Writing

একটি কথা

উনি যেদিন প্রথম দেখতে এসেছিলেন আমায়, মাহরামের উপস্থিতিই অল্পকিছু কথা হয়েছিলো আমাদের। আমি প্রচন্ড লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে ছিলাম। কোনো রকমে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিয়ের পর স্ত্রীকে চাকুরী করতে দিতে চান?

উনি মৃদু অথচ স্পষ্ট স্বরে উত্তর করেছিলেন,, শারীয়াহ’র দৃষ্টিকোণ থেকে না হয় একটু পরেই ভাবি। শুধু বলি, আমার স্ত্রী যদি চাকুরী করেন তবে উনাকে দিনের বেশিরভাগ সময় ই এ কাজে ব্যস্ত থাকতে হতে পারে। নানা প্রয়োজনে নানা জায়গায় যেতে হতে পারে। এমনকি চাকুরীর সুবাদে ভিন্ন কোনো শহরে পোস্টিং ও হতে পারে। ধরে নিলাম এর কোনোটাতেই আমার আসলে কোনো সমস্যা নেই। আমার আসল সমস্যা কি জানেন? আমি আমার স্ত্রীকে ছাড়া থাকতে পারবো না!

উনার শেষোক্ত কথা শুনে হঠাৎ বুকের মধ্যে কেমন এক অদ্ভুত শিহরণ হলো। আমি আমার সকল জড়তা হুট করে ভুলে গেলাম। তড়িৎ গতিতে তাঁর দিকে তাকালাম! তাঁর চোখে চোখ পড়লো। আমার প্রচন্ড লজ্জা অনুভূত হলো তবু আমি সব ভুলে শুধু ভাবতে লাগলাম, মাত্র একটি বাক্যে কিভাবে এতো মুহাব্বাত লুকানো থাকতে পারে?

এরপর কি হলো? এরপর আমি উনাকে ‘মানুষটা আমার’ বলার অনুমতি পেলাম। উনার দিকে এক নজরে তাকিয়ে চোখদুটোকে ক্লান্ত করে ফেলার খেলায় নামলাম। এ যে কি সুখ, কি সুখ, তা কি করে বোঝাবে এ তুচ্ছ কালি কলম!

উনি নিজেও অবশ্য মাঝে মাঝে ছেলেমানুষী আচরণ করেন। আমায় বাবার বাড়িতে দিয়ে আসার সময় কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেন,“আমায় ছাড়া থাকতে পারবে তো?”

এতোদিনে প্রশ্নটি শোনা হয়ে গেছে বহুবার। উনি উত্তর হিসেবে কি শুনতে চান সেও আমার মুখস্থ। কিন্তু তবুও উনি যখন ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করেন আমার কেনো যেনো পুরো শরীরে একটা শিহরণ বয়ে যায়। সেই প্রথম দিনের মতো কানে ভেসে ওঠে উনার সেই বাক্যটি,“ আমি আমার স্ত্রীকে ছাড়া থাকতে পারবো না।” সেই বাক্য আমায় শব্দহারা করে দেয়। উনি উত্তর না পেয়ে একটু অভিমানও হয়তো করেন কিন্তু আমি কিছুতেই উত্তর করতে পারি না।

দিনের পর দিন কাটে। জরায়ু গহব্বরের মধ্যখানটাতে একদিন আয়িশাহ জায়গা নেয়, তারপর আব্দুল্লহ, তারপর আব্দুর রহমান! আমাদের একটা ম-স্ত ‘সংসার’ হয়! উনি অবশ্য হেসে বলেন, আমাদের এখন একটা ম-স্ত ‘ভালোবাসা’ হলো!!

সমস্যা রয়ে যায় শুধু একটাই। আমি বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা তুললেই তাঁর জ্বর এসে যায়! প্রথম দিকে ভাবতাম, মিছিমিছি টালবাহানা। তারপর থার্মোমিটার আমার ভুল ভাঙালো। একদিন মেপে দেখি ১০২.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট। আর তিনি সেই জ্বর গায়েই আবার আমায় প্রশ্ন করলেন, “আমায় ছাড়া থাকতে পারবে তো?”

তিন সন্তানের জননী আমি এখন। বয়স চল্লিশ ছুইঁছুঁই। চুলের গোছায় পাক ধরলো বলে। তবু শিহরিত হই। তবু কেঁপে যায় পুরো শরীর। উত্তর টা মুখস্থ থাকা সত্ত্বেও বলতে পারি না, শব্দহারা হয়ে যাই আগের মতোই।

আজ, এই মুহূর্তে, আমাদের বিবাহিত জীবনের উনিশটা বছর শেষে হুট করে সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার তাঁকে বলবোই। ইন শা আল্লহ বলবোই।

কেনো যেনো মনে হচ্ছিলো, আসলেই এবার তাঁকে বলতে পারবো। অন্তরে এও অনুভূত হচ্ছিলো, এবার আর না বললে হয়তো আর কখনোই বলা হবে না! উম্মি আয়িশাহ কে এবার তাই বলতেই হবে।

আমি তাই মেঝে ছেড়ে উঠে আব্দুল্লহ কে ডেকে বললাম, আমি তোমার আব্বুর কাছে যেতে চাই একটু। আব্দুল্লহ উত্তর দিলো, জ্বি আম্মি। আমি সব ভাইদের আব্বুর কাছ থেকে সরে যেতে বলছি। কিছুক্ষণ পরে আমি আয়িশাহ’র আব্বুর কাছে গেলাম। মানুষটা শুয়ে ছিলো। আমি উনার হাত ধরলাম। এবং দীর্ঘ উনিশ বছরে প্রথম বার উনি আমার স্পর্শ পেয়েও মুচকি হাসি টা হাসলেন না। আমি এ অবহেলা মুখ বুজে সহ্য করে নিলাম। উনার কানের কাছে মুখটা নিয়ে ঠিক উনার ভঙ্গিতেই উনাকে বললাম, “আমি আমার স্বামীকে ছাড়া থাকতে পারবো না, আয়িশাহ’র আব্বু!!”

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এটা যে উনি এ বাক্যটি শুনেও কোনো উত্তর করলেন না! যে বাক্যটি শোনার জন্য উনিশ বছর ধরে তড়পাচ্ছিলেন, সেই বাক্যটি শুনে তার অঙ্গভঙ্গির একটুকু পরিবর্তন হলো না! এমনকি আমি তো বুঝতেও পারলাম না যে উনি আমার এই কথাগুলো শুনছেন কিনা। উনি যেনো এখন অন্য কোনো মানুষ, যেনো কোনো রহস্য।

আচ্ছা আপনারা কেউ কি জানেন যে, গায়ে সাদা কাফন জড়ালেই মানুষগুলো এমন রহস্যাবৃত হয়ে যায় কি করে?

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture