Writing

ফেরেশতাদের বিচরণ – পর্ব – ০২

একাকি নির্জন ঘর! একজন হয়তো ভেবে নিয়েছে কোনো এক গোপন পাপে লিপ্ত হবে আর হয়তো পাপে লিপ্ত হতে প্রস্তুতপ্রায়; ঠিক এমনই এক মুহূর্তে তার অন্তর রবের কথা স্মরণ করে এবং সেই ব্যক্তি পাপ করা থেকে সরে আসে।
গুনাহ করতে চাওয়ার তীব্র বাসনা মনে থাকার পরেও একদল মানুষ রয়েছেন যাদের অন্তর আল্লাহর শাস্তি, দান, ভয় প্রদর্শন ইত্যাদি স্মরণ করে। ফলে তৎক্ষণাৎ তারা তাওবাহ করে এবং আল্লাহর দিকে ঝুঁকে পড়ে।
সাথে সাথে তাদের অন্তর্দৃষ্টি খুলে যায় এবং সঠিক পথে ফিরে আসেন। আল্লাহ তার এমন মুত্তাকী বান্দাদের সম্পর্কে বলেছেন,

إِنَّ الَّذِينَ اتَّقَوْا إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِّنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوا فَإِذَا هُم مُّبْصِرُونَ
নিশ্চয় যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে যখন তাদেরকে শয়তানের পক্ষ থেকে কোন কুমন্ত্রণা স্পর্শ করে তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে। তখনই তাদের দৃষ্টি খুলে যায়।
(সূরা আল আরাফ-২০১)

সুতরাং, কোনো গুনাহতে লিপ্ত হওয়ার সময় আপনার অন্তর যদি রবের কথা স্মরণ করে তাহলে থামুন! সেখান থেকে সরে আসুন। দ্বিতীয়বারের জন্য ভাবতেও যাবেন না যে ‘পাপটা করে ফেলি, তারপর না হয় ইস্তিগফার করবো’; না!

নিজেকে সামলে নিন আর সাথে সাথে নিজেকে ভিন্ন কিছুতে ব্যস্ত হয়ে যান। কিন্ত কখনো কখনো গোনাহ তো হয়েই যায়। শয়তানের ধোঁকায়, নফসের প্ররোচনায়, ইচ্ছায়, অনিচ্ছায়- গোনাহ হয়েই যায়। আর ক্ষণিকের প্রশান্তির জন্য বান্দা গুনাহ করে ফেলে।

যখন একজন মুমিন প্রথমবারের মতো নিজের নফসের বিপরীতে গিয়ে পাপ করেই ফেলে মুহূর্তে তার নিজের কাছে নিজেকে নিকৃষ্ট, অপবিত্র মনে হতে থাকে; এই অনুতপ্তের সুক্ষ্ম শিখা কখনো একজন ব্যক্তিকে হয়তো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার নিকটে নিয়ে যায় কিংবা অভ্যাসে পরিণত করে শয়তানের পদচারণায় চলতে সাহায্য করে।

নিত্যদিনের এসব সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম পাপ যার বিরুদ্ধে আপনি আপনার নফসের সাথে নীরব যুদ্ধ করে যাচ্ছেন, এমন এক রণক্ষেত্র যেখানে আপনার বিপরীতে সৈন্য স্বরূপ দাঁড়িয়ে রয় হাজারো ফেতনা; সেখানেই খুব নিবিড়ভাবে আমাদের কাঁধে থাকা দুই ফেরেশতার সম্পর্ক রয়েছে।

কুরআনুল কারিমের অনেক আয়াত ও প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনেক হাদিস থেকে জানা যায় যে, আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক মানুষের সঙ্গেই তার সব ভালো-মন্দ লেখার জন্য ফেরেশতা নিয়োগ করেছেন। কুরআনুল কারিমে ‘কেরামান কাতিবিন বা সম্মানিত লেখকগণ’ হিসেবে তাদের আখ্যায়িত করেছেন। হাদিসের এক বর্ণনা থেকে পাওয়া যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম বলেছেন,

যখন দুই ফেরেশতা ডানে ও বামে বসে তার আমল গ্রহণ করে। সে (মানুষ) যে কথাই উচ্চারণ করে, তাই গ্রহণ করার জন্য তার সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছে।
(সুরা ক্বাফ : আয়াত ১৭-১৮)

আবু সুফিয়ান (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
যখন কোনো ব্যক্তি ভালো কাজ করার ইচ্ছে করে তখন তার নফস থেকে সুগন্ধি ছড়াতে থাকে এবং যখন কোনো ব্যক্তি খারাপ কাজ করার ইচ্ছে করে তখন তার নফস দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে।
(মাজমু আল ফাতাওয়া)

অর্থাৎ,আপনি যখন ভালো কাজ করার নিয়ত করেন ফেরেশতারা তা আপনার আমল নামায় লিখে ফেলেন। কিন্তু যখন আপনার নফস খারাপ কাজ করতে চায় তখন? সুবহানাল্লাহ!
ঠিক এমন এক মুহূর্তে আমরা কিছুটা ব্যতিক্রম দেখতে পারি। কারণ একজন মুমিন ব্যক্তি পাপ করার পর অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে পারে। এ জন্য ফেরেশতারা পাপ কাজ সংঘটিত হওয়ার পর কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কেউ যদি তার কৃত পাপের জন্য লজ্জিত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় তবে ফেরেশতারা ওই পাপ তার আমলনামায় লেখেন না, বরং ছেড়ে দেন।

হাদিসে এসেছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
কোনো মুসলিম বান্দা গোনাহ করার পর ডান কাঁধের ফেরেশতা ছয় ঘণ্টা গোনাহ লেখা থেকে কলম উঠিয়ে রাখেন (অর্থাৎ গোনাহ লেখেন না)। যদি সে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় তাহলে ফেরেশতা গোনাহ না লিখে ছুড়ে ফেলে দেন, অন্যথায় একটি গোনাহ লেখা হয়।’
(সহিহ আল জামে)

আর এই ছয় ঘন্টা বলতে দুনিয়াবি সময়ের ৬০ মিনিটকে নয় বরং ছয়টা নির্দিষ্ট সময় বোঝানো হয়েছে। আর পাপ করার পর নির্ধারিত সময়ে ক্ষমা প্রার্থনায় সে পাপ আমলনামায়ও লেখা হয় না বরং মুছে ফেলা হয়। কিন্তু কি হবে যদি একজন মানুষ পাপ করে ফেলে এবং তার জন্য অনুতপ্ত না হয় আর নির্দিষ্ট সময় পর সেই পাপ তার আমলনামায় লেখা হয়ে যায়?
ঠিক এমন অবস্থাতে আমরা হাদিসের দিকে তাকালে দেখতে পারবো, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম তার প্রিয় সাহাবি আবু যর রাদিআল্লাহু আনহু-কে বলেছেন,

হে আবু যর! যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় কর এবং কোনো পাপ হয়ে গেলেই নেক আমল কর; তা তোমার পাপ মিটিয়ে দিবে।
(জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৮৭)

অতএব, কোনো ব্যক্তি খারাপ কাজ করার পরপরই যদি তাওবা করে এবং আল্লাহ আয ওয়া জাল এর নিকট প্রত্যাবর্তন করে তাহলে তার আমলনামা থেকে পাপ কাজটি মুছে ফেলা হয়। উপরোন্তু তার আমলনামায় তাওবা, ইস্তিগফার করার নেকি যুক্ত হয় সুবহানাল্লাহ!
হাদিসে কুদসিতে এসেছে-হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রভূর সূত্রে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,

যদি কোনো ব্যক্তি পাপ কাজের ইচ্ছা পোষণ করে এবং তা সম্পাদন না করে, তবে আল্লাহ তাআলা তার সে কাজের বিপরীতে তার আমলনামায় একটি পূর্ণ নেকি লিপিবদ্ধ করেন।আর যদি সে ইচ্ছা পোষণের পর খারাপ কাজটি সে করেই ফেলে তাহলে আল্লাহ তাআলা তার আমালনামায় শুধুমাত্র একটি পাপই লিখে রাখেন।
যে ব্যক্তি কোনো সৎ কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করে কিন্তু বাস্তবে তা সম্পাদন করেনি, আল্লাহ তাআলা ওই ব্যক্তির আমলনামায় (ফেরেশতাদের) একটি পূর্ণ নেকী লিপিবদ্ধ করার আদেশ দেন। আর সৎ কাজের ইচ্ছা পোষণের পর যদি ওই কাজটি সম্পাদন করা হয়, তাহলে আল্লাহ তাআলা তার আমলনামায় ১০টি নেকী থেকে শুরু করে সাতশ’ নেকী এমনকি তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি নেকী লিপিবদ্ধ করে দেন।
(বুখারি ও মুসলিম)

গোনাহ যেন মুমিনের কাছে মাথার উপর পতনোন্মুখ বিশাল পাহাড়, যে কোনো মুহূর্তে তা ধ্বংস করে দিতে পারে তাকে। কিন্তু আশার কথা হল, আল্লাহ বান্দার জন্য রেখেছেন পাপ মোচনের অগণিত পথ। সুতরাং যদিও একজন ব্যক্তির প্রতিটি কথা, কাজ সাথে সাথে লিপিবদ্ধ হয়ে যায় কিয়ামত পর্যন্ত তবুও আল্লাহ যিনি আল গাফফুর সময়ে সময়ে ফেরেশতাদ্বয়কে তাদের কলম উঠিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়ে বলেন-

দেখো! হয়তো আমার বান্দা তার ভূল বুঝতে পেরে তাওবা করবে।
দেখো! সে হয়তো পাপ করার সময়ই আমার কথা স্মরণ করে ফিরে আসবে।
দেখো! সে হয়তো আমার সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবে যে খারাপ কিছুতে আর লিপ্ত হবে না।
দেখো! হয়তো এই পাপের ফলাফল স্বরূপ সে আমার দিকে প্রত্যাবর্তন করবে।

আর এভাবেই রাহমানুর রাহীম একের পর এক সুযোগ দিয়ে যান আপনাকে, আমাকে।
তিনি অপেক্ষা করেন হয়তো এখনই, এ মুহূর্তেই আপনি আমি প্রত্যাবর্তন করবো তাঁর দিকে।

মূলঃ ওমর সুলাইমান

লিখেছেন

Picture of কারিশমা আনান

কারিশমা আনান

নারী আড়ালেই সুন্দর। যদি সে বইও প্রকাশ করে ফেলে তবুও আড়ালেই থাকুক।
জানানোর মতন, পরিচয় দেবার মতন কোনো পরিচয় নেই। আমি আল্লাহর এক সৃষ্টি, আমার নবী ﷺ এর উম্মতের একজন। এর বেশি পরিচয় নেই, দিতেও ইচ্ছুক না

লেখকের সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

নারী আড়ালেই সুন্দর। যদি সে বইও প্রকাশ করে ফেলে তবুও আড়ালেই থাকুক। জানানোর মতন, পরিচয় দেবার মতন কোনো পরিচয় নেই। আমি আল্লাহর এক সৃষ্টি, আমার নবী ﷺ এর উম্মতের একজন। এর বেশি পরিচয় নেই, দিতেও ইচ্ছুক না

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture