ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) ২য় ও শেষ পর্ব
উমাইয়্যার শাসনামলে কুফার গভর্নর ছিলেন ইবন হুবায়রা। তিনি ইমাম আবু হানিফাসহ (রাহিমাহুল্লাহ) ইরাকের সকল ফক্বীহদের একত্রিত করে তাদেরকে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত করার নিয়তের কথা বলেন। সবাইকে রাজী করাতে পারলেও আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) এতে কোনভাবেই রাজী হননি।
ফলস্বরূপ তাঁকে কারাবন্দী হতে হয় এবং সেখানে তাঁকে চাবুক দিয়ে শাস্তি প্রদান করা হয় যেনো তিনি রাজী হয়ে যান। কিন্তু এ মহান ইমাম তাদের এই পরিকল্পনায় বিন্দুমাত্র আপোষ করেননি। সদা অটল ছিলেন সত্যের পথে! পরবর্তীতে তাঁকে মক্কায় চলে যেতে বলা হয়। তিনি সেখানে চলে যান। উমাইয়্যা খিলাফত শেষ হয়ে আব্বাসী খিলাফত বহাল হওয়া অবধি তিনি মক্কায় অবস্থান করেন। মক্কায় থাকাকালীন সময়টা তাঁর জন্য ছিল ইলম সাধনার সুবর্ণ সুযোগ। কেননা এই সময়েই তিনি মক্কা ও মদীনার অনেক প্রখ্যাত আলেম, ফক্বীহ এবং হাদীসবিশারদদের থেকে জ্ঞান লাভ করেন।
সর্বদা ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ়প্রত্যয়ী থাকার কারণে জীবনের অনেকটা সময় তাঁকে কারাপ্রকোষ্ঠে অবস্থান করতে হয়েছিলো। এবং তিনি সেসময় গুলো কাজে লাগান কারাবন্দীদেরকে আলোর পথে নিয়ে আসার পিছনে ব্যয় করে।
পরবর্তী সময়ে ফিকহের জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়া ইমাম আবু হানিফার (রাহিমাহুল্লাহ) একজন ছাত্র ছিলেন আবু ইউসুফ (রহিমাহুল্লাহ)। তাঁর সাথীদের সম্পর্কে আবু হানিফা (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, তারা ৩৬ জন। আটাশ জন ক্বাজী হবার উপযুক্ত। ছয়জন ফতোয়া দেবার যোগ্য। এবং আবু ইউসুফ ও জাফর- ক্কাজী ও ফতোয়া প্রদানকারীদের শিক্ষক হবার যোগ্যতা রাখে।
এবার চলুন ফিক্বহের প্রসংগে! ইমাম আবু হানিফা (রহিমাহুল্লাহ) কোন নির্দিষ্ট ফিক্বহ সংক্রান্ত পুস্তক রচনা করেননি। তবে, তিনিই প্রথম তাঁর ছাত্রদের দ্বারা শরি’আহর বিবিধ বিষয় সম্পর্কিত ফতোয়া সমূহ একত্রিত করেন। তিনি বলতেন এবং ছাত্ররা শুনে লিখতেন। মাঝে মাঝে তিনি সংশোধন করে দিতেন। এভাবেই তার দ্বারা ফতোয়াগুলো একত্রীভূত করা হয়েছিলো। যদিও তা বিভিন্ন জায়গায় সংরক্ষিত ছিলো।
ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই হাদীস স্মরণ করে শংকিত হতেন, যেখানে রাসূল (সাঃ) বলেছেন,
“আল্লাহ মানুষের অন্তর থেকে জ্ঞান বিস্মৃত করবার মাধ্যমে পৃথিবী থেকে জ্ঞান উঠিয়ে নিবেন না। বরং জ্ঞানী ব্যক্তিদেরকে পৃথিবী থেকে নিয়ে যাবার মাধ্যমে জ্ঞান কে উঠিয়ে নিবেন।”
এই শংকা থেকেই তিনি শরি’আহ সম্পর্কিত ফতোয়াসমূহ লিপিবদ্ধ করেন ছাত্রদের টপিক ভিত্তিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে। তিনি সবসময় বিচক্ষণতার সাথে ফতোয়া প্রদান করতেন।
যাদের সাথে মতের অমিল ছিলো তাদের ব্যাপারে আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ কখনো কটু কথা বলতেন না। তিনি প্রায় সময় ই একটা দু’আ করতেন,
“হে আল্লাহ! আমাদের দ্বারা যদি কেউ বিরক্ত হয়, আমাদের হৃদয়কে তাঁদের জন্য উন্মুক্ত করে দিও।”
