দাওয়াতি ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ একে অপরের সহযোগী বন্ধু হতে পারে কি
আল্লাহ তাআলা কুরআনে “মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু” বলে আখ্যায়িত করেছেন। আমার প্রশ্ন হল,
ক) মাহরাম ছাড়া কোন মুমিন পুরুষ কোন মুমিন নারীকে ভালো কাজের আদেশ দিতে পারবে কি?
খ) মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী একে অপরে বন্ধু হতে পারবে কি?
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنٰتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَآءُ بَعْضٍ ۚ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلٰوةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكٰوةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓ ۚ أُولٰٓئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ ۗ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيم
“আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু, তারা ভালো কাজের আদেশ দেয় আর অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে, আর তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এদেরকে আল্লাহ শীঘ্রই দয়া করবেন, নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়”1
ব্যাখ্যা:
উক্ত আয়াতে الْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنٰتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَآءُ بَعْضٍ “মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু” এর ব্যাখ্যায়
তাফসিরে ত্ববারিতে বলা হয়েছে,
إن صفتهم: أن بعضهم أنصارُ بعض وأعوانهم
“তাদের বৈশিষ্ট্য হল, তারা একে অপরের সাহায্য ও সহযোগিতাকারী।”
ইমাম ইবনে কাসির রাহ. বলেন,
يتناصرون ويتعاضدون
“তারা একে অপরের সমর্থন ও সহযোগিতা করবে।” যেমন: হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
الْمُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا
“একজন মুমিন ব্যক্তি অন্য মুমিনের জন্য একটি সুদৃঢ় বিল্ডিং-এর মত, যার একটি অংশ অপর অংশকে শক্তিশালী করে।” [সহিহ বুখারি], হাদিসে আরও এসেছে,
مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِي تَوَادِّهِمْ وَتَرَاحُمِهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى
“মুমিনদের উদাহরণ হল, তারা পারস্পরিক ভালবাসা, দয়া ও সহানুভূতির দিক থেকে একটি মানব দেহের ন্যায়। যখন দেহের একটি অঙ্গ আক্রান্ত হয় তখন পুরো দেহ জ্বর ও অনিদ্রা ডেকে আনে।” [সহিহ মুসলিম]
মোটকথা, মুসলিম উম্মাহর নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমস্ত মুমিনগণ এক দেহ সত্ত্বার মত। তারা সকলেই একে অপরের বন্ধু ও সহযোগী। সকলের দায়িত্ব হল, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা, সালাত আদায় করা, জাকাত দেওয়া এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা।
সুতরাং মুমিন নারী-পুরুষ সকলেই আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যে ইসলামের সীমারেখা মেনে পারস্পারিক বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা মূলক মনোভাব নিয়ে সৎকাজ করবে, অসৎ কাজে বাধা দিবে, আল্লাহর পথে দাওয়াত দিবে এবং নামাজ, রোজা, জাকাত ইত্যাদি নেক কর্ম সম্পাদন করবে।
দাওয়াতি কাজের ক্ষেত্রে নারীরা নারীদের মাঝে এবং তার পরিবার ও মাহরাম পুরুষদের মাঝে দাওয়াহ-এর কাজ করবে। সৎ কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজে নিষেধ করবে এবং এই দাওয়াতকে যতদূর সম্ভব দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিবে। বর্তমান আধুনিক যুগে ঘরে বসেই অনেক বড় বড় দাওয়াহ-এর কাজ আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব। যেমন: যোগ্যতা থাকলে বই লিখে প্রকাশ করা, ওয়েব সাইট, ফেসবুক, ব্লগ ইত্যাদিতে প্রবন্ধ প্রকাশ করা, আলেমদের রচিত বই নিজ খরচে প্রকাশ ও প্রচারের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। সব কিছুই করবে ইসলামের সীমারেখার মধ্য থেকে।
তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই এমন কাজ থেকে দুরে থাকবে যাতে আল্লাহর নাফরমানি সংঘটিত হয় বা যা পাপাচারের দিকে ধাবিত করে। যেমন: কোন মুমিন নারী পর পুরুষের সাথে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কথা বলবে না, একান্ত প্রয়োজনে কথা বললেও নারীর জন্য আবশ্যক হল, কোমল কণ্ঠ পরিহার করা।2
কোনও নন মাহরাম পুরুষের সাথে লোকচক্ষুর আড়ালে যাবে না এবং ফিতনা সৃষ্টি হতে পারে এমন সব সম্ভাবনার পথ বন্ধ করবে। দীনের নামে নন মাহরাম ব্যক্তির সাথে গল্প করা, হাসি-মজাক করা, আড্ডাবাজি করা, ভিডিও কল করা বা চ্যাটিং করা, ছবি লেনদেন করা ইত্যাদি সব হারাম। কেননা, তা উভয়ের জন্য মহা ফিতনার কারণ। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
مَا تَرَكْتُ بَعْدِي فِي النَّاسِ فِتْنَةً أَضَرَّ عَلَى الرِّجَالِ مِنَ النِّسَاءِ
“আমি আমার পর লোকদের মাঝে পুরুষদের জন্য মেয়েদের চেয়েও ক্ষতিকর আর কোন ফিতনা রেখে যাইনি।” [বুখারি ও মুসলিম] অন্য হাদিসে এসেছে,
فَاتَّقُوا الدُّنْيَا وَاتَّقُوا النِّسَاء فإنَّ أَوَّلَ فِتْنَةِ بَنِي إسرائيلَ كَانَتْ في النِّسَاءِ
“অতএব তোমরা দুনিয়ার ধোঁকা থেকে বাঁচ এবং নারীর (ফিতনা থেকে) বাঁচ। কারণ, বানী ইসরাইলের সর্বপ্রথম ফিতনা নারীকে কেন্দ্র করেই হয়েছিল।” [সহিহ মুসলিম]
মোটকথা, পুরুষ-নারী নির্বিশেষে ফিতনা থেকে সর্বোচ্চ দূরত্ব বজায় রেখে ইসলামি শরিয়তের সীমারেখার মধ্যে থেকে তাদের সাধ্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী পারস্পারকি সহযোগিতার মনোভাব রেখে ইসলামের সুমহান বার্তাকে নিজ পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিবে, ইসলামি অনুশাসন সকলেই দাওয়াহ ইলাল্লাহর-এর কাজ করবে, সালাত কায়েম করবে, জাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহর আনুগত্য মূলক কাজ করবে।
এভাবে যদি মুসলিম জাতি তাদের দায়িত্ব পালন করে, তাহলে আশা করা যায়, আল্লাহ তাদেরকে তাঁর রহমতের বারিধারায় সিক্ত করবেন এবং দুনিয়ায় সাফল্য ও মর্যাদার আসনে সমাসীন করার পাশাপাশি আখিরাতে দান করবেন অবারিত সাফল্য ও মুক্তির নিশ্চয়তা। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।