ফিতরা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন
ফিতরা দেওয়ার উপকারিতা, ফিতরা কে দেবে, কাকে দেবে, কখন দেবে, কী দিয়ে দেবে?
Table of Contents
ফিতরা দেওয়ার উপকারিতা ও কারণ:
ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাতুল ফিতর (ফিতরা) আবশ্যক করেছেন— রোজাদারকে অনর্থক ও অশ্লীল কথা থেকে পবিত্র করার জন্য এবং মিসকিনদের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য।’1
অর্থাৎ, রামাদানের ভুল-ত্রুটির প্রায়শ্চিত্ত এবং গরিবদের সাহায্য করার জন্যই ফিতরা।
ফিতরা কখন দিতে হবে?
ফিতরা আদায়ের সর্বোত্তম সময় হলো, ঈদের দিন ঈদের নামাজের পূর্বের সময়টা।
আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকজনের ঈদের নামাজে বের হওয়ার পূর্বেই যাকাতুল ফিতর (ফিতরা) আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন।’2
তবে, ঈদের ২/১ দিন আগে থেকেও আদায় করার পক্ষে সাহাবিগণের আমল পাওয়া যায়। এটিও জায়েয।
তাবি‘ঈ নাফি’ (রাহ.) বলেন, (বিশিষ্ট সাহাবি) আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা.) ঈদের একদিন বা দুইদিন আগেই তা (ফিতরা) আদায় করে দিতেন।3
রামাদানের মধ্যে বা রামাদানের আগে ফিতরা আদায়কেও অনেক আলিম জায়েয বলেছেন। তবে, আমাদের উচিত সুন্নাহর অনুসরণ করা।
কোনো জরুরি কারণবশত ঈদের নামাজের আগে ফিতরা দিতে না পারলে পরে দিলেও সেটি ফিতরা হিসেবেই গণ্য হবে। আর কোনো কারণ ছাড়া বিলম্ব করে দিলে এই ফিতরা সাধারণ দান বলে গণ্য হবে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘‘যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের পূর্বে এটি আদায় করবে, তা তার জন্য যাকাতুল ফিতর (ফিতরা) হিসেবে কবুল হবে। আর নামাজের পর আদায় করলে তা সাধারণ সাদাকাহ (দান) গণ্য হবে।’’4
ফিতরার পরিমাণ কত?
যব, কিসমিস, পনির ও খেজুর—এগুলোর কোনো একটি দিয়ে ফিতরা দিলে এক সা’ পরিমাণ দিতে হবে। আর গম দ্বারা দিলে অর্ধ সা’ দিতে হবে।
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আমরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়ে যাকাতুল ফিতর (ফিতরা) আদায় করতাম এক সা’ খাদ্য দ্বারা। আর আমাদের (ফিতরার) খাদ্য ছিলো: যব, কিসমিস, পনির ও খেজুর। [ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ১৫০৮]
অন্য বর্ণনায় অর্ধ সা’ গমের কথাও এসেছে।
উল্লেখ্য, সা’ হলো বেতের ‘কাঠা’জাতীয় একটি বিশেষ পরিমাপ একক। যেমন: আমাদের দেশে লিটার, কেজি, সের ইত্যাদি হয়ে থাকে। আর, তখনকার সময়ে অঞ্চলভেদে সা’ এর পরিমাণেও কম-বেশি হতো। ইমাম আবু হানিফা (রাহ.) ইরাকি সা’-এর পরিমাণকে স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করেছেন। সেই হিসেবে এক সা’ = ইরাকি আট রতল। [ফিকহুস সুনানি ওয়াল আসারে ড. আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাহ.)-এর টীকা অবলম্বনে]
গ্রামের হিসেবে এক সা’ = ৩ কেজি ২৭০ গ্রাম। আর অর্ধ সা’ = ১ কেজি ৬২৫ গ্রাম। তাহলে যব, কিসমিস, পনির ও খেজুর দিয়ে ফিতরা দিলে ৩ কেজি ২৭০ গ্রাম দিতে হবে। আর গম দিয়ে দিলে ১ কেজি ৬২৫ গ্রাম দিতে হবে। [মাসিক আলকাউসার]
দয়া করে সবাই খেজুরের মূল্য দিয়ে ফিতরা দেবেন না। আপনাদের যাদেরকে আল্লাহ সামর্থ্য দিয়েছেন, তারা গম, পনির, কিসমিস, যব ইত্যাদির মূল্য দিয়ে দেবেন। অর্থাৎ, দামি পণ্যগুলোর যেকোনো একটিকে স্ট্যান্ডার্ড ধরবেন। মানুষ উপকৃত হবে। সবাই যদি খেজুরের মতো স্বল্পমূল্যের জিনিসের মূল্য দিয়েই ফিতরা দিই, তাহলে তো সমস্যা।
এ বছর বাংলাদেশে কেউ যদি খেজুরের মূল্য দিয়ে ফিতরা দিতে চান, তাহলে তাকে ১১৫ টাকা দিতে হবে। গম, পনির, কিসমিস, যব ইত্যাদির মূল্য দিয়ে ফিতরা দিলে টাকার পরিমাণ বেশি হবে। সামর্থ্যবানদের উচিত এগুলো দিয়ে ফিতরা দেওয়া।
ফিতরা কি টাকা দিয়ে দেওয়া যাবে?
