গিবতের পরিচয়, গিবত কি, গিবতের ভয়াবহতা
গিবতের পরিচয়, গিবত কী
অধিকাংশ মানুষ গিবতের সংজ্ঞা জানে না। তারা অপবাদকে গিবত মনে করে। অথচ গিবত আর অপবাদ দুটো ভিন্ন জিনিস। না জানার কারণে প্রকৃত গিবতের গুনাহকে আর গুনাহই মনে হচ্ছে না। আজ আমরা গিবতের পরিচয় জানবো, ইনশাআল্লাহ।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘তোমরা কি জান, গিবত কী?’’
তারা (সাহাবিগণ) বলেন, ‘‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন।’’ তিনি বলেন, ‘‘(গিবত হলো) তোমার (ঈমানদার) ভাইয়ের সম্পর্কে এমন কিছু বলা, যা সে অপছন্দ করে।’’ তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, ‘‘আমি যা বলছি, তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে পাওয়া যায়, তাহলে কী মনে করেন?’’ তখন নবিজি বলেন, ‘‘তুমি তার ব্যাপারে যা বলছো তা যদি তার মধ্যে (আসলেই) পাওয়া যায়, তাহলেই তুমি তার গিবত করলে। আর যদি তা তার মধ্যে সেটি না পাওয়া যায়, তাহলে তো তুমি তার প্রতি অপবাদ আরোপ করলে!’’
[ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৬৪৮৭]
তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম, কারও মধ্যে দোষ-ত্রুটি থাকলে, সেটি অন্যের কাছে বললে গিবত হবে। আমরা এমন কথা কখনও বলবো না যে, ‘‘অমুক তো আসলেই এমন, তাহলে এটা বললে গিবত হবে কেন?’’ কারণ গিবত মানেই হলো, অন্যের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে বিদ্যমান কোনো ত্রুটি প্রকাশ করা।
ধরুন, কারও পোশাক আপনার পছন্দ হয়নি। তখন অন্যের কাছে বললেন, ‘‘অমুকের পোশাকটা বস্তির লোকদের পোশাকের মতো!’’ এটা নিশ্চিতভাবেই গিবত হবে। ইমাম নববির মতে, কারও চরিত্র, পোশাক, দ্বীনদারি, দুনিয়াদারি কিংবা কারও শারীরিক গঠন নিয়ে সমালোচনা করলেও গিবত হবে।
গিবত শুধু কথার দ্বারাই নয়, লিখনীর মাধ্যমে হতে পারে। এমনকি হাত-পা, মাথা বা মুখের ইশারা-ইঙ্গিতের দ্বারাও গিবত হতে পারে।
[ইমাম নববি, আল-আযকার, পৃষ্ঠা: ৫৩৪]
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সাফিয়্যাহ (রা.)-কে বিয়ে করে ঘরে আনেন, তখন আয়িশা (রা.)-কে বলেন নববধুকে দেখে আসতে। আয়িশা (রা.) নারীসুলভ ঈর্ষা থেকে মন্তব্য করেন, ‘সাফিয়্যাহ তো এই ধরনের মহিলা!’ বর্ণনাকারী বলেন, আয়িশা (রা.) হাত দিয়ে ইশারা করে সাফিয়্যাহর খাটো হওয়ার বিষয়টি বলছিলেন। তখন নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘তুমি এমন কথা বলেছো, যেটিকে কোনো সাগরের পানির সাথে মেশানো হলে, সেটি (সাগরের পানিকে) দূষিত করে দেবে!’’
[ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান: ২৫০২; ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান: ৪৯৯৪; হাদিসটি সহিহ]
এবার নিজেরাই চিন্তা করে দেখি, কতভাবে আমরা গিবতে লিপ্ত হই! আসল কথা হলো, আমরা গিবত কী, সেটাই ভালোভাবে জানি না।
গিবতের ভয়াবহতা
গিবতের ভয়াবহতা এবং শাস্তির ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসে বারবার সতর্ক করা হয়েছে। আসুন সেগুলো জানি এবং মেনে চলি।
একদিন সাহাবি আমর ইবনুল আস (রা.) এবং তাঁর সাথীরা একসাথে কোথাও যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তাঁরা একটি মৃত গাধা দেখতে পান, যেটি মরে পঁচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। আমর (রা.) গাধাটির দিকে ইশারা করে তাঁদের বলেন, ‘‘কোনো মুসলিম ভাইয়ের মাংস খাওয়ার চেয়ে এই গাধাটির মাংস খেয়ে পেট ভরা তোমাদের জন্য উত্তম।’’
[ইমাম ইবনু আবি শাইবাহ, আল-মুসান্নাফ: ২৪৯৫০; বর্ণনাটির সনদ সহিহ]
মূলত তিনি গিবতের ভয়াবহতা বুঝিয়েছেন। কুরআন মাজিদে গিবত করাকে মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন—
وَلَا یَغۡتَبۡ بَّعۡضُکُمۡ بَعۡضًا ؕ اَیُحِبُّ اَحَدُکُمۡ اَنۡ یَّاۡکُلَ لَحۡمَ اَخِیۡهِ مَیۡتًا فَکَرِهۡتُمُوۡهُ ‘‘তোমরা একে অন্যের গিবত করবে না। তোমাদের কেউ কি নিজেদের মৃত ভাইয়ের মাংস খেতে পছন্দ করবে?’’ [সুরা আল হুজুরাত: ১২]
নবি সাল্লাল্লাহি আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘মিরাজের রাতে আমি এমন এক সম্প্রদায়ের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলাম, যাদের নখগুলো তামার তৈরি আর তা দিয়ে তারা অনবরত তাদের মুখমণ্ডলে ও বুকে আঁচড় মারছিলো। আমি বললাম, হে জিবরিল! এরা কারা?’’ তিনি বললেন, ‘‘এরা সেসব লোক, যারা মানুষের গোশত খেতো (গিবত করতো) এবং তাদের মানসম্মানে আঘাত হানতো।’’
[ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান: ৪৮৭৮; হাদিসটি সহিহ]
নবি সাল্লাল্লাহি আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘অন্যায়ভাবে কোনো মুসলিমের মানসম্মানে হস্তক্ষেপ করা বৃহৎ সুদের অন্তর্ভুক্ত।’’ [ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান: ৪৮৭৬; হাদিসটি সহিহ]
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘যদি কেউ (গিবত, গালি বা অপমান করে) কারো মর্যাদা নষ্ট করে অথবা অন্য কোনোভাবে কারো প্রতি জুলুম করে থাকে, তবে সে যেন কিয়ামতের পূর্বে আজই তার থেকে মুক্তি নিয়ে নেয়। কারণ সেই দিন কোনো দিনার-দিরহাম (অর্থের বিনিময়) থাকবে না। যদি তার নেক আমল থাকে, তবে তার জুলুমের পরিমাণ অনুসারে নেক আমল নিয়ে নেওয়া হবে (এবং মজলুমকে এর দ্বারা বদলা দেওয়া হবে)। আর যদি তার নেক আমল না থাকে, তবে তার সাথির (যার অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে) পাপ নিয়ে তার কাঁধে চাপানো হবে।’’
[ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ২৪৪৯]
একদিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের প্রশ্ন করলেন, ‘‘তোমরা কি জানো, দেউলিয়া (নিঃস্ব) কে?’’ তাঁরা বললেন, ‘আমাদের মধ্যে দেউলিয়া হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যার দিরহামও নেই, কোনো সম্পদও নেই।’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘আমার উম্মাতের মধ্যে সেই ব্যক্তি হচ্ছে (প্রকৃত) দেউলিয়া, যে কিয়ামতের দিন (বহু) নামাজ, রোজা, জাকাত নিয়ে উপস্থিত হবে এবং এর সাথে (দুনিয়াতে) সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, কারো রক্ত প্রবাহিত (হত্যা) করেছে, কাউকে মারধর করেছে (সেসব অপরাধও নিয়ে আসবে)। সে তখন বসবে এবং তার নেক আমল হতে অমুক ব্যক্তি কিছু নিয়ে যাবে, তমুক ব্যক্তি কিছু নিয়ে যাবে। এভাবে সম্পূর্ণ বদলা (বিনিময়) নেওয়ার আগেই তার নেক আমল নিঃশেষ হয়ে গেলে তাদের গুনাহসমূহ তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’’
[ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৬৪৭৩]
আপনি দুনিয়াতে তার মান-সম্মান যতটুকু নষ্ট করবেন, তার চেয়ে অনেক বেশি খেসারত দিতে হবে আখিরাতে। কারণ আখিরাতে কেবল নেকির মাধ্যমে বিনিময় হবে।
আবু বাকরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুটি কবর অতিক্রম করার সময় বলেন, নিশ্চয়ই এই দুই কবরবাসীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে এবং তাদেরকে কোনো কঠিন অপরাধের জন্য শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না। এদের একজনকে পেশাবের (অসতর্কতার) কারণে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে এবং অপরজনকে গিবত করার কারণে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।
[ইমাম ইবনু মাজাহ, আস-সুনান: ৩৪৯: হাদিসটি হাসান সহিহ]