আমাদের দুশ্চিন্তার অন্যতম টপিক হলো রিজিক। এমন কেউ নেই যিনি রিজিক নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন না। হতে পারেন তিনি বড় ব্যবসায়ী, ৬ ডিজিটের চাকরিজীবী বা বেকার।
রিজিক নিয়ে এই দুশ্চিন্তা কিছুটা হলেও কমতো, যদি আমরা রিজিক কী, এটা কীভাবে কাজ করে এই নিয়ে ধারণা রাখতাম।
আমরা সবাই জানি, সবাই বলি, ‘রিজিকে যা আছে, তা পাবেই’।
এটা জানার পরও আমরা দুশ্চিন্তা করি। যার মানে দাঁড়ায়, আমরা যা সবসময় বলি, তা বুঝে বলি না। যদি বুঝতাম, তাহলে সারাক্ষণ কেনো হাহুতাশ করি? কেনো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি?
প্রথমত, রিজিকের পরিমাণ পূর্বনির্ধারিত। কিন্তু, কীভাবে সেটা অর্জন করবেন সেটা আমার-আপনার চয়েস। আল্লাহ আপনার ভাগ্যে যতোটুকু লিখে রাখছেন, আপনি পাবেনই। কীভাবে সেটা গ্রহণ করবেন, সেই সিদ্ধান্ত আমাকে-আপনাকে নিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, রিজিকের পরিমাণ বাড়ে-কমে। সেটা বাড়া-কমা নির্ধারণ করেন আল্লাহ। পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন শর্তহীনভাবে আল্লাহ এটা বাড়ান/কমান।
আমরা বিভিন্ন মসজিদে অজু করতে যাই। অনেকগুলো ট্যাপ থাকে। কিন্তু, আমরা কোন ট্যাপে অজু করবো সেটা আমরাই নির্ধারণ করি।
ট্যাপের মধ্যে যে পানি আসে, সেই পানির সাপ্লাই আসে পানির ট্যাংক থেকে।
পানির ট্যাংকে পানি না থাকলে আপনি ট্যাপে যতোই চেষ্টা করুন না কেনো পানি আসবে না। সবগুলো ট্যাপ ছাড়লেও কাজ হবে না।
আমাদের রিজিক হলো পানির ট্যাংক। সেই ট্যাংকে ৫০০ লিটার পানি নাকি ৫০০০ লিটার পানি আমরা জানি না।
কিন্তু, আমাদের হাতে অপশন হলো পানির ট্যাপ।
কোনো পানির ট্যাপে লেভেলিং করা ‘হালাল’, কোনোটাতে ‘হারাম’ আবার কোনোটাতে লেখা ‘সন্দেহযুক্ত’।
সিদ্ধান্ত আমাদেরকেই নিতে হবে। আমরা কোন পানির ট্যাপ থেকে পানি নেবো। সবগুলো থেকেই পানি নিতে পারবো, যেকোনো একটা থেকেও নিতে পারবো।
আপনার-আমার যে রিজিক আছে, সেটা আমরা পাবোই। পানির ট্যাংকের শেষ ফোঁটা পানি শেষ হবার আগে আমাদের মৃত্যু হবে না।
হারাম ট্যাপ থেকে অনেকসময় বেশি পানি আসতে পারে। একে তো এটাকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে, পানি বেশি পড়ে। তারওপর এটা যদি একইরকমও হয়, শয়তান ওয়াসওয়াসা দেয়— ঐ ট্যাপটাই ভালো।
তখন হালাল উপার্জন করা সত্ত্বেও অধিক লাভের আশায় আমরা হারাম ট্যাপ থেকেও পানি নেয়া শুরু করি।
আমরা ভুলে যাই, পানি লাভের মূল কারণ ট্যাপ না, পানির ট্যাংক। ঐ ট্যাংকে যতো পানি আছে, আমি পাবোই।
অনেকেই বলতে পারেন, কিন্তু প্রচেষ্টার কারণে তো রিজিক বাড়তে পারে। প্রচেষ্টা মানে, একসাথে অনেকগুলো ট্যাপ চালু করে অনেকগুলো বোতল/বালতি একসাথে ভরার সক্ষমতা।
যেমন: একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, একজন ডাক্তার, আর একজন কৃষকের রিজিকের পরিমাণ কি সমান?
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই ধারণা ক্লিয়ার হওয়া যে, রিজিক সবার সমান না। রিজিক হলো কাস্টমাইজড। একই মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া ২ জমজ ভাইয়েরও রিজিক ‘সমান’ না। প্রত্যেকের আলাদা।
দ্বিতীয়ত, রিজিক শুধুমাত্র ফিনান্সিয়াল না; ফিনান্সিয়াল রিজিক হলো রিজিকের অন্যতম প্রকারভেদ। তারপরও এই উদাহরণের প্রেক্ষিতে একটু বাস্তবিক উদাহরণ দিয়েই বলি।
একজন ডাক্তার তার ৩০ বছরের কর্মজীবনে উপার্জন করেছেন, উপভোগ করেছেন প্রায় ১০ কোটি টাকা।
একজন কৃষক তার ৩০ বছরে উপার্জন করেছেন মাত্র ৫০ লক্ষ টাকা।
কিন্তু, কৃষকের রিজিক ছিলো ৫ কোটি টাকা।
তিনি তার জীবনে ৫ কোটি টাকা উপভোগ করবেন বা ব্যয় করবেন। সাড়ে ৪ কোটি টাকা কীভাবে আসবে?
