গরু খাওয়া মুসলমান

আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ছিলেন ইহুদি। শুধু ইহুদি না, মদীনার ইহুদি স্কলারদের মধ্যে একেবারে শীর্ষ সারিতে। অনেকটা বলা যায় যে, মদীনার ইহুদিদের গ্র্যান্ড ইমাম টাইপের।

তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন দুটো কাজ আগের মতো অব্যাহত রাখেন। অর্থাৎ, দীর্ঘদিন ধরে ইহুদি ধর্মের অনুসারী, স্কলার হিশেবে যেসব আচারে অভ্যস্ত ছিলেন, ইসলাম গ্রহণ করেও সেগুলো করেন। সেগুলো ছিলো:

শনিবারে কোনো কাজকর্ম করতেন না (ইহুদি ধর্মানুযায়ী সাপ্তাহিক ছুটি পালন)
উটের মাংস খেতেন না (ইহুদি ধর্মে উটের মাংস নিষিদ্ধ ছিলো)

এই কাজগুলো আপাত দৃষ্টিতে খুবই গর্হিত মনে হবে না। কারণ, তিনি ইসলাম গ্রহণ করার পর মূর্তিপূজা করছেন না, আল্লাহর সাথে শিরক করছেন না, মুসলিমদের বিপক্ষে ইহুদিদের সহযোগিতা করছেন না, ভ্রান্ত কোনো আকীদাও পোষণ করছেন না। দীর্ঘদিনের অভ্যাসবশত তিনি ঐ দুটো কাজ করছেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে সালামের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এমন কাজের ফলে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে একটি আয়াত নাযিল করেন। [Asbab al-Nuzul, al-Wahidi, Page 18]

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইসলামে পূর্ণরূপে প্রবেশ করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।”
[সূরা বাকারা ২: ২০৮]

এই আয়াতটি আমরা অনেকেই পড়েছি, কিন্তু আমরা হয়তো জানি না যে এই আয়াতের প্রেক্ষাপট ছিলো একজন সাহাবীকে নিয়ে। ঐ সাহাবী কিন্তু ইসলামের কোনো ব্যাপারে দ্বিমত করেননি, নামাজ ৪ ওয়াক্ত পড়ে ১ ওয়াক্ত না পড়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেননি। শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক জায়গা থেকে অভ্যাসবশত আগের কাজগুলো করে যান।

ইসলামি সংস্কৃতির সাথে তিনি সম্পূর্ণ একাত্মতা পোষণ না করায়, ইসলামি সংস্কৃতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারায় আল্লাহ জানিয়ে দিচ্ছেন যে- ‘তিনি সম্পূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করেননি’। তিনি যেনো সম্পূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করেন, সেজন্য আল্লাহ তাঁকে সহ পরবর্তীতেও যারা ‘আধা মুসলমান’ হতে চাইবে তাদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছেন এই আয়াতে।

গরু খাওয়া সম্পূর্ণ হালাল। আপনি এই হালাল খাবার যেমন খুব পছন্দ করে খেতে পারেন, তেমনি ব্যক্তিগত কারণে যদি গরু খাওয়া অপছন্দ করেন (যেমন: আপনার এলার্জি সমস্যা, শুটকি যেমন অনেকেই পছন্দ করে না, গরুও তেমন আপনি পছন্দ করেন না) সেক্ষেত্রে ইসলাম আপনাকে চাপ প্রয়োগ করে না। ইসলাম আপনাকে জোর করে গরু খেতে বাধ্য করে না। কোনো হালাল খাবার খাবেন কি না খাবেন সেটার সম্পূর্ণ এখতিয়ার আপনার আছে।

কিন্তু, আপনি যদি ধর্মান্তরিত মুসলিম হন, মুসলিম হবার পর আগের ধর্মানুভূতি থেকে (ব্যক্তিগত অপছন্দ না) গরু না খান, তাহলে কিন্তু সেটা সিরিয়াস সমস্যা। তারউপর যদি আপনি মনে করেন যে, আপনি ‘সামাজিক সম্প্রীতির’ জন্য, নিজেকে একটু ‘অসাম্প্রদায়িক’, একটু Cool প্রমাণের জন্য, আরেক সম্প্রদায়ের কাছে ভালো সাজার জন্য গরু খাবেন না, তাহলেও কিন্তু উপরের আয়াত নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে হবে। আপনার কাজকর্ম সেটাকেই ইঙ্গিত করছে কিনা নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

গরু খাওয়া উপমহাদেশের মুসলমানের অন্যতম স্বকীয়তা, অন্যতম আত্মপরিচয়। মুসলমানিত্বের নিদর্শন হিশেবে টুপি, দাড়ি, জোব্বাকে ধরা হয়। এগুলো দেখে বাহ্যিকভাবে মুসলমানকে চিহ্নিত করা যায়। ইসলাম পৃথিবীর যেখানেই গিয়েছে, সেখানে ‘মুসলমানিত্বের নিদর্শন’ হিশেবে ঐ সংস্কৃতির কোনো না কোনো উপাদানকে আত্মীকরণ করেছে।
উপমহাদেশের মুসলমানকে গরু খাওয়ার জন্য জীবন দিতে হয়েছে। শুধুমাত্র গরু খাওয়ার ‘অধিকার’ আদায়ের জন্য যুদ্ধ করতে হয়েছে।

১.
সুলতান শামস-উদ-দীন ফিরূজ শাহের সময়ে সিলেটের রাজা ছিলেন গৌর গোবিন্দ। গৌর গোবিন্দের রাজ্যে বোরহান উদ্দিন নামের একজন মুসলমান তাঁর ছেলের আকিকার জন্য একটি গরু জবাই করেন। হিন্দুদের কাছে গরু শ্রদ্ধার পাত্র। রামরাজ্যে যদি গরু জবাইয়ের খবর শোনা যায় তাহলে তো প্রাণ যায় যায় অবস্থা।

বোরহান উদ্দীনের জবাই করা গরুর গোশত একটা চিল মুখে করে রাজার মন্দিরে নিয়ে ফেলে দেয়। গৌর গোবিন্দের রাজ্যে গরু জবাই করার এমন স্পর্ধা দেখে রাজা ক্ষেপে গেলেন। রাজার নির্দেশে বোরহান উদ্দিনের হাত কেটে ফেলা হয় এবং তাঁর নিষ্পাপ সন্তানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

বোরহান উদ্দিন তাঁর সাথে করা জুলুমের কথা জানান সুলতানের নিকট। সুলতান তাঁর সেনাপতি ও ভাগিনা সিকান্দর খান গাজীকে পাঠান সিলেট আক্রমণ করে গৌর গোবিন্দের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে। একজন মুসলমানের রক্তের মূল্য অনেক বেশি। কিন্তু প্রথমবার সিকান্দর গাজী পরাজিত হন। পরেরবার সুলতান সেনাপতি নাসির উদ-দীন কে তাঁর সাহায্যের জন্য পাঠান। ঠিক এই সময়ে শাহ জালাল (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর ৩১৩ জন সঙ্গী নিয়ে বাংলায় আসেন।

বাংলায় এসেই যুদ্ধের আহ্বান পেয়ে সাড়া দেন। শাহজালালের বাহিনী আর সুলতানের বাহিনী মিলে গৌর গোবিন্দকে পরাজিত করে একজন মুসলমানের হাত কাটার প্রতিশোধ নেন। গরু জবাইয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সিলেট বিজয় হয়।

