ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) ২য় ও শেষ পর্ব
ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) শিখে নেয়া হাদীস একইসাথে লিখে ও রাখতেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে মুখস্থ ও করে নিতেন। তাঁর দেয়া ফতোয়া, তাঁর ছাত্রেরা লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। এক্ষেত্রে তিনি বেশ সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। তিনি তাদেরকে কখনো লিখে নিতে নিষেধ করেন নি। তবে তিনি চাইতেন না তাঁর বলা প্রতিটি মতামত তারা লিখে রাখুক। তাঁর ছাত্র মা’ন বলেন, তিনি ইমাম মালিককে (রাহিমাহুল্লাহ) বলতে শুনেছেনঃ “আমি এমন একজন ব্যক্তি, যে কিছু ক্ষেত্রে সঠিক এবং কিছু বিষয়ে ভুল ও হতে পারি। তাই আমি যা বলি, তার সবকিছুই লিপিবদ্ধ করা উচিত নয়।”
তাঁর ছাত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি তিনটি ক্রাইটেরিয়া অনুসরণ করতেন। কারো মাঝে এই তিনটি বিষয়ের সম্মিলন ঘটলে তাকে তিনি ইলমের সুবিশাল জগতের সাথে পরিচয় করানোর উদ্দেশ্যে নিজের ছাত্র হিসেবে বাছাই করতেন। সেগুলো হলোঃ
- তাঁর বয়স, পরিপক্বতা।
- জ্ঞান ( সর্বপ্রথম পবিত্র কোরআন, এরপর সুন্নাহ এবং ফিক্বহের মূলনীতি সংক্রান্ত জ্ঞান।)
- ভারসাম্যপূর্ণ বিবেচনা জ্ঞান। (প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা)
ইমাম মালিক ইবন আনাস (রাহিমাহুল্লাহ) পৈতৃক ভাবে অনেকটাই স্বচ্ছল ছিলেন। কিন্তু তবুও তাঁর জীবনের বেশ কিছুটা সময় তিনি আর্থিক দৈন্যতার মাঝে কাটিয়েছেন। কেননা তিনি ইলম সাধনার তরে নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন।
এমনও দিন ছিলো, তাঁর কন্যা ক্ষুধার তাড়নায় কান্না করতো এবং তিনি তাঁর দাসকে যাঁতাকল পিষতে বলতেন যেনো প্রতিবেশীর কানে ক্রন্দনের এ আওয়াজ না পোঁছোয়।
তারপর আল্লাহ যখন তাঁর জীবনযাত্রার মান উন্নত করার তাওফিক দান করেন, তিনি আল্লাহ প্রদত্ত এ নেয়ামতের শোকর আদায় করেন এবং উত্তম ব্যবহার করেন। তিনি উল্লেখ করেন,
“আমি এমন লোককে পছন্দ করিনা যাকে আল্লাহ তায়ালা নিয়ামত প্রদান করেছেন কিন্তু তাঁর মাঝে সেই নিয়ামতের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় না, বিশেষত জ্ঞানী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে।”
সাধারণত মানুষ প্রভূত সম্পদের অধিকারী হলে অর্থের মোহে দ্বীন থেকে বিচ্যুত হয়। ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) ছিলেন একদম ব্যতিক্রম। সেসময় অনেকেই সম্পদ থাকা সত্ত্বেও নিজেদেরকে সবার কাছে দীনহীন রূপে প্রকাশ করতো। তারা এ কাজকে যুহদের সমপর্যায়ের মনে করে এরূপ করে থাকতো। কিন্তু ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর সম্পদের যথাযোগ্য ব্যবহার করতেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে তাঁর অধিকতর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে।
ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) বেঁচে থাকাকালীন তাঁকে বেশ অনেকজন খলিফার যুগ দেখতে হয়েছে। তিনি জানতেন, তাঁর সময়কার শাসকেরা পরিপূর্ণ রূপে ইসলামের আইন মেনে শাসন করছেন না; কিন্তু তিনি এও মনে করতেন না যে, শুধুমাত্র এই কারণেই কোন শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা পুরোপুরি ন্যায়সংগত।
কেননা তা কেবলই অন্যায়, বিশৃঙ্খলা ও দুর্নীতির জন্ম দেয়। তিনি মাঝে মাঝে খলীফা, আমীরদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁদেরকে সতর্ক করতেন।
