ফাতওয়া: ঝুঁকি ও সতর্কতা

শরী‘আতের অনেক বিষয়ই গবেষণাধর্মী। এগুলো নিয়ে অতীতে আমাদের সম্মানিত ইমামগণ গবেষণা-ইজতিহাদ করেছেন এবং বর্তমানেও এ ধরনের অনেক বিষয়ে গবেষকগণ পক্ষেবিপক্ষে বিস্তর আলোচনা-পর্যালোচনা করে যাচ্ছেন।
এ জাতীয় বিষয়ে, বিশেষ করে বহুল মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে ফাতওয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।

ইজতিহাদ হলো মুজতাহিদের নিছক ব্যক্তিগত গবেষণা। এটা নিতান্তই তাত্ত্বিক, যা শুদ্ধ হওয়ার যেমন সম্ভাবনা রাখে, তেমনি অশুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনাও রাখে। আবার অনেক ক্ষেত্রে এর সাথে কার্যকারিতার সর্ম্পকও থাকে না; এটা কেবল নিজেদের পরিমণ্ডলে একাডেমিক আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আমাদের ইমাম ও গবেষকগণের ইজতিহাদ-গবেষণাগুলো ফিকহের কিতাবগুলোর মধ্যে সুবিন্যস্ত অবস্থায় রয়েছে।

পক্ষান্তরে ফাতওয়া হলো ইজতিহাদের প্রায়োগিক ও কার্যকর উদ্যোগ, অনেকে ক্ষেত্রে এর সম্পর্কও হচ্ছে অপর ব্যক্তি বা সমাজের সাথে। এতে ভুল হলে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অথবা নানা বিভ্রান্তিও ছড়িয়ে যেতে পারে বা নানা নতুন বিতর্কও তৈরি হতে পারে।

অধিকন্তু ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তিবিশেষ, সময় ও অবস্থাভেদে এবং জনস্বার্থ রক্ষা ও জনকল্যাণে ফাতওয়ার মধ্যে পরিবর্তনের অবকাশ থাকে। আবার প্রয়োজনে সাময়িকভাবে কোনো কোনো ফাতওয়া দেওয়া বন্ধও রাখতে হয়, যদি পরিবেশ অনুকূল না হয় বা কোনোরূপ ফিতনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। আবার পরিস্থিতি বিবেচনায় ক্ষেত্রবিশেষে নিজের পছন্দনীয় ইমামের মত ছেড়ে অন্য ইমামের মতানুসারেও ফাতওয়া দিতে হয়।

একজন মুফতীর দায়িত্ব কেবল এতোটুকু নয় যে,
তিনি ফিকহ-ফাতওয়ার বড়ো বড়ো কিতাব থেকে রেফারেন্স যুক্ত করে একটা সিদ্ধান্ত দিয়ে দেবেন; বরং তাকে ক্ষেত্রেবিশেষে ফাতওয়া দেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অবস্থা, স্থান-পরিবেশ-পরিস্থিতি, ঘটনাপরম্পরা প্রভৃতি সকল কিছুর ওপর সুতীক্ষ্ণ ও গভীর দৃষ্টি রাখতে হয়।

বস্তুতপক্ষে ইফতার বিষয়টি অনেক বেশি দায়িত্বপূর্ণ কাজ, এর ঝুঁকিও কম নয়। তাই ফাতওয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে মুফতীদের যথাসাধ্য সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন এবং আল্লাহকে বেশি ভয় করা উচিত, যাতে তাদের ফাতওয়ার কারণে অবাঞ্ছিত কিছু না হয়। এ কারণে মুফতীকে অনেক বেশি অভিজ্ঞ, দূরদৃষ্টি ও বিশ্লেষণক্ষমতাসম্পন্ন এবং আল্লাহভীরু হতে হয়।

আমাদের সালাফে সালিহীন ও মুজতাহিদ ইমামগণ ফাতওয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করতেন না। অনেকেই ফাতওয়া দিতে ভয় করতেন এবং তা থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করতেন।

ইমাম মালিক রাহ. সম্পর্কে জানা যায়, একবার তাকে পঞ্চাশটি মাসআলা জিজ্ঞেস করা হয়েছিল; কিন্তু তিনি একটি মাসআলারও জবাব দেননি; বরং বললেন,

‘‘ যে ব্যক্তি কোনো মাসআলার জবাব দিতে চায়, সে যেন প্রথমে নিজেকে জান্নাতজাহান্নামের সামনে পেশ করে এবং জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের পথ বের করে নেয়, অতঃপর উত্তর প্রদান করে।”
–নববী, আদাবুল ফাতওয়া

বিশিষ্ট তাবি‘ঈ আইয়ুব আস সাখতিয়ানী রাহ. বলেন,

‘‘বস্তুত সেসকল লোকই ফাতওয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে অতি উৎসাহী হয়ে ওঠেন, যারা ইমামগণের ইখতিলাফ সম্পর্কে খুব কম জ্ঞান রাখেন। অপরদিকে যারা ইমামগণের ইখতিলাফ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন, তারা ফাতওয়া দেওয়া থেকে সর্বাধিক বিরত থাকেন।’’– ইবনুল মুবারক, আয যুহদ

[ইজতিহাদ ও ফাতওয়া-সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন, আমার ‘তুলনামূলক ফিকহ ১ম খণ্ড, ৮ম অধ্যায়, পৃ. ৬০০-৬৯৩]

লিখেছেন

ড. আহমদ আলী

প্রফেসর, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,
চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Visit all other posts by this author

প্রফেসর, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,
চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Exit mobile version