হিমস ছিলো সিরিয়ার একটি শহর, ১৫ হিজরিতে সাহাবীরা এই শহর বিজয় করেন। খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু সিরিয়া সফরের সময় হিমসের কাছে অবতরণ করেন। হিমসের লোকজনের কাছে জানতে চান-
“আপনারা আপনাদের এলাকার গরীব লোকদের একটি তালিকা প্রদান করুন।”
হিমসের লোকজন তালিকা তৈরি করে উমর ইবনুল খাত্তাবের কাছে দিলো। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু লেখাপড়া জানতেন। জাহেলি আরবে হাতেগোনা কিছু লোক লেখাপড়া জানতো। উমর ছিলেন তাদের মধ্যে একজন।
তালিকাটি পড়তে গিয়ে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর চোখ আটকে গেলো প্রথম নামে। তিনি নামটি পড়লেন, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলেন না।
তালিকার প্রথম নামটি হলো- সাঈদ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু।
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু জিজ্ঞেস করলেন, “এই কোন সাঈদ ইবনে আমর?”
লোকজন বললো, “আমাদের গভর্নর সাঈদ ইবনে আমর।”
এটা শুনে খলিফার চক্ষু চড়কগাছ! যিনি হিমসের সবচেয়ে ক্ষমতাবান, যিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভাতা পান, তিনি সবচেয়ে গরীব?
উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু জানতে চাইলেন- এটা কীভাবে সম্ভব?
লোকজন বললো, “হ্যাঁ, আমিরুল মুমিনীন। আমাদের গভর্নর এতোই গরীব যে, একাধারে কয়েকদিন তার বাড়িতে আগুন জ্বলে না (তার ঘরে রান্না হয় না)।”
খলিফা তাঁর গভর্নরের এমন দুর্দশা শুনে কান্না করে দেন। তাঁর দাড়ি ভিজে যায়।
তিনি ১০০০ দিনারভর্তি একটি থলে দিয়ে বললেন, “এটা নিয়ে যাও। তোমাদের গভর্নরকে দিও।”
১ হাজার দিনার সেই যুগে অনেক ‘টাকা’। এই অর্থ দিয়ে অনেকের একবছরের সংসার চলতে পারতো। খলিফার ভাতা ছিলো ৫ হাজার (মতান্তরে ৬ হাজার) দিরহাম। ১ হাজার দিনার মানে সেই যুগের অন্তত ১০ হাজার দিরহাম।
গভর্নরের অভাবের কথা শুনে খলিফা তাঁর জন্য ১ হাজার দিনার পাঠালেন। দিনারের থলিটি হিমসের গভর্নর সাঈদ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে গেলো।
একসাথে এতো টাকা দেখলে আমি-আপনি কী করবো?
হঠাৎ করে লটারি জিতে একসাথে ১০ লক্ষটাকা লাভের সংবাদ শুনামাত্র আমরা কী করবো?
আমরা এতো খুশি হবো, অনেক জোরে চিৎকারও দিতে পারি!
সাঈদ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন শুনলেন খলিফা তাঁর কাছে ১০০০ দিনার পাঠিয়েছেন, এটা শুনামাত্র তিনি চিৎকার দিলেন-
“ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।”
তাঁর চিৎকার শুনে ঘরের ভেতর থেকে ছুটে আসলেন তাঁর স্ত্রী। জিজ্ঞেস করলেন, “ওগো! কী হয়েছে?
আমিরুল মুমিনীন কি ইন্তেকাল করেছেন?”
“না।”
“তাহলে কী হয়েছে? মুসলিমদের ওপর কোনো বিপদ এসেছে?”
“না।”
“তাহলে আপনার কী হয়েছে?”
সাঈদ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন,
“আমার হাতে দুনিয়া চলে এসেছে! আমার পরকাল ধ্বংসের জন্য আমার ঘরে দুনিয়া চলে এসেছে!”
স্বামীর সাথে এতোদিন সংসার করেন। স্ত্রী জানেন স্বামীর মনোভাব। তিনি বললেন, “ঠিক আছে। এই দুনিয়া ত্যাগের জন্য আপনি দিনারগুলো যা ইচ্ছা তাই করুন।”
স্বামী জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কাছে কি কোনো বুদ্ধি আছে?”
স্ত্রী বললেন, “হ্যাঁ। একটি বুদ্ধি আছে।”
সাঈদ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর স্ত্রী একটি একটি কাপড় নিলেন। কাপড় কেটে দিনারগুলো ভাগ করে কাপড়ে ঢুকালেন। অতঃপর সেই থলেতে করে সেগুলো পাঠিয়ে দিলেন মুসলিম সেনাবাহিনীর কাছে; যাদের অর্থের প্রয়োজন ছিলো।
বণ্টন শেষে স্ত্রী স্বামীকে বললেন, “আল্লাহ আপনার ওপর রহম করুন! কিছু দিনার তো আমাদের জন্য রেখে দিতে পারতেন।”
সাঈদ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু জানালেন যে, তিনি আখিরাতের চেয়ে দুনিয়াকে প্রাধান্য দিতে পারবেন না।”
তাঁর নেককার স্ত্রীর প্রশংসা করতে হয়। এমন স্বামী, যিনি হালাল অর্থ ভোগ না করে দান করে দেন, এই যুগে এমন স্বামীকে যে বাক্যটি শুনতে হতো, সেটা হলো- “পাগল!”
স্বামী দুনিয়া চান না, তিনি দান করতে পছন্দ করেন এই ব্যাপারটি স্ত্রী জানতেন বলে নিজেই পরামর্শ দেন।
সম্পদ, রিজিকের ব্যাপারে স্বামী-স্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গি কাছাকাছি হলে সংসারজীবন সুখের হয়। সংসারে অভাব আসবে, প্রাচুর্য আসবে। অভাবের সময় ধৈর্যধারণ করা, একে অন্যকে দোষারোপ না করা, প্রাচুর্যের সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে একজন আরেকজনকে সহযোগিতা করা –এভাবেই তো সংসার চলবে।
সাহাবীরা দুনিয়াকে তুচ্ছ হিশেবে দেখতেন। এজন্য দুনিয়া তাদের সামনে আসতো। তারা পাত্তা দিতেন না।
আমরা দুনিয়ার জীবনকেই সবকিছু অর্জন এবং ভোগের জায়গা হিশেবে দেখি। এজন্য দুনিয়াও পাই না, আখিরাত নিয়ে ভাবতেও পারি না।
সাঈদ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন এমন ব্যক্তি, যার ব্যাপারে বলা হতো-
“তিনি দুনিয়ার বিনিময়ে আখিরাত কিনেছেন।”
তথ্যসূত্র:
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, সাহাবীদের চোখে দুনিয়া, পৃষ্ঠা ১৬৩-১৬৪, ড. আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবি, উমর ইবনুল খাত্তাব: ২/৬২, ৪১১, মুহাম্মদ আবদুল মা’বুদ, আসহাবে রাসূলের জীবনকথা: ১/১৯২-১৯৩।