ইমাম আবু হানিফাকে (রাহিমাহুল্লাহ) নিয়ে মানুষের ব্যক্ত করা কিছু উক্তিঃ
১) তাঁর ছাত্র ক্বাজী আবু ইউসুফ (রহিমাহুল্লাহ) বলেন- একদিন আমি উস্তাদ আবু হানিফার সাথে হাঁটছিলাম। হঠাৎ আমরা শুনলাম একজন ব্যক্তি অপরজনকে বলছে, ‘ওই দেখো! তিনি ইমাম আবু হানিফা। যিনি সারারাত্রি নির্ঘুম থেকে ইবাদতে মগ্ন থাকেন।’
আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) তা শুনে বললেনঃ লোকেরা আমাকে নিয়ে এমন সব ধারণা করে, যা আসলে আমার মধ্যে নেই। আবু ইউসুফ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এরপর থেকে তিনি সারারাত্রি ইবাদত করতেন।
২) তাঁর স্ত্রীদের মাঝে একজন বলেছেন- ‘আমি যেদিন থেকে তাঁর সাথে ছিলাম, তাঁকে রাতে ঘুমোতে দেখিনি। গ্রীষ্মকালে তিনি যুহর থেকে আসর পর্যন্ত নিদ্রায়মাণ থাকতেন। এবং শীতকালে রাত্রির প্রথম অংশে ঘুমাতেন।’
৩) আল ফুদাইল ইবন দুখাইন (রহিমাহুল্লাহ) বলেন- ‘আমি অনেক তাবে’ঈন এবং ন্যায়নিষ্ঠ লোকেদের দেখেছি। কিন্তু কখনো ইমাম আবু হানিফার মতো এতো অন্তর শীতল করা ইবাদত কাউকে করতে দেখিনি। তিনি সালাত শুরু করবার পূর্ব থেকে ই আল্লাহর স্মরণে কাঁদতেন এবং তাসবীহ পাঠ করতেন।’
৪) সুফিয়ান ইবন উয়াইনাহ (রহিমাহুল্লাহ) বলেন- ‘আমাদের সময়ে মক্কায় আবু হানিফার চাইতে বেশি ইবাদতগুজার কেউ ছিলো না।’
আবু হানিফার (রাহিমাহুল্লাহ) সাথে আব্বাসী খিলাফাহর সময়ে খলীফা আল মানসূরের মধ্যে একটি বিষয়ে মতবিরোধ হয়। ঘটনা হলো, আল মানসূর এবং তাঁর স্ত্রীর মধ্যে একটি বিষয় নিয়ে বিবাদ হয়েছিলো। এ ব্যাপারে সমঝোতা করবার জন্য ইমাম আবু হানিফাকে (রাহিমাহুল্লাহ) ডেকে আনা হয়।
খলিফা তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘হে আবু হানিফা, একজন ব্যক্তি একইসাথে কয়জন স্ত্রী রাখতে পারেন?’
আবু হানিফাঃ ৪ জন, নিঃসন্দেহে।
আল মানসূরঃ আর দাসীর সংখ্যার ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?
আবু হানিফাঃ যতো ইচ্ছে বা যতো সামর্থ্য!
আল মানসূর বললেন, কেউ কি এ কথার বিপরীত কিছু বলতে পারে?
আবু হানিফা উত্তরে বললেন, ‘না।’
এ কথা শুনে আবু মানসূর খুশি হয়ে গেলেন।
মুখে লেগে থাকা খুশী বিলীন হওয়ার পূর্বেই আবু হানিফা (রহিমাহুল্লাহ) বলতে শুরু করলেন, “আল্লাহর এ নিয়ম কার্যকর তাদের প্রতি, যারা ইনসাফ করতে পারে। কিন্তু কেউ যদি ভীত হয় যে সে ইনসাফ করতে পারবে না বা যদি বেইনসাফ হয়, তবে তার জন্য একটি বিয়ে ই করতে হবে। আল্লাহ বলেন,
فَاِنْ خِفْتُمْ اَلَّا تَعْدِلُوْا فَوَاحِدَةً
অর্থঃ কিন্তু যদি তোমরা তাদের সাথে ইনসাফ করতে পারবে না বলে আশঙ্কা করো, তাহলে একজনকেই বিয়ে করো।
[সূরা আন-নিসা:৪]
তাই আমাদেরকে আল্লাহর এ বিধান মেনে চলতে হবে।”
আল মানসূর নির্বাক হয়ে বসে রইলেন। এবং আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) স্থানত্যাগ করলেন।
পরবর্তীতে খলীফার স্ত্রী খুশী হয়ে তাকে অনেক উপঢৌকন পাঠালেন কিন্তু গ্রহণ না করে তিনি তা ফিরিয়ে দেন। কেননা, এই রায় তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি পাবার জন্য দিয়েছেন, কোনো মানুষের সন্তুষ্টি পাবার জন্য নয়!
