কোন ভয়াবহ বিপদে একমাত্র দৃঢ় কঠিন ঈমানের অধিকারী ও অসীম ধৈর্যশীল ব্যক্তি ছাড়া সাধারণ মানুষের মনের অবস্থা খুব দূর্বল হয়ে যায়। কখনও কখনও ঈমানের ভিত্তি ও যেন নড়বড়ে হয়ে যায়। আর এটি একটি স্বাভাবিক বিষয় যে, মাঝে মধ্যেই কঠিন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অনেকের ঈমান দূর্বল হয়ে যেতে পারে। যদিও এটি কারো ইচ্ছাকৃত না। তবুও যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে সবর ও তাওয়াক্ক্বুলের মাধ্যমে এই ঈমানী দূর্বলতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য।
যেকোন কঠিন বিপদের সময় কিভাবে টের পাওয়া যাবে যে আমাদের ঈমান দূর্বল হতে চলেছে!
যখন বিপদে অত্যধিক ভয় পেয়ে দিশেহারা হয়ে বিপদ থেকে মুক্তিদাতা আরশীল আযীমের কাছে যথাযথভাবে সাহায্য না চাওয়া হবে। মুমিনের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার দু’আর উপর যখন যথাযথ আস্থা থাকবে না। অথবা দৃঢ়ভাবে আস্থা না রেখে দু’আ করা হবে।
দু’আ নিয়ে অনেকের মাঝে অনেক ধরনের কনফিউশন কাজ করে। তাই এ লেখাটিতে দু’আ সম্পর্কিত এমন কিছু ইনফরমেশন আপনাদের জন্য শেয়ার করবো ; যখন কোন বিপদে আপনারা দু’আ করতে ভুলে যাবেন বা দু’আ করে ফল না পেয়ে মন খারাপ হবে তখন মনোযোগ দিয়ে লেখাটি পড়বেন। দু’আ সম্পর্কে আপনাদের বিশ্বাসের ভিত্তিটা আরো মজবুত হবে। আপনাদের বন্ধু/স্বজন কেউ যদি দু’আ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন বা বিপদে মাত্রাতিরিক্ত দিশেহারা হয়ে পড়েন তাকে ও লেখাটি পড়তে দিতে পারবেন। আশা করি মনে কিছুটা হলেও প্রশান্তি আসবে ইনশাআল্লহ্।
কঠিন বিপদের সময় আসলে আমাদের অনেকের মনের অবস্হা অনেক নরম হয়ে যায়। কোন কিছুতে ভরসা না পেয়ে অনেকে তখন বলে ফেলেন দু’আ করা ছাড়া আর কি- ই বা করবো এখন! এখন আমাদের তো শুধু দু’আ- ই করে যেতে হবে!
হ্যাঁ, কথাটি ঠিক হলে ও কথাটির প্রকাশ ভঙ্গিমা অনেকক্ষেত্রে-ই ঠিক থাকে না। কারণ কথাটি বলা হয় গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অথবা হালকা ভাবে হতাশা নিয়ে। আর এটা- ই অনেকের দু’আ কবুল না হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। এ সম্পর্কে রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“তোমরা আল্লহর নিকট দু’আ কর কবুল হবে এই দৃঢ় প্রত্যয় রেখে। আর জেনে রেখো যে, আল্লহ্ উদাসীন ও অন্যমনস্কের হৃদয় থেকে দু’আ কবুল করেন না।”1
অথচ আপনি কি জানেন দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে করা দু’আর মাধ্যমে আমরা অনেক কিছুর পরির্বতন ঘটাতে পারি! এই ব্যাপারে রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إن الدعاء ينفع مما نزل ومما لم ينزل، فعليكم عباد الله بالدعاء.
“নিশ্চয়ই যে (বিপদ) নাযিল হওয়ার কথা ছিল, দু’আর কারণে তা উঠিয়ে নেয়া হয়, যে (নিয়ামত) অবতীর্ণ হওয়ার কথা ছিল না, তা অবতীর্ণ করা হয়। হে আল্লহর বান্দাগন! তোমরা বেশি বেশি দু’আ কর।”2
প্রকৃতপক্ষে কোন কিছুই আমাদের তাক্বদীরকে পরিবর্তন করতে পারবে না, একমাত্র দু’আ ব্যতীত। আপনি জেনে আশ্চর্য হবেন কোন বিপদ আকাশ থেকে নাযিল হওয়ার আগে যদি দু’আ করা হয়ে থাকে, তবে দু’আ উপরের দিকে উঠতে থাকে এবং বিপদ নীচের দিকে নামতে থাকে। মাঝপথে তারা একে অন্যের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
বিপদ আর দু’আর সংঘর্ষে বিজয় নির্ভর করে কে বেশি শক্তিশালী তার উপর। দু’আ যদি কবুল হওয়ার মতো শক্তিশালী হয়, অর্থাৎ দু’আ যদি ইখলাস ও কবুলিয়াতের আশা নিয়ে করা হয় তবেই দু’আ বিজয়ী হয়। ফলে ঐ বিপদ আর নাযিল হতে পারে না। সুবহানাল্লহ!
