একজন মুসলিম বোনের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল, যিনি চার বছর পূর্বে ইয়েমেন থেকে আমেরিকায় এসে স্থায়ী হয়েছিলেন।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম-
“আমেরিকায় বসবাস শুরু করার পর সাংস্কৃতিক দিক থেকে, কোন পার্থক্যটি আপনার জন্য বেশি বিস্ময়কর ছিল? যার সাথে তাল মেলাতে আপনাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। ইয়েমেন এবং আমেরিকা- এই দু জায়গার জনজীবনের মধ্যে যে তফাত রয়েছে, তার কোন দিকটি আপনাকে বেশি নাড়া দিয়েছে?”
তিনি সহজেই উত্তর দিয়ে দিলেন: “হায়া! আমার জন্য এ বিষয়টিই সবচাইতে আশ্চর্যজনক ছিল যখন আমি প্রথম এখানে আসি। এখানে নারী কিংবা পুরুষ, কারো মাঝে ‘হায়া’ নেই। বিশেষভাবে নারীদের দেখে আমি অবাক হয়েছি।
ইয়েমেনে আমরা পুরুষদের সাথে যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করতাম। কখনো যদি নন মাহরাম পুরুষদের সম্মুখে আমাদের উপস্থিত থাকা লাগতো, তাদের সাথে আমাদের কিছুই করার ছিল না। আর কখনো যদি প্রয়োজনবশত অপরিচিত ব্যক্তির সাথে কথা বলতেই হতো, আমরা ‘হায়া’-র ঊর্ধ্বে গিয়ে তাদের চোখে চোখ রেখে কখনোই কথা বলতাম না।
কিন্তু এখানে, আমেরিকায় তারা এটা বোঝেই না। হায়া-কে তারা দূর্বলতা মনে করে। যদি আমি অপরিচিত কারো চোখে চোখ রেখে কথা বলতে দ্বিধাবোধ করি, তারা এটিকে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি বলে মনে করে। আমেরিকানদের নিকট অচেনা ব্যক্তির সাথে সাবলীলভাবে, দৃষ্টি বিনিময় করে দীর্ঘক্ষণ কথা চালিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাসের পরিচায়ক। তাই আমি যখন দৃষ্টি সরিয়ে নেই, তারা আমার জন্য দুঃখবোধ করে অথবা ভেবে নেয় যে আমার কোন অন্য সমস্যা রয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে যদি আমি তাদের সাথে কথা বলতে যাই, আমার নিজেকে প্রায় বাধ্য করতে হবে মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার জন্য।
“না, নিজের মাঝে পরিবর্তন আনবেন না।” আমি না বলে পারলাম না। “আপনিই সঠিক পথে আছেন। এটি হারাবেন না।”
তিনি হেসে বললেন, “চিন্তা করবেন না। আমি ইনশা আল্লাহ আমার ‘হায়া’ হারিয়ে ফেলবো না। কেমন করে তা হবে? নিজের মৌলিকত্বের ধারক কোনকিছুকে কি হারিয়ে ফেলা সম্ভব? একজন নারী স্বয়ং ‘হায়া’। ‘হায়া’ যদি না থাকে, তবে যে নারীত্বের আর কিছুই রইলো না।”
আমি হেসে উঠলাম। খুশিভরা মনে ভেবে আশ্চর্য হচ্ছিলাম যে, কত সরলভাবেই না তিনি সমস্যাটি বুঝতে পেরেছেন এবং একটি চমৎকার ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন।
“সেজন্যই এদেশে আসার পর আমার জন্য এটি ছিল একটি বিশাল ধাক্কা। নারীরা কিভাবে নিজেদের সজ্জিত করার ক্ষেত্রে, একে অন্যের সাথে ভাববিনিময়ের ক্ষেত্রে, কথা বলার ক্ষেত্রে, হাঁটাচলার ক্ষেত্রে ‘হায়া’-র তোয়াক্কা করছে না। যা আমাকে সর্বাধিক দুঃখিত করেছে তা হলো আমেরিকার মুসলিম মেয়েরা কিভাবে এই ‘হায়া’ খুইয়ে ফেলার যাত্রায় তাদেরই অনুকরণ করে চলছে। এটি আমি আশা করিনি।”
প্রকৃতপক্ষে এ সমস্যার বর্ধিত রূপ এবং গভীরতা সম্বন্ধে তার কোন ধারণাই নেই।
দূর্ভাগ্যবশত আমাদের কিছু তথাকথিত ‘ইসলামিক ইনস্টিটিউট’ এবং ‘সেমিনারি’ রয়েছে, যারা নিজেদের মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের ‘আমেরিকান ইসলাম’ শিক্ষা দেয়ার দাবি করে, যেখানে নারী পুরুষ অবাধে ফ্রি মিক্সিং করছেন, একত্রে ইভেন্টসমূহে ছবি তুলছেন, নারীরা তাদের জনপ্রিয় সেলিব্রিটি ‘ইমাম’ কিংবা ‘শায়খ’-দের সহিত পাশে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছেন। এবং নারী ও পুরুষেরা একে অপরের সাথে সরাসরি চোখাচোখি করে কথা বলছেন।
আপনি অবশ্যই বলতে পারবেন না যে তাদের মাঝে ‘আত্মবিশ্বাসের’ অভাব রয়েছে। কিন্তু তাদের এই অর্জন ‘হায়া’ খুইয়ে ফেলার কাছে কিছুই না।
الحياء শব্দের যুৎসই বাংলা কিংবা ইংরেজি শব্দ আসলে খুঁজে পাওয়া ভার। কাছাকাছি অর্থ পাওয়া যায়- লজ্জা, বিনয়, শালীনতা, নম্রতা। ‘হায়া’ বলতে বোঝায়- প্রকৃতিগত, অন্তর্বর্তী একটি বোধ বা চেতনা, যা সমস্ত খারাপ কিছু হতে দূরে রেখে ভালোকিছুর দিকে মানুষকে ধাবিত করে।
তাই রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
الحَياءُ خَيْرٌ كُلُّهُ.
“লজ্জাশীলতা বা হায়ার পুরোটাই কল্যাণকর। অথবা ‘হায়া’ স্বয়ং কল্যাণ বয়ে আনে।”
সীরাহ থেকে দেখা যায়,
ইবনু উমার বর্ণনা করেন, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন আনসারীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন যে তার ভাইকে অধিক ‘হায়া’-র কারণে তিরস্কার করছিলেম। তখন নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ছেড়ে দাও তাকে তার মতো। কেননা, ‘হায়া’ ঈমানের অংশ।”
এটি অন্তরের একটি বৈশিষ্ট্য, যা অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে উদ্ভাসিত হয়। এমন একটি চমৎকার বিষয়, যা হৃদয় থেকে অংকুরিত হয়ে বিস্তৃত হতে থাকে। মুসলমানদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই ‘হায়া’। যেকোনো বিশ্বাসী নারী পুরুষের মাঝে অবশ্যই ‘হায়া’-র উপস্থিতি অনিবার্য।
মূল: উম্মে খালিদ