খলিফা আল মানসূরের একজন জেনারেল, হাসান, ইমাম আবু হানিফার (রাহিমাহুল্লাহ) কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করেন এবং কোন মুসলিমকে হত্যা না করবার দৃঢ় সংকল্প করেন। খলীফা তাঁকে বিদ্রোহীদের নির্মূল করবার নির্দেশ দিলে তিনি অস্বীকার করেন। পরবর্তীতে খলীফা লোকেদের থেকে জানতে পারেন যে হাসান, আবু হানিফার (রহিমাহুল্লাহ) থেকে দীক্ষা নিয়েছে। যদিও ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) একজন ফক্বীহ ছিলেন এবং তাঁর কাজ অনেকটা ফতোয়া প্রদানের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো- তবু খলীফা তাঁকে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের হুমকি স্বরূপ দেখতে লাগলেন। তাই তিনি তার বিশ্বস্ততা পরীক্ষা করতে চাইলেন।
এই পরীক্ষা থেকে ইমাম আবু হানিফার (রাহিমাহুল্লাহ) বিচক্ষণতার এক চমৎকার উদাহরণ পাওয়া যায়। খলীফা তাকে ডেকে প্রধান ক্বাজীর পদ দিতে চাইলেন। কিন্তু তিনি এটি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। তিনি বললেন, ‘আমি এই পদের জন্য যোগ্য নই।’ এ কথা শুনে খলীফা বললেন, ‘আপনি মিথ্যে বলছেন! অবশ্য ই আপনি এ পদের উপযুক্ত!’
এবার আবু হানিফা (রহিমাহুল্লাহ) বললেন,
‘যদি আমি মিথ্যে বলে থাকি; তাহলে বলতে হবে যে কোন মিথ্যেবাদীকে আপনি ক্বাজীর পদে নিযুক্ত করতে পারেন না। এবং আমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাকি, তাহলে এটাই সত্যি যে আমি এই পদের জন্য উপযুক্ত নই। ’
খলিফা যেন তাকে কোনোভাবেই বশে আনতে পারছেন না। রাগে-ক্ষোভে খলিফা আল মানসূর তাঁকে কারাবন্দী করেন এবং তাঁকে সেখানে চাবুকপেটা করার নির্দেশ দেন। এ শাস্তির উদ্দেশ্য ছিলো এই যে, তিনি যেনো ক্বাজী হবার প্রস্তাব মেনে নেন। কিন্তু তিনি এ প্রস্তাব মেনে নেন নি।
তাঁর মৃত্যু সম্বন্ধে রয়েছে বহু মতভেদ। কেউ বলেন, কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করার পর স্বাভাবিক ভাবেই তিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে এ দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। কিছু মত অনুযায়ী, তাঁকে কারাগারে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি ১৫০, মতান্তরে ১৫৩ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। বাগদাদে মারা যান এবং সেখানেই তাঁকে কবরস্থ করা হয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি অসিয়্যত করে গিয়েছিলেন যেনো কোনো জালিম শাসকের ভূমিতে তাঁকে কবর না দেয়া হয়। এ সম্বন্ধে জ্ঞাত হয়ে খলীফা আল মানসূর বলেন- ‘আবু হানিফার হাত থেকে আমায় রক্ষা করার কে আছে? যখন সে বেঁচে ছিলো তখন সে আমার বিরুদ্ধে ছিলো এবং এখন সে মৃত্যু বরণ করেছে, তবুও!’
আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) ছিলেন বেশ দীর্ঘাকায়, সৌম্যদর্শন, তামাটে বর্ণের। তাঁর কপালে সিজদাহর চিহ্ন বিদ্যমান ছিলো। গন্ডদেশে ছিলো রাতের পর রাত আল্লাহর স্মরণে অশ্রুসজল হবার দাগ। সবসময় পরিপাটি রূপে পোশাক পরিধান করতেন। মূল্যবান, সুগন্ধিযুক্ত আতর ব্যবহার করতেন। সর্বদা হাসিখুশি ও প্রাণোচ্ছল থাকতেন।
ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) হলেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রাদ্বি আল্লাহু আনহু) কুফায় ইলমের জন্য গড়ে যাওয়া লিগ্যাসির অন্যতম কর্ণধার।