এ ব্যাপার নিয়ে তাঁকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হতো। কিন্তু তিনি ছিলেন অনড়। তিনি মনে করতেন, একজন ব্যক্তি, যার বুকে আল্লাহ সত্য ইলমের ভান্ডার প্রোথিত করেছেন এবং ফিক্বহের জ্ঞান দান করেছেন; তার জন্য এটি কর্তব্য যে সে শাসকশ্রেণির কাছে যাবে এবং তাদেরকে ভালো কাজ করবার ও মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকবার নির্দেশ দিবে।
তাঁর এক ছাত্র তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, ‘লোকেরা বলাবলি করে, আপনি শাসকদের কাছে যান এনং তারা এ নিয়ো আপনার নিন্দা করে।’ জবাবে তিনি বললেন, “আমি এটিকে আমার জন্য দায়িত্ব স্বরূপ মনে করি। কেননা যদি আমি তাকে নসীহাহ না করি, তাহলে হয়তো সে এমন লোকেদের কাছ থেকে পরামর্শ শুনতে চাইবে, যাদের থেকে পরামর্শ নেয়া ক্ষতিকর।”
খলীফাদের মধ্যে অনেকেই তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন। যখন খলীফা আল-মাহদী মদীনায় এলেন, তাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেবার জন্য জনতার ভীড় জমে গিয়েছিলো। এমন সময়ে ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) উপস্থিত হলেন এবং লোকেরা বলতে থাকলো, ‘আজ ইমাম মালিক একদম পেছনে পড়ে গেলেন।’
ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) এরপর প্রবেশ করলেন এবং ভীড় খেয়াল করে খলীফাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “হে আমীরুল মু’মিনীন! আজ আপনার শায়খ, মালিক কোথায় বসবেন?” খলীফা তাকে কাছে ডেকে বললেন, ‘আমার পাশে, আবু আবদুল্লাহ।’ অতঃপর তিনি তাঁর পাশে ইমামের বসার জায়গা করে দিলেন।
তবে তিনি সর্বদা ন্যায়নিষ্ঠ ছিলেন। অন্যায়, অসংগতি চোখে পড়লে কখনো চুপ করে থাকতেন না। একবার খলীফা হারুন অর রশীদ জুমার খুতবার সময় মসজিদে একটি রাজকীয় চেয়ার নিয়ে ঢুকেন এবং সেই চেয়ারে বসে খতিবের অপেক্ষা করতে থাকেন। ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) মিম্বরে উঠবার সময় খলীফার এহেন ঔদ্ধত্যপুর্ণ আচরণ খেয়াল করলেন। তিনি মিম্বরে উঠে একটি হাদীস বলেই খুতবা শেষ করেন।
“যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এক স্তর বিনয়ী হবে ( এই বলে রাসূলুল্লাহ সা. এক হাত নীচে নামালেন), আল্লাহ তাঁর মর্যাদা এক স্তর উঁচু করবেন*( এই বলে রাসূলুল্লাহ সা. এক হাত উঁচু করলেন)।” [মুসনাদে আহমদঃ৩০৯]
খলীফা এই খুতবা শুনেই বুঝে ফেললেন ইমাম মালিক কোনদিকে ইঙ্গিত করতে চাইছেন। তিনি মসজিদ থেকে চেয়ার সরিয়ে নিলেন। তারপর মালিক ইবনে আনাস (রহিমাহুল্লাহ) আবার খুতবা বলা শুরু করলেন।
তাকে রাজদরবারে গিয়ে হাদীস শুনাতে বলা হলে তিনি উত্তর দিতেন,
“জ্ঞানের কাছে মানুষ আসে, মানুষের কাছে জ্ঞান নয়।”
সমসাময়িক সকল স্কলারগণই তাঁর ব্যাপারে সুধারণা পোষণ করতেন।
সুফিয়ান ইবন উয়াইনাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, “আল্লাহ মালিক ইবন আনাসের প্রতি দয়াপরবশ হন। তিনি হাদীসের রাবী যাচাই বাছাইয়ে অতিমাত্রায় সতর্ক থাকতেন। আমরা সবসময় ইমাম মালিককে অনুসরণ করতাম। যদি দেখতাম তিনি কোন শায়খের থেকে বর্ণনা করেছেন, আমরাও তাকে উস্তাদ হিসেবে মেনে নিতাম।”
ইমাম আশ শাফি’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
