাখতে হয় সেগুলোকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মুখ দিয়ে স্বীকার করা। তৃতীয়ত, সে অনুযায়ী আমল করা। এই তিনিটি জিনিসের একটির অনুপস্থিতি থাকা মানে ঈমানদার হতে না পারা। মনে রাখবেন, ঈমানদার শুধু মুখে দাবি করার বিষয় নয় অন্তরে ধারণ করার পাশাপাশি আমলেও পরিণত করার বিষয়।
ঈমান হচ্ছে একজন মুসলিমের আসল সম্পদ। সেই তো আসল ধনী যার ঈমান নামক সম্পদ রয়েছে। পক্ষান্তরে, তার চেয়ে বড়ো নিঃস্ব, বড়ো হতভাগা আর কেউ হতে পারে না যার ঈমান নেই। ঈমান ছাড়া নেক আমলেরও কোনো মূল্য থাকে না। আল্লাহ তা’য়ালা কুরআনে আমলের কথা বলার পূর্বে ঈমান এর কথা বলেছেন। এ থেকে বোঝা যায় ঈমানের গুরুত্ব অনেক বেশি।
মনে রাখবেন, আপনি যতো বড়ো বিলিয়নার তথা সম্পদশালীই হোন না কেন আল্লাহর দৃষ্টিতে তবু্ও আপনি ধনী নন যদি আপনার ঈমান না থাকে। অপরদিকে, আপনি যতো বড়ো গরিব হোন না কেন তবু্ও আপনি গরিব নন যদি আপনার ঈমান থাকে। ঈমান থাকা না থাকা ধনী-গরিবের আসল মানদন্ড।
যাইহোক, আমরা যদি ঈমান নিয়ে চলি তথা খাঁটি ঈমানদার হই তবে সারা দুনিয়ার সকল ঈমানদাররা আমাদের জন্য দোয়া করবে। প্রতিটি মুহূর্তে আমরা কারো না কারো কাছ থেকে দোয়া পাবো। জীবদ্দশায় সদকায়ে জারিয়া, উপকারী জ্ঞান ও নেককার সন্তান রেখে যাওয়ার মতো আমল করতে না পারলেও শুধুমাত্র ঈমান নিয়ে জীবনটা কাটানোর জন্য, শিরক থেকে বেঁচে থাকার জন্য, তাওহীদের পক্ষে থাকার জন্য মৃত্যুর পরও আমরা সকল মু’মিন মু’মিনার দোয়া পেতে থাকবো এমনকি আমরা তাদের অচেনা হওয়া সত্ত্বেও। এজন্য আমাদের কাজ হচ্ছে নিজেকে একজন পাক্কা ঈমানদার হিসেবে গড়ে তোলা, প্রতিটি মুহূর্ত নিজের ঈমান নিয়ে সচেতন থাকা সর্বোপরি মৃত্যু পর্যন্ত ঈমানের উপর অটল থাকা। ঈমানদার অবস্থায় জীবনযাপন করলে, ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করলে কিয়ামত পর্যন্ত সকল ঈমানদারদের দোয়ায় আমাদের উপস্থিতি থাকবে।