২.
বিক্রমপুরে তখন রাজা বল্লাল সেনের শাসন চলছিলো। তখন আদম (রাহিমাহুল্লাহ) নামের একজন দা’ঈ কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে বিক্রমপুর গিয়েছিলেন ইসলাম প্রচার করতে। একদিন তারা খাওয়ার জন্য একটা গরু জবাই করেন। কোত্থেকে এসে একটি কাক এক টুকরো গোশত নিয়ে উড়ে যায়। আরেকটি কাকের তাড়া খেয়ে ঐ কাকটির মুখ থেকে গোশতের টুকরো নিচে পড়ে যায়। গোশতের টুকরোটি পড়লো তো এমন জায়গায় পড়লো, যেখানে রাজা বল্লাল সেনের মিলিটারি ক্যাম্প।

সৈন্যরা বিষয়টি রাজাকে জানালে রাজা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বল্লাল সেনের রাজ্যে গো-হত্যা? রাজা তখন সৈন্যবাহিনী পাঠান আদম বাহিনীকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেবার জন্য। আদম বাহিনীও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে আত্মরক্ষায় নেমে যান। ছোট্ট একটা নিরস্ত্র দলের সাথে বল্লা সেনের সৈন্যবাহিনী চৌদ্দ দিন যুদ্ধ করেও তাঁদেরকে পরাজিত করতে পারলো না। শেষমেশ রাজা নিজেই যুদ্ধে নেমে যান। এই ছোট্ট বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে জিতবেন এই ব্যাপারে রাজা নিজেও নিশ্চিত ছিলেন না। তিনি কী করলেন, রাজধানীতে একটি অগিকুন্ড প্রস্তুত করলেন আর মহিলাদেরকে নির্দেশ দিলেন, তিনি পরাজিত হয়েছেন জানতে পারলে তারা যেন অগ্নিকুন্ডে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।

রাজা তাঁর পোশাকের নিচে একটা কবুতর লুকিয়ে রাখলেন আর মহিলাদেরকে বললেন, তারা যদি দেখতে পায় কবুতরটি আকাশে উড়ছে তাহলে যেন তারা বুঝতে পারে যে, রাজা পরাজিত হয়েছেন। বল্লাল সেন যখন যুদ্ধে নামেন, তখন একে একে মুসলিম দা’ঈরা শহীদ হতে থাকে। বল্লাল সেন বিজয় ছিনিয়ে নেন।

যুদ্ধ জয় শেষে বল্লাল সেন পুকুরে নামেন রক্তে রঞ্জিত পোশাক ধুতে। কিন্তু তিনি ভুলেই যান, তার পোশাকের ভেতর কবুতরটি আছে। যেই কবুতরটির উড়াল দেবার উপর নির্ভর করছে মহিলারা আত্মহত্যা করবে কি-না। রাজা যখন পোশাক খুললে কবুতরটি উড়াল দিয়ে চলে যায় রাজপ্রসাদে। কবুতরকে উড়তে দেখে মহিলারা ভাবলো, রাজা নিশ্চয় যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন।

তারা সবাই একইসাথে আগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দিলো। দারুণ উৎকণ্ঠা নিয়ে রাজাও ছুটলেন রাজপ্রসাদের দিকে। এসে দেখেন, সবাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যুদ্ধে জয়ী হয়েও সবাইকে হারিয়ে রাজা শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন। তিনিও ঝাঁপ দেন সেই অগ্নিকুণ্ডে। [এ হিস্ট্রি অব সুফীজম ইন বেঙ্গল, ডঃ এনামুল হক, পৃষ্ঠা ২০৮]
আমাদের সময়ে ‘গরু খাওয়া মুসলমান’ বলতে বুঝানো হয় সেই মুসলমানকে, যাকে নামাজে পাওয়া যায় না, ইসলামের অন্য কোনো ইবাদাতে পাওয়া যায় না; সে যে মুসলমান এটা বুঝা যায় তার গরু খাওয়া দেখে। অর্থাৎ, গরু খাওয়াটা হলো তার মুসলমানিত্বের সর্বনিম্ন নিদর্শন। যার ফলে ‘গরু খাওয়া মুসলমান’ শব্দটি অনেকটা গালির মতো অপমান হয়ে গেছে।