আমরা এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেখি, বাবা গ্রামের দরিদ্র কৃষক, কিন্তু ছেলে বড় ডাক্তার হয়, ইঞ্জিনিয়ার হয়, বিদেশে গিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করে, বড় ব্যবসায়ী হয়।
ছেলেদের পেছনে পরিশ্রম করে বাবা ৩০ বছরে ৫০ লক্ষ টাকার রিজিক উপভোগ করলেও দেখা যায় সেই বাবা পরবর্তী ৫/১০ বছরে ৪-৫ কোটি টাকার রিজিক উপভোগ করেন।
ছেলে একটি বাড়ি বানায়, শহরে ফ্ল্যাট কিনে, বাবা-মাকে হজ্জ-উমরায় পাঠায়, ছেলের টাকা দিয়ে বাবা গ্রামে জমি কিনে।
এরকম অসংখ্য উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে।
চিন্তা করুন সেই বাবার কথা। ধরে নিচ্ছি তার পানির ট্যাংকে যে পরিমাণ রিজিক ছিলো, সেটা তাকে বললে কেউ বিশ্বাস করতো না; তিনি নিজেও না। কিন্তু, তার জীবদ্দশায় ঠিকই সেই রিজিক তিনি পেয়ে যান।
সারাজীবনে যতো উপার্জন করছেন, ছেলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ৫-৭ বছরে বাবার সারাজীবনের উপার্জনের বেশি তাকে দেয়।
বুঝার সুবিধার্থে রিজিকের শুধুমাত্র ফিনান্সিয়াল দিক বললাম, রিজিক বুঝতে নন-ফিনান্সিয়াল দিকটা বুঝলে আমাদের দুশ্চিন্তা কমে যেতো।
রাজনৈতিক বাস্তবতার এক উদাহরণ দিই।
১ বছর আগেও আসিফ মাহমুদ, নাহিদ আর মাহফুজের আব্বা জানতেন না তাদের রিজিকের খাজানা এমন হবে।
এই বয়সে তাদের সর্বোচ্চ এম্বিশন হতে পারে সন্তান বড় হয়ে চাকরি করবে, কোনো ব্যবসা করে এতোদিন ধরে যে পরিবারের হাল ধরেছেন, সেটার হাল তারা ধরবে।
কিন্তু, ১ বছরের মধ্যে তারা মন্ত্রীর বাবা। মন্ত্রীর বাবার রিজিক শুধুমাত্র ফিনান্সিয়াল না, নন-ফিনান্সিয়াল জায়গা থেকেও চিন্তা করুন- সম্মান, সামাজিক মর্যাদা সবকিছু কীভাবে এতো গুণ আপগ্রেডেড হলো।
আর চিন্তা করুন ৫ আগস্টের কথা।
সেদিন বাংলাদেশের বেশিরভাগ বাসায় দুপুরের রান্না নিয়ে কেউ এতোটা প্ল্যান করেনি, এতো ভালো মানের রান্না করেনি। সবাই চিন্তিত।
কিন্তু, যার ভবনে এতো ভালো মানের রান্না হলো, সেই খাবার তার রিজিকে জোটেনি!
আগেরদিনও এই জায়গার রান্না সে খেলেও পরদিন শুধু সে না, তার আশেপাশের কেউ, যাদের জন্য রান্না হয়েছিলো, তারা কেউ খেতে পারেনি।
এই একটি ঘটনাই দেখিয়ে দেয়, রিজিক কী জিনিস।
রান্না করা খাবার ভাগ্যে না-ও জুটতে পারে।
পুরো থিমটা পবিত্র কুরআনে আল্লাহ একসাথে উল্লেখ করেছেন দুটো আয়াতে।
“বলুন- ‘হে আল্লাহ, রাজত্বের মালিক, আপনি যাকে চান রাজত্ব দান করেন, আর যার থেকে চান রাজত্ব কেড়ে নেন এবং আপনি যাকে চান সম্মান দান করেন। আর যাকে চান অপমানিত করেন, আপনার হাতেই কল্যাণ। নিশ্চয় আপনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। আপনি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করান। আর মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন। আর যাকে চান বিনা হিসাবে রিজিক দান করেন।”
(সূরা আলে ইমরান ৩: ২৬-২৭)
চোখের সামনে আমরা অনেককিছুই দেখলাম।
একটি কথা বেশ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে- “একদল খাইছে, আরেকদল খাওয়ার জন্য রেডি আছে।“
আপনি খাইতে পারবেন, শুধু সিদ্ধান্ত নিতে হবে হালালভাবে খাবেন নাকি হারামভাবে।
যারা খাচ্ছিলো, তারা জানতোই না যে তারা যেটাকে অফুরন্ত ভাবছিলো, সেটাও কমে আসবে বা শেষ হয়ে আসবে হুট করে।
‘হালালে রিজিক কমায় না আর হারামে রিজিক বাড়ায় না‘ —এই কথাটি যদি আমরা মনে রাখতে পারি, আমাদের দুশ্চিন্তা দূর হবে, আমরা হারাম থেকে বাঁচতে পারবো ইনশা আল্লাহ।