“ যখন তোমার কাছে ইমাম মালিক থেকে বর্ণিত কোন সুন্নাহ আসবে, তাকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো। স্কলারগণকে নিয়ে আলোচনা করবার সময় মাথায় রেখো, ইমাম মালিক ইলমের দুনিয়ার একজন প্রজ্বলিত তারকা। বিশুদ্ধ হাদীস যদি তুমি পেতে চাও, অবশ্য ই তোমাকে ইমাম মালিকের কাছে আসতে ই হবে।”
তৎকালীন সময়ে ঈর্ষণীয় ইলমের অধিকারী হয়েও তিনি ছিলেন অত্যধিক বিনয়ী। বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়, তিনি বলতেনঃ
“ইলম হচ্ছে একটি উজ্জ্বল বাতি, যা কিনা কেবল একজন আল্লাহভীরু, মুত্তাকী ব্যক্তির অন্তরে ঠাঁই পেতে পারে।”
সদা সন্ত্রস্ত ও সচেতন থাকতেন, যেনো তাঁর দ্বারা কোন রেফারেন্সবিহীন ফতোয়া দেয়া না হয়ে যায়। মাঝে মাঝে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলতেন- ‘আমার জানা নেই’। অনেকে ধারণা করতো, তা ছিলো তাঁর জ্ঞানের স্বল্পতা। কিন্তু তিনি এমনটা করতেন, যখন এ বিষয় সংক্রান্ত আলাপ জনসম্মুখে প্রকাশ করা ঝুঁকির সম্মুখীন হতো অথবা সাহাবীদের থেকে নির্ভরযোগ্য মতামত পাওয়া যেতো না।
ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) ছিলেন অত্যধিক ফর্সা, দীর্ঘ কেশবিশিষ্ট, দীর্ঘাকায়, মজবুত স্বাস্থ্যের অধিকারী। ছিলেন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। কথা বলবার সময় অপরিচিত লোকও তাঁকে সমীহ করতো। দৃষ্টিতে ই যেনো ফুটে উঠতো ব্যক্তিত্বের পরিচয়। যেকোন কাজ সবসময় দায়িত্বের সাথে পালন করতেন। তার সুদীর্ঘ শিক্ষক জীবনে হাদীস পাঠদানের সময় তাঁকে কেউ অহেতুক কোন কাজ করতে দেখেনি। হাসতেন না কখনো। ছাত্রেরা তাকে এতো ভয় পেতো যে বইয়ের পাতা উল্টাবার শব্দ করতেও সাহস পেতো না।
একজন ছাত্র উল্লেখ করেন, ‘ইমাম মালিক আমাদের সাথে বন্ধুবৎসল ছিলেন। তিনি আমাদের সাথে হাসিঠাট্টা করতেন সমবয়সীদের মতো। কিন্তু যখন ই হাদীসের পাঠদান শুরু করতেন, তাঁর কন্ঠ গাম্ভীর্যপূর্ণ হতো। ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধার অনুভূতি সৃষ্টি হতো সে কন্ঠস্বর শুনলে। মনে হতো, না আমরা পূর্বে তাঁকে চিনতাম, না তিনি আমাদেরকে চেনেন। এ যেনো এক অন্য মালিক ইবন আনাস।’
ইমাম আশ শাফি’ঈ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, “আমি ইমাম মালিকের ন্যায় আর কারো প্রতি এতোটা সমীহ প্রদর্শন করিনি।”
আল্লাহ প্রদত্ত একটি চমৎকার ভিন্নধর্মী গুণ ছিলো তাঁর মাঝে। তা হলো, অন্তর্দৃষ্টি। আরবীতে এঁকে ‘ফিরাসাত’ বলা হয়। ব্যক্তির মেজাজ, মন মানসিকতার পরিচয় বুঝতে পারা এবং তাঁর অভ্যন্তরীন চিন্তাভাবনা সম্পর্কে ধারণা করতে পারা।
দ্বিধাহীনভাবে এ কথা বলা যায় যে, ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) দ্বারা প্রণীত গ্রন্থ “মুয়াত্তা” সর্বপ্রথম প্রকাশিত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ, যা ছড়িয়ে পড়েছিলো পুরো ইসলামী বিশ্বব্যাপী এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলছে এর চর্চা। হাদীস এবং ফিক্বহ শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ প্রথম বিশুদ্ধ গ্রন্থ ছিলো এটি। ইমাম মালিক খুব সতর্কভাবে হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাই-বাছাই করতেন। এমনও হয়েছে অত্যধিক ন্যায়বান ও আল্লাহভীরু লোকেদের থেকেও তিনি হাদীস সংগ্রহ করেন নি, কেননা প্রচলিত ছিল যে তিনি যথাযথভাবে মুখস্ত করতেন না।
তাঁর সময়ে আরো আশিজন ‘ মুয়াত্তা’ নামে কিতাব লিখেন। তাঁকে সেই কিতাবগুলোর সমালোচনা করতে বলা হলে তিনি বললেন, “ যে মুয়াত্তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য লিখিত হয়েছে, সেটিই থেকে যাবে।”
ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) আল্লাহর অশেষ রহমতে অনেকদিন বেঁচে ছিলেন। তাই তিনি অসংখ্য ছাত্রকে ইলমের জগতে পরিচয় করিয়ে দেবার সুযোগ পেয়েছেন। তন্মধ্যে ১০০০ জন ছাত্র পরবর্তী সময়ে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি লাভ করেছিলেন। আবদুর রহমান বিন আল কাসেম নামের তার একজন ছাত্র ছিলেন। যিনি প্রায় ২০ বছর ইমাম মালিকের (রাহিমাহুল্লাহ) সান্নিধ্য লাভ করেন। মালিকী মাজহাবের প্রসারে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ইবন ওয়াহাব (রাহিমাহুল্লাহ) বলতেন, “যদি তুমি ইমাম মালিকের ফিক্বহ বুঝতে চাও, অবশ্যই তোমাকে ইবন আল কাসিমকে জানতে হবে।”
মালিক ইবন আনাসের (রাহিমাহুল্লাহ) জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম বিষয় হচ্ছে, তাঁর উস্তাদ এবং শিষ্যদের মাঝে বেশ অনেকজন নারী বিদ্যমান ছিলেন। এর মাঝে একজন শিক্ষিকা ছিলেন আমরাহ বিনতে আবদুর রহমান (রাদ্বি’আল্লাহু আনহা)। তিনি ছিলেন উম্মুল মুমিনীন আয়িশাহ রাদ্বি’আল্লাহু আনহা, উম্মু সালামা রাদ্বি’আল্লাহু আনহার ছাত্রী।
ইসলামের পঞ্চম খলিফা নামে খ্যাত উমর ইবনে আবদুল আজিজের(রাহিমাহুল্লাহ) সময় ইবন শিহাব আয যুহরী যখন হাদীস সংকলন শুরু করেন, তখন খলিফা বলেন, “যাও, সবার আগে আমরাহ’র হাদীস সংগ্রহ করো।”
তাঁর কন্যা ফাতিমা, পিতার থেকে শিক্ষা লাভ করে ইলমে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি পবিত্র কোরআন মজীদের পাশাপাশি ‘মুয়াত্তা’ মুখস্ত করেন। পিতার অনুপস্থিতিতে মাঝে মাঝে তিনি দরজার আড়াল থেকে ইমাম মালিকের ছাত্রদের হাদীস শিক্ষার ক্লাসের পড়া শুনতেন। কেউ কোন ভুল করলে দরজায় টোকা দিতেন এবং সেই ছাত্র তা সংশোধন করে নিতেন।
রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্নাহর প্রতি ইমাম মালিকের (রহিমাহুল্লাহ) ছিলো অপরিসীম শ্রদ্ধা। তিনি সকল কাজে নবীজি (সাঃ) কে পরিপূর্ণ অনুসরণ করতেন। হজ্জ্ব করবার নিমিত্ত ছাড়া তিনি কখনো মদীনার বাহিরে যেতেন না। কারণ মদীনা রাসূল(সাঃ) এর স্মৃতিবিজড়িত স্থান। এ স্থানের পথে পথে রাসূল(সাঃ) এর পদচিহ্ন রয়েছে। তিনি বলতেন,
“সুন্নাহ হলো নূহের (আলাইহিস সালাম) নৌকার মতো। যে নৌকায় উঠলো সে নিরাপদ, যে নৌকায় উঠলো না সে বিপদে পড়লো।”
ইমাম মালিকের হাতে সব সময় একটা আংটি থাকতো। তাতে লেখা ছিল “হাসবুনাল্লাহ ওয়া নি’মাল ওয়াকিল” -লোকেরা এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন, ‘এর অর্থ “আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনি কতইনা উত্তম”; এটা যেন আমি বারবার দেখি আর মনে করি এবং আমার মনে যেনো এটি অংকুরিত হয়ে যায়।
ইলম সাধক মালিক ইবন আনাস (রাহিমাহুল্লাহ) সর্বদা জ্ঞানান্বেষণে নিজেকে মগ্ন রাখতেন। খিলাফাতের অদল বদল নিয়ে তিনি থাকতেন নীরব। তার সময়ের যাবতীয় বিদ্রোহ, দমন সংঘটিত হয়েছিলো ইরাক এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে। ইমাম মালিক সেসব থেকে দূরে থাকতেন। ১৪৫ হিজরীর পূর্ব সময় পর্যন্ত তিনি রাজনৈতিক কোন কর্মকান্ডে নিজেকে কখনো জড়িত করেন নি।
আব্বাসী খিলাফাত। খলীফা আবু জাফর আল মানসূরের শাসনামল। মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ আল হাসানের নেতৃত্বে একটি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়, যার সূচনা হয়েছিলো মদীনায়। ইবন আবদুল্লাহ, মদীনায় মিম্বর দখল করেন এবং জুম’আয় খুতবা দেয়া শুরু করেন। লোকেরা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লেন। কেননা তারা ইতোমধ্যে আল মানসূরের কাছে বাইয়্যাত গ্রহণ করেছিলেন। আবার ইবন আবদুল্লাহকেও তারা পছন্দ করতেন।