পক্ষান্তরে অমনোযোগের সাথে হতাশা নিয়ে করা দু’আ থেকে বিপদ শক্তিশালী হয়। তখন বিপদ দু’আকে পরাজিত করে নিচে নেমে আসে।
কখনও কখনও তারা সমানে সমান হলে কিয়ামত পর্যন্ত একে অন্যের সাথে লড়তে থাকে।
তাই বিপদের আগেই বিপদ না হওয়ার জন্য বেশি বেশি দু’আ করা উচিত। আর দু’আকে শক্তিশালী করার জন্য দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে দু’আ করতে হবে এটা ভেবে নিয়ে – আল্লহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা দু’আ কবুল করবেন- ই।
বান্দার দু’আ আল্লহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছে অনেক মূল্যবান। কারণ তিনি বান্দাদেরকে উনার কাছে দু’আ করতে বলেছেন। তিনি বান্দার ডাকে সাড়া দেন। বান্দাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে আর-রহমান লজ্জা বোধ করেন। তাই মু’মিনদের জন্য দু’আ অত্যন্ত শক্তিশালী একটি হাতিয়ার। অথচ মহামূল্যবান এ হাতিয়ারের যথাযোগ্য মর্যাদা অনেকে অনুধাবন করতে পারেন না বলে এটি সঠিকভাবে খুব কম- ই ব্যবহৃত হয়। বান্দার দু’আ কবুল হওয়া প্রসঙ্গে রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন,
“যখনই কোন মুসলিম পাপ ও আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্ন করা ছাড়া অন্য যে কোন বিষয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, তখনই আল্লহ তার প্রার্থনা পূরণ করে তাকে তিনটি বিষয়ের একটি দান করেন :
- হয় তার প্রার্থিত বস্তুই তাকে দিয়ে দেন।
- অথবা তার দু’আকে (দু’আর নেকি) তার আখিরাতের জন্য সঞ্চয় করে রাখেন।
- অথবা দু’আর অনুরূপ পরিমাণ তার অন্য কোন বিপদ তিনি দূর করে দেন।3
তাই দেখা যায় দু’আর সুফল পাওয়া যাবেই কোন না কোনভাবে।
সঠিক ভাবে দু’আ করা ছাড়া বিপদের সময় শুধু অত্যধিক টেনশন করলে কোন ফল পাওয়া যায় না। আর দু’আর বিষয়টা পুরোপুরি প্রাত্যহিক অভ্যাসের মতো করে ফেলতে হয়। একবার / দু’বার করলেই দু’আ কবুল হয়ে যাবে এ ভাবনা ঠিক নয়। এ সম্পর্কে ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেছেন,
“একাগ্রচিত্তে দুয়া করা মানে আল্লহর দুয়ারে কড়া নাড়া। আর যে-ই আল্লহর দুয়ারে কড়া নাড়ে আল্লহ তার জন্য দুয়ার খুলে দেন।”
তারিক মেহান্না ও এ নিয়ে সুন্দর ভাবে লিখেছেন,
“মনে রাখবেন ফুল ফুটবেই, কিন্তু সেটা এক রাতে না। দিনের পর দিন আপনাকে পানি দিয়েই যেতে হবে। অবশেষে এই ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করুন যে, আপনার দু’আর উত্তর আল্লাহ্র তৈরি প্রাকৃতিক নিয়মের কাঠামোর ভেতর থেকেই আসবে। এই কাঠামোর ভেতর যা ঘটে আল্লহ্ সেটা নিয়ন্ত্রণ করেন এবং এই কাঠামোর মাধ্যমেই তিনি আপনার দু’আর উত্তর দেন। আবারো বলছি, অবশ্যই অলৌকিক ঘটনা, কারামাহ ঘটে, কিন্তু সেগুলো হলো নিয়মের ব্যতিক্রম।
দু’আ কোন প্যানিক বাটন নয় ; যা মুহূর্তের মধ্যে কোন সমস্যার অলৌকিক সমাধানের গ্যারান্টি দেবে। বরং এর জন্য প্রয়োজন সময় ও গভীরতা। এর জন্য দরকার অবিচলতা, অধ্যবসায়, ধৈর্য, পুনরাবৃত্তি এবং অন্তর্দৃষ্টি।”
আসলেই তো দু’আ কোন ইন্সট্যান্ট বাটন নয়
যে অন করলেই সাথে সাথে অ্যাকশন পাওয়া যাবে।
ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ তার “আদ-দা ওয়াদ-দাওয়া” গ্রন্থে দু’আ সম্পর্কে আরো লিখেছেন,
“দু’আগুলো অস্ত্রের মত। অস্ত্র কেবল ধারের উপর নির্ভর করে না, চালনাকারীর উপরও নির্ভর করে। যখন কোন অস্ত্র যথাযথ ও ত্রুটিবিহীন হবে, অস্ত্রধারী হাতটাও দৃঢ় হবে এবং প্রতিবন্ধকতাও থাকবে না তখন শত্রুকে পরাভূত করা যাবে। আর এ তিনের কোন একটির কমতি থাকলে প্রভাবও কমে যাবে।”
তাই দু’আর শক্তি আর প্রভাব সম্পর্কে আমরা কখনোই নিরাশ হতে পারি না, পারবো না। ইমাম আশ-শাফিয়ী রহিমাহুল্লাহ্ দু’আ নিয়ে আশা বহাল রাখতে বলেছেন, সেই সাথে দু’আ নিয়ে কোন ধরনের তুচ্ছতাচ্ছিল্য মনে স্হান দিতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছিলেন,
“তোমরা দু’আ নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করো, ফলে তোমাদের দু’আ বিফলে যায়! তোমরা জানো না দু’আয় কী আছে! বরং শেষ রাতের দু’আ এমন এক তীর, যা কখনই লক্ষ্যচ্যুত হয় না।”
তাই যেকোন কঠিন পরিস্থিতিতে বা ভালো সময়ে ও আমাদের সবার উচিত বিনীতভাবে একমাত্র আল্লহ্ সুবহানাহু তা’আলার কাছে দু’আ করে যাওয়া, উনার সাহায্য চাওয়া। কেননা একমাত্র তিনিই পারবেন আমাদেরকে সবধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে, আমাদের চাওয়াগুলো, স্বপ্নগুলো পূরণ করতে। আর আল্লহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা উনার উপর পরিপূর্ণ তাওয়াক্ক্বুল রেখে যারা দু’আ করে তাদের দু’আই কবুল করতে তিনি আগ্রহী হন। তিনি তো আল-মুজিব, আল- ওয়াজীদ ; তিনি তো বান্দার দু’আ কবুল করার জন্য অপেক্ষায় আছেন। শুধুমাত্র দু’আ কবুলের জন্য খুবই ছোটখাটো শর্তগুলো পূরণ করতে হবে আমাদের।
দু’আ কবুলের ছোটখাটো কিছু শর্ত হচ্ছে –
সর্বপ্রথম আল্লহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার প্রশংসা করা, এরপর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর দরূদ পড়া, আল- গফুরের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া, আল্লহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সুন্দর সুন্দর নাম ধরে ডেকে প্রয়োজন অনুযায়ী দু’আ করা, আন্তরিকভাবে ও কবুল হবে এ বিশ্বাস নিয়ে দু’আ করা…।
দু’আ কবুলের এ মহিমান্বিত রমাদানে আসুন সবাই সবার মনের ঝাঁপি খুলে দু’আ করতে থাকি। আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন দেখুন, সমস্ত কষ্ট দূর হয়ে একটা প্রশান্তির জীবনের জন্য দু’আ করতে থাকুন। দু’আতে আপনার সাথে এই আমাকে আর সমস্ত মুসলিম উম্মাহকে রাখতে ভুলবেন না। একজন মুসলিম যখন অন্য আরেকজন মুসলিমের জন্য দু’আ করে তখন কিন্তু তার নিজের দু’আ কবুলের সম্ভাবনা ও বেড়ে যায়।
কারণ তখন ফিরিশতারা তার জন্য দু’আ করেন। একসাথে এভাবে ও দু’আ করা যায় “
ইয়া রব্বী! আল- মুজিব! আল- ওয়াজীদ! যারা আমার কাছে দু’আ চেয়েছিল তাদের সবার দু’আ গুলো আপনি কবুল করে নিন। অতএব. . . দু’আতে আমাদের সবাইকে রাখবেন ইনশাআল্লহ্।
- [তিরমিযী ৩৪৭৯, হাকেম ১৮১৭, সহীহুল জামি ২৪৫] ↩︎
- [সুনানে তিরমিযি, হাদীসটি সহীহ] ↩︎
- [তিরমিযি: ৫/৫৬৬, আহমাদ: ৩/১৮] ↩︎