হিদায়েত পরবর্তী জীবন
– “তোকে ইচ্ছে মতো ঝাড়ুর বারি দিতে মন চাচ্ছে এখন আমার” রাগে গিজগিজ করতে করতে বললেন মরিয়ম বেগম।
– কেনো আম্মু কী করেছি আমি!
– তোকে কতবার ডাকলাম আমি। তুই রুমের দরজা বন্ধ করে বসে ছিলি কেনো ? কেনো এলি না ওনাদের সামনে? এতোদিন পর তোর ফুফাতো ভাই, ফুফা এসেছে। তোকে একটু দেখতে চেয়েছিলো ওনারা। কী এমন হতো ওনাদের সামনে গেলে!
– আম্মু ওনারা তো আমার জন্য নন মাহরাম। আমি আগেই তোমাকে বলেছি আমি ওনাদের সামনে যাবো না। তুমি ডাক দিয়েছো বলে আমি ডাইনিং রুমে গিয়ে নাস্তা রেডি করে দিয়ে আমার রুমে চলে এসেছি। আসার সময় তোমাকে বলেও এসেছি যে আমি ওনাদের সামনে যাবো না তারপরও কেনো ডাকাডাকি করছিলে তুমি!
– ওনারা কতোদিন পর এসেছে আমাদের বাসায়। তোর ফুফাতো ভাই বললো কতদিন দেখে না তোকে। তাই আমি ডাক দিয়েছি তোকে। তুই কিনা সোজা তোর রুমে এসে দরজা বন্ধ করে বসে রইলি। ওনারা কি ভাবলো আমাদের। ছিঃ ছিঃ ওনাদের সামনে এভাবে অপমান করলি তুই আমাদের!
– আম্মু আমি তো তোমাদের অপমান করার জন্য কিছু করি নি। ওনাদের সামনে গেলে আমার গুনাহ্ হবে তাই আমি যাই নি। তোমাদের অপমান করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না আমার।
– এতো অপমান করার পরও মেয়ের শান্তি হয় নি। আবারও মুখে মুখে তর্ক করছে!
তারেক এখানে আয় তো…
মায়ের ডাক শুনে তড়িঘড়ি করে ফাহমিদার রুমে এলো তারেক।
– তারেক তুই একটু বুঝা তো তোর বোনকে। ও এসব কি শুরু করেছ! আর এটা ও জিজ্ঞেস কর, সে আর কতদিন এরকম করবে!
“তুই যখনই পর্দা করতে চেয়েছিস আমরা তোকে কখনও বাঁধা দেই নি। তুই যখন বলেছিস তোর খিমার লাগবে আমি দোকানে গিয়ে সাথে সাথে কিনে এনেছি তোর জন্য। আমি, আম্মু কখনো তোকে পর্দা করতে না করি নি কিন্তু তুই আজকে যা করেছিস মোটেও ঠিক করিস নি।” কথাগুলো একদমে বললো তারেক।
– ভাইয়া আমি অনেক খুশি যে তোমরা আমাকে সবসময় পর্দা করতে সাপোর্ট করেছো কিন্তু এখন কেনো আমাকে নন মাহরামের সামনে যাওয়ার জন্য এতো জোর করছো!
– ফুফা, সেই ছোটবেলা থেকে তোকে দেখছে। কত আদর করে তোকে। তার সামনে যেতেও তোর এতো সমস্যা! বাহিরের মানুষের সামনে যাবি না ঠিক আছে কিন্তু ওনারা তো আমাদের আপনজন। আমাদের কাছের মানুষ। ওনাদের সামনে যেতে তোর এতো কিসের সমস্যা আমি তো বুঝতে পারছি না!
– ভাইয়া ওনারা আমাদের কাছের মানুষ, আপনজন ঠিক আছে কিন্তু ওনারা আমার জন্য নন মাহরাম। আর নন মাহরামের সামনে পর্দা করতে হয়।
– তুই কিন্তু এবার অনেক বাড়াবাড়ি করছিস ফাহমিদা। এতোদিন কিছু বলি নি দেখে যে আজও বলবো না তা কিন্তু না। এটা ভুলে যাস না যে আমরা একটা সমাজে বসবাস করি। আমাদের সবার সাথে মিলেমিশে চলতে হয়। তুই যা শুরু করেছিস মানুষ তো কিছুদিন পর আমাদেরকে অসামাজিক বলবে। ফুফু যাওয়ার সময় বলেও গিয়েছে, “ও এমন হলো কবে থেকে! আমাদের সামনে এলে ওর কি এমন পর্দার খেলাফ হবে!”
– অসামাজিক হলে হলাম। আমি আমার রবের সন্তুষ্টির জন্য সব করতে রাজি আছি।
– “আগেই তো ভাল ছিলি সবার সাথে কি সুন্দর হেসে হেসে কথা বলতি, দুষ্টুমি করতি।
আর কোন কথা শুনতে চাই না আমি। শেষবারের মতো বলছি তোকে, এসব বাড়াবাড়ি বাদ দিয়ে আগের মতো হয়ে যা।” কথাগুলো বলে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো তারেক।
কিছুদিন আগে দ্বীনের পথে ফিরেছে ফাহমিদা। বেদ্বীন পরিবার থেকে দ্বীনে ফিরলে সবাইকে যেমন যুদ্ধ করতে হয় ফাহমিদার বেলাও এর ব্যতিক্রম হয় নি। পর্দা করার বেলায় পরিবার থেকে সাপোর্ট পেলেও মাহরাম-নন মাহরাম মেনে চলার ব্যপারে তাদের কাছ থেকে সাপোর্ট পায় নি সে।
কারণ তারা তো জানেই না মাহরাম- নন মাহরাম কি জিনিস! এজন্য তাদের অনেক কথা শুনতে হয় তাকে। মাঝেমাঝে তার মা, ভাই মিলে অনেক বকাঝকা করে তাকে। খুব কষ্ট হয় তার। সে ভাবে, ইশ তার পরিবার যদি তাকে একটু সাপোর্ট করতো তাহলে তার জন্য পুরোপুরি পর্দা করা কতোটা সহজ ই না হতো!
তার খুব মন খারাপ, খুব কান্না পাচ্ছে তাই বান্ধবী হাবিবাকে মেসেজ দিলো।
– আসসালামু আলাইকুম, হাবিবা। কেমন আছিস?
– ওয়া আলাইকুমুস্ সালাম, ফাহমিদা। আলহামদুলিল্লাহ ভাল। তুই কেমন আছিস?
– এইতো আলহামদুলিল্লাহ। আমার মতো নতুন দ্বীনে ফেরা মেয়েরা পরিপূর্ণ পর্দা করার জন্য যদি পরিবার থেকে সাপোর্ট পেতো, তাহলে আমাদের জন্য পর্দা রক্ষা করা কতটা সহজ হতো তাই না?
– হঠাৎ এই কথা বললি? কিছু হয়েছে?
– না তেমন কিছু না। আমার মাহরাম- নন মাহরাম মেনে চলতে খুব সমস্যা পোহাতে হয়।
– ওওও এই কথা! আচ্ছা শুন তাহলে। তুই কিছুদিন হয় দ্বীনের পথে এসেছিস। আর তোর পরিবার তো তেমন দ্বীনদারও না তাই এ সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই।
জান্নাত কি এতো সহজ বল! জান্নাতে যেতে হলে তো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। জান্নাত এতো সহজ হলে তো সবাই জান্নাতে যেতে পারতো। তাই জান্নাতে যেতে হলে আল্লাহর সব পরীক্ষায় ধৈর্যের সহিত উত্তীর্ণ হতে হবে।
যেকোনো পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। উত্তম কিছু পেতে হলে তার জন্য তো একটু কষ্ট করতেই হয়। হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না। আল্লাহর রহমত থেকে কখনো নিরাশ হবি না। আল্লাহ যদি না চাইতেন তাহলে কি তুই দ্বীনের পথে আসতে পারতি বল?!
– না কখনো না। আল্লাহ চেয়েছেন বলেই আমি দ্বীনের পথে এসেছি। আমাকে আরও ধৈর্য ধারণ করতে হবে। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে। ইন শা আল্লাহ তিনিই সব সহজ করে দিবেন আমার জন্য।
– এইতো তুই বুঝেছিস আমার কথা। এখন বেশি বেশি করে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে থাক ইন শা আল্লাহ তিনি তোকে খালি হাতে ফেরাবেন না। তিনি “হও” বললেই তা হয়ে যায়। তাই নিরাশ হওয়া চলবে না।
– ইন শা আল্লাহ আমি আর নিরাশ হবো না। অনেক অনেক শুকরিয়া হাবিবা। তুই আমার মনের জোর অনেকটা বাড়িয়ে দিলি। আল্লাহ তোকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
– আল্লাহ তোকেও উত্তম প্রতিদান দান করুন। ভাল থাকিস।
হাবিবার সাথে কথা বলার পর অনেকটা ভাল লাগছে ফাহমিদার। জায়নামাজ বিছিয়ে বসে পড়লো রবের সামনে।
মোনাজাতে হাত বিছিয়ে ইচ্ছেমতো চোখের পানি ফেলছে আর বলছে, “হে রহমান, হে রহিম! তুমি তো চাইলে যেকোন সময় তোমার বান্দার অন্তর পরিবর্তন করে দিতে পারো যেমনটা আমার বেলায় করেছো। আমিও তো আগে এমন ছিলাম না। তোমার এক গাফেল বান্দা ছিলাম। তুমি চেয়েছো বলেই আমি দ্বীনের পথে ফিরে এসেছি।
রব তুমি আমার অন্তর যেভাবে পরিবর্তন করেছো আমার মা, ভাইয়ের অন্তরও সেভাবে পরিবর্তন করে দাও।” বাচ্চাদের মতো বায়না ধরে রবের কাছে চাইছে সে। তার দোয়া কবুল না হওয়ার আগ পর্যন্ত এভাবেই সে রবের সামনে চাইতে থাকবে। বাচ্চাদের মতো কেঁদে কেঁদে চাইবে।
কারন সে জানে, যখন তাঁর কোনো বান্দা তাঁর প্রতি হাত উঠায়, তখন তিনি খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন। আল্লাহ তাকেও খালি হাতে ফেরাবেন না ইন শা আল্লাহ।
কিছুদিন পর ফাহিমাদার চাচাতো ভাই এলো তাদের বাসায়। দরজা খোলা পেয়ে হঠাৎ করেই ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেন তিনি। ফাহমিদা খেয়াল করে নি। কিন্তু তার মার চোখে পড়ার সাথে সাথে তাকে তার রুমে চলে যেতে বলেন তিনি।
তারপর তার মা কথা বলেন তার চাচাতো ভাই এর সাথে। সে ফাহমিদাকে দেখতে চাইছে আর সাথে এটা ও জানায়, তার কিছু জরুরী কথা আছে ফাহমিদার সাথে। তার মা বললো, “ও তো তোমার সামনে আসবে না। বেশি জরুরী হলে আমার কাছে বলতে পারো আমি বলে দিবো ওকে।”
ফাহমিদার ভাই ও সেখানে উপস্থিত ছিল। সেও ফাহমিদার মায়ের কথায় সম্মতি জানায়। কথাগুলো দরজার আড়াল থেকে শুনেছে ফাহমিদা। কথাগুলো শুনে তার চোখে পানি চলে এসেছে। রব তাকে ফিরিয়ে দেয় নি। তার মা ভাইকে দ্বীনের বুঝ দান করেছেন তিনি।
তার এতোদিনের চাওয়া কবুল করে নিয়েছেন তিনি। তার দিকে ফিরে এলে তিনি কখনো তার বান্দাকে নিরাশ করেন না। হয়তো কিছুটা ধৈর্যের পরীক্ষা নেন কিন্তু তাকে কখনো খালি হাতে ফেরান না।
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ্ ঘোষণা করেন, যদি আমার বান্দা আমার দিকে এক বিঘত এগিয়ে আসে, তবে আমি তার দিকে এক হাত এগিয়ে যাই, যদি সে আমার দিকে এক হাত অগ্রসর হয়; আমি তার দিকে দু’ হাত এগিয়ে যাই। আর সে যদি আমার দিকে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে দৌড়ে যাই। ( সহীহ্ বুখারীঃ ৭৪০৫)