এ বিষয়ে ইমামগণের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। তবে, আমরা মনে করি, ফিতরা শুধু নির্দিষ্ট খাদ্যই নয়, এগুলোর সমপরিমাণ মূল্য দিয়েও দেওয়া যাবে। দুই পক্ষের বিস্তারিত আলোচনা করলে পোস্ট বড় হয়ে যাবে। তবে, সংক্ষেপে কিছু বর্ণনা তুলে ধরছি, যেগুলো দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, টাকা দিয়েও ফিতরা আদায় করা জায়েয।
আবু ইসহাক আস সাবিয়ি (রাহ.) বলেন,
‘আমি তাঁদেরকে (সাহাবি ও তাবি‘ঈগণকে) এই অবস্থায় পেয়েছি যে, তাঁরা রামাদানে সাদাকাহ (ফিতরা) অাদায় করতেন খাবার সমমূল্যের দিরহাম দিয়ে।’5
কুররা ইবনু খালিদ বলেন,
‘আমাদের নিকট খলিফাতুল মুসলিমিন উমার ইবনু আবদিল আযিযের পক্ষ থেকে পত্র আসলো যে, প্রত্যেক ব্যক্তি যেন আধা সা’ (গম) অথবা তার মূল্য আধা দিরহাম সাদাকাতুল ফিতর হিসেবে প্রদান করে।’6
হাসান বাসরি (রাহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের ক্ষেত্রে দিরহাম দিতে কোনো অসুবিধা নেই।7
এছাড়াও ইমাম আবু হানিফা, ইমাম সুফিয়ান সাওরি ও ইমাম বুখারি (রাহিমাহুমুল্লাহ) অর্থের বিনিময়ে ফিতরা আদায় জায়েয হওয়ার পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন।
কেউ কেউ এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, নবিজির সময়ে মুদ্রা ছিলো দুই রকম: দিনার (স্বর্ণের) এবং দিরহাম (রৌপ্যের)। এগুলোর মূল্য এত বেশি ছিলো যে, এক দিরহাম দিয়ে একাধিক ফিতরা হয়ে যেতো। আর, তখন দিরহাম বা দিনারের ভাঙতি ছিলো না। সর্বনিম্ন ছিলো এক দিরহাম এবং এক দিনার। তাই, তখন খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ফিতরা আদায় করা হতো। আমরা দেখেছি, পরবর্তীতে উমার ইবনু আবদিল আযিয (রাহ.)-এর সময়ে খাদ্যের মূল্য বাড়ায় এবং দিনার-দিরহামের মূল্য কমায় তিনি দিরহাম দিয়ে ফিতরা আদায়ের ফরমান জারি করেছেন।
বর্তমানে মুসলিম দেশগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে এই মত গ্রহণ করছে। এমনকি অনেক বিশেষজ্ঞ আলিম নিজেদের মত পরিবর্তন করে এই মতটি গ্রহণ করেছেন। কারণ শরিয়াহর মেজাজ এবং মানুষের কল্যাণ (মাসলাহাত) বিবেচনায় এটি অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত।
এখানে উল্লেখ্য যে, টাকার বদলে সমমূল্যের চাল-ডাল বা এজাতীয় জিনিস দিলেও সেটি বৈধ হবে এবং ফিতরা আদায় হয়ে যাবে।
ফিতরা গ্রহণকারী:
অমুসলিমদেরকে নফল সাদাকাহ দেওয়া জায়েয এবং এতে সওয়াবও রয়েছে (অর্থাৎ, সাধারণ দান-সাদাকাহ)। তবে, তাদেরকে যাকাতুল ফিতর (ফিতরা) এবং মানতের টাকা দেওয়া যাবে না। কেননা বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী, যাকাতুল ফিতর এবং মানতের টাকা শুধু গরিব মুসলিমদের হক।8
যারা যাকাত গ্রহণে যোগ্য, তারাই শুধু ফিতরা গ্রহণ করতে পারবে।9
একজনের ফিতরা এক বা একাধিক গরিবকে দেওয়া জায়েয আছে। এমনিভাবে, কয়েকজনের ফিতরা একজনকে দেওয়াও জায়েয।10
যার উপর ফিতরা ওয়াজিব:
হানাফি মাযহাবের আলিমগণের মতে, ঈদের দিন ফজরের ওয়াক্ত শুরুর সময় ঋণ থেকে মুক্ত থেকে, যে স্বাধীন মুসলিমের কাছে অত্যাবশ্যকীয় আসবাব (যথা: নিজ বাসগৃহ, ঘরের ব্যবহারের বাসন, চুলা, পরিধানের কাপড়, পড়ার বই-পুস্তক ও ব্যবহারের গাড়ি ইত্যাদি) বাদ দিয়ে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার সমমূল্য পরিমান অন্য কোনো সম্পদ থাকবে, তার উপর ফিতরা দেওয়া ওয়াজিব। টিভি, ফ্রিজ, এসি, সোফা ইত্যাদি যেগুলো শৌখিনতা হিসেবে ব্যবহার্য, সেগুলোও হিসাবে ধরা হবে।11
অর্থাৎ, তাঁরা রৌপ্যমূল্যকে স্ট্যার্ডার্ড হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়ে সাড়ে ৭ তুলা স্বর্ণ আর সাড়ে ৫২ তুলা রূপার মূল্যমান সমান ছিলো। কিন্তু বর্তমানে রূপার দাম কমে গেছে। স্বল্প আয়ের মানুষদের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে আলিমগণের একটি অংশ রূপাকে স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণের পক্ষে বলেছেন।
সামর্থ্যবান ব্যক্তি নিজ পরিবারের নাবালেগ (অপ্রাপ্তবয়স্ক) শিশুদের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করবেন। আর বালেগ (প্রাপ্তবয়স্ক) সন্তান, স্ত্রী, স্বামী, মাতা-পিতা প্রমুখের পক্ষ থেকে ফিতরা দেওয়া তার উপর ওয়াজিব নয় (বরং তারা সামর্থ্যবান হলে নিজেদের ফিতরা নিজেরাই আদায় করবে। আর সামর্থ্য না থাকলে আদায় করার প্রয়োজন নেই)। তবে, একান্নভুক্ত পরিবার হলে তাদের পক্ষ থেকে ফিতরা দিয়ে দেওয়া মুস্তাহাব বা উত্তম।12
কোনো নারী নিজে সামর্থ্যবান হলে, নিজের ফিতরা নিজেই আদায় করবেন; এটিই উত্তম। তবে, স্বামী তার ফিতরা আদায় করে দিলে, সেটি তার জন্য যথেষ্ট হবে।
প্রবাসী ব্যক্তি স্বদেশের হিসেবে ফিতরা দেবেন না। বরং যে দেশে থাকেন, সেই দেশের হিসেবে তার ফিতরা যত আসে, সেটি দিতে হবে। এবার সেই ফিতরা তিনি দেশেই বিতরণ করুন আর বিদেশেই করুন, সেটি তার ইচ্ছা।
- ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৬০৯; হাদিসটি হাসান ↩︎
- ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ১৫০৯ ↩︎
- ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৬১০; বর্ণনাটি সহিহ ↩︎
- ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান: ১৬০৯; ইমাম ইবনু মাজাহ, আস-সুনান: ১৮২৭; হাদিসটি হাসান ↩︎
- ইমাম ইবনু আবি শাইবাহ, আল-মুসান্নাফ: ১০৪৭২; ইমাম ইবনু যানজুইয়া, আল-আমওয়াল: ৩৪৫৪; বর্ণনাটির সনদ সহিহ ↩︎
- ইমাম ইবনু আবি শাইবাহ, আল-মুসান্নাফ: ১০৪৭০; বর্ণনাটির সনদ সহিহ ↩︎
- ইমাম ইবনু আবি শাইবাহ, আল-মুসান্নাফ: ১০৩৭০; বর্ণনাটির সনদ সহিহ ↩︎
- মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহ: ১০৫১২; বাদায়িউস সানায়ে’: ২/১৬১; রাদ্দুল মুহতার: ২/৩৬৯ ↩︎
- রাদ্দুল মুহতার: ২/৩৩৯ ↩︎
- ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/১৯৩ ↩︎
- ফাতাওয়া তাতারখানিয়া: ৩/৪৫৩; বাদায়িউস সানায়ে’: ২/২৯৭; নুরুল ইজাহ: ২৬৩ ↩︎
- ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/১৯২; রাদ্দুল মুহতার: ২/৩৫৯-৩৬০ ↩︎