ইমাম আস সুয়ূতী উল্লেখ করেন, মালিককে (রাহিমাহুল্লাহ) জাফর আল মানসূরের বাইয়্যাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “জোরপূর্বক তালাক্ব গ্রহণযোগ্য নয়।” অর্থাৎ, জনগণকে জোর করে যে বাইয়্যাত নেয়া হয়েছে, তার কোন ভ্যালিডিটি নেই।
এ কথার মাধ্যমে বিদ্রোহীদের প্রতি তার সমর্থনের কথা স্পষ্ট হয়ে গেলো এবং ফলশ্রুতিতে খলিফার রোষানলে পড়লেন তিনি। নেমে আসলো নির্যাতনের খড়গ। তৎকালীন মদীনার গভর্নর জাফর ইবন আবি সুলাইমান তাকে আটক করে নেয়। নির্মমভাবে বেত্রাঘাত করা হয় তাকে। তাদের কৃত নিষ্ঠুরতা এতো চরমে পৌঁছেছিলো যে তারা ইমাম মালিকের (রাহিমাহুল্লাহ) কাঁধের হাড় স্থানচ্যুত করে দেয়। গভর্নর জাফর যখন দেখলেন যে, ইমাম মালিকের প্রতি অত্যাচার করবার কারণে অবশিষ্ট আনুগত্যশীল লোকেরাও দলে দলে বিদ্রোহকে সমর্থন করছে; সে ইমাম মালিককে ছেড়ে দিলো।
পরবর্তী সময়ে খলিফা জাফর আল মানসূর মদীনায় এসে ইমামের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং সমস্ত দায়ভার গভর্নরের উপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা চালানো হয়। ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) নিরুত্তর থাকলেন এবং যথারীতি ফিরে আসলেন তার দরসের ক্লাসে। তাকে সবাই বললেন, ‘কেনো আপনি কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না!’ এ কথার উত্তরে তিনি যা বলেছিলেন, তা ছিলো তার মহানুভবতার পরিচয়। তিনি বলেন,
“ আমি আমার ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান করবার জন্য উম্মাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারিনা। আমি আশংকা করি, আমি আজ অথবা কাল মারা যেতে পারি। মৃত্যুর পর রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে এরূপ অবস্থায় সাক্ষাৎ করতে পারবো না, যে তাঁর কোন আত্মীয় আমার কারণে জাহান্নামবাসী হচ্ছে। তাই আমি তার জন্য কোন বদ দু’আ করতে পারবো না। বরং আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন, এটাই আমার প্রার্থনা।”
সুবহানাল্লাহ! এভাবেই তিনি রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গভীরভাবে ভালোবাসতেন। নিজস্ব সমস্ত স্বার্থের উর্ধ্বে গিয়ে তিনি নবীজিকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্মানের আসনে আসীন করেছেন।
জীবনের শেষ সময়গুলোতে শারীরিক অসুস্থতার কারণে, তিনি মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে পারতেন না; যদিও তাঁর বাড়ি ছিলো মসজিদের সন্নিকটে। নিদারুণ কষ্টের মাঝে কেটেছিলো তার অন্তিম সময়। তবে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁকে সম্মানিত করেছেন মদীনার মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবার সৌভাগ্য দানের মাধ্যমে।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
“কেউ মদীনাতে মৃত্যুবরণ করতে সক্ষম হলে সে যেনো সেখানেই মৃত্যুবরণ করে। কারণ, যে ব্যক্তি সেখানে মৃত্যুবরণ করবে, আমি তার জন্য শাফায়াত করবো।”
[জামে আত-তিরমিজীঃ ৩৯১৭]
১৭৯ হিজরীতে উম্মাহ’র এই উজ্জ্বল নক্ষত্র আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। তাঁকে জান্নাতুল বাকীতে সমাহিত করা হয়।
জ্ঞানীরা চলে যান, কিন্তু থেকে যায় তাদের বিলিয়ে দেয়া জ্ঞান!