কিন্তু, উপমহাদেশের ইতিহাসে ‘গরু খাওয়া মুসলমান’ ট্যাগটি মুসলমানের সাহসিকতা, মাথা নত না করার বিষয়ে ইঙ্গিত বহন করে। অর্থাৎ, উপমহাদেশের যে মুসলমান গরু খেতো, তার মুসলমানিত্ব যেনো গর্ব করার মতো। সে কারো পরোয়া করে না, তার অনেক স্পর্ধা যে, সে গরু খাওয়াকে ভয় করে না। জমিদারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেও সে গরু খায়।

সম্রাট আকবরের সময় মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রাহিমাহুল্লাহ) যখন আন্দোলন করেন, তখন তার আন্দোলনের অন্যতম একটি শর্ত ছিলো- মুসলমানকে গরু খাবার অধিকার দিতে হবে। অন্যকে তুষ্ট করতে গিয়ে মুসলমানের এই শিয়ার (নিদর্শন) প্রকাশ করা থেকে বিরত করা যাবে না।

তিনি একটি চিঠিতে মুসলমানের দুর্দশা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে লিখেন-
“কোনো মুসলমান ইসলামের শিয়ার বা রীতি-নীতি প্রকাশ করলে তাকে হত্যা করা হয়। হিন্দুস্থানে গরু জবাই করা ইসলামের একটি বড়ো শিয়ার। কাফিররা জিযিয়া দিতে রাজি হতে পারে, কিন্তু তারা কখনো গরু কুরবানি করতে রাজি হবে না।” [দীন-ই-ইলাহী ও মুজাদ্দিদ-ই-আলফে সানী (র), ডক্টর আ. ফ. ম. আবূ বকর সিদ্দীক, পৃষ্ঠা ৪৫]
ইসলাম আমাদেরকে সংস্কৃতি সচেতন হতে বলে। মানুষের বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ হলো তার কর্ম, তার সংস্কৃতি। আপনি ‘সত্যিকারের মুসলিম’ কিনা সেটা যেমন আল্লাহ বিচার করবেন, তেমনি আপনার সাংস্কৃতিক কার্যকলাপে মুসলমানিত্ব ফুটে উঠছে কিনা সেটাও দেখতে হবে।

মুসলমান মানে শুধু অন্তরে বিশ্বাস না। আপনার কথা, কাজেও মুসলমানিত্বের ছাপ থাকতে হবে। নতুবা আপনাকে ‘ভালোভাবে ইসলামে প্রবেশ’ করতে হবে। মুসলমান মানে আত্মপরিচয়হীন কোনো ব্যক্তি না।

গোলাপের পরিচয় যেমন তার সুভাসে, মুসলমানিত্বের পরিচয় তেমনি তার সংস্কৃতিতে।

আপনি শুধু আল্লাহর কাছেই মুসলমান হবেন এমন না, আপনি মানুষের কাছেও মুসলমান বলে স্বীকৃতি পাবেন। আপনাকে মুসলিম সংস্কৃতির সাথে একাত্মতা পোষণ করেই মুসলমান হতে হবে।

আত্মপরিচয়হীন মুসলিমের মুসলমানিত্ব নিয়ে আল্লামা ইকবাল সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘জবাবে শিকওয়া’ তে লিখেন (অনুবাদ):
“চলন তোমার খ্রিস্টানী, আর হিন্দুয়ানী সে তমদ্দুন,
ইহুদিও আজি শরম পাইবে দেখিলে তোমার এসব গুণ!
হতে পার তুমি সৈয়দ, মির্জা, হতে পার তুমি সে আফগান,
সব কিছু হও, কিন্তু শুধাইঃ বলত, তুমি কি মুসলমান?”

লিখেছেন

আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

Exit mobile version