মনোরম একমুগ্ধ বিকেল। ঝিরিঝিরি বইছে অক্লান্ত বাতাস। প্রকৃতি যেন আজ অভিমানের সাথে লড়ে যাচ্ছে। কোথাও যেন কেউ অভিমানের অভিযোগ লিখে যাচ্ছে অপ্রকাশিতভাবে।
রুমিনা আন্টি, ছাদের রেলিংয়ে ভর করে দাঁড়িয়ে একা একা আকাশ দেখছে। ছল ছল করছে জোড়া চোখ গুলি। হঠাৎ পাশ থেকে কে যেন বলে ওঠে,”আপেল খাবে! মা?”
কিছুটা বিচলিত হয়ে তড়িঘড়ি করে ঝড়ের বেগে দুহাত দিয়ে চোখ মুখ মুছে নেয় রুমিনা আন্টি। গলার স্বরে কিছুটা ধাক্কা দিয়ে বলে,
আরেহ! ফৌজিয়া, তুমি ঘুমাওনি?
(ফৌজিয়া। রুমিনা আন্টির একমাত্র পুত্রবধূ। খুব পছন্দ করে, একটি মাত্র ছেলের জন্য ফৌজিয়াকে ঘরের পুত্রবধু করে নিয়ে আসেন। এইতো ছয় মাস হল তাদের বিয়ে হলো। খুব ভালোবাসেন রুমিনা আন্টি ফৌজিয়া কে। শাশুড়ি বৌমার সম্পর্ক নয়, দেখে যেন কেউ বলবে মা মেয়েরই সম্পর্ক। রুমিনা আন্টির আরো দুই মেয়ে আছেন, তাদেরও বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।)
কিভাবে ঘুমায় বলতো! আমার পার্টনারের যে মন ভালো নেই।(আপেল খেতে খেতে)
তোমার না জ্বর! মোটেও সকালে ডাক্তারখানা থেকে তোমাকে দেখিয়ে আনলাম। ডাক্তার কি বলেছে শুনো নি? ছাদে আসতে গেলে কেন?
আরেহ মা আমি ঠিক আছি। (দাঁত দেখিয়ে ইইইইই করে হেসে ) এই দেখো মা আমি ঠিক আছি।
হয়েছে হয়েছে দেখছি আমি কেমন ভালো আছো তুমি।
বাহ ! তুমি একা একা দাঁড়িয়ে আকাশ দেখবে আর আমি তোমার পাশে সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ উপভোগ করবো না, তা কি হয়?
হয়েছে মা হয়েছে। তোমার আর পাকা পাকা কথা বলতে হবে না। এসেছো যখন চুপচাপ চেয়ারে বসে থাকো।
না না আমি তোমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবো।
রুমিনা আন্টি মুচকি হাসি হাসে। কিছুক্ষণ তারা চুপচাপ আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। ক্ষন পড়ে ফৌজিয়া বলে ওঠে
আচ্ছা মা! শেষ কবে বাবাকে নিয়ে একসঙ্গে আকাশ দেখেছিলে?
(কিছুটা ভ্রু কুঁচকে মুচকি হেসে ফৌজিয়া দিকে তাকিয়ে) কেন বলোতো?
আহা, বলোই না।
(অবশ্য রুমিনা আন্টি আন্দাজ করতে পেরেছেন কেন ফৌজিয়া তার শশুর মশাই মানে আলতাফ সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করছেন। দুপুরেই আলতাফ আঙ্কেল এবং রুমিনা আন্টির মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়েছে। এই নিয়ে তাদের উভয়ের মন খারাপ। কথা বলছে না দুজন দুজনের সাথে। অভিমানে চাদর যেন তাদের দুজনকে জড়িয়ে রেখেছে।)
২২ শে জুন সোমবার ২০২২ সময় বিকেল পাঁচটা। লোকেশন সেন্টমার্টিন। আমরা সবাই মিলে পরিবার হতে পিকনিকে গিয়েছিলাম তখন। তখন আমাদের একসঙ্গে আকাশ দেখা হয়েছিল দাঁড়িয়ে থেকে।(আকাশের দিকে আনমনা হয়ে চেয়ে)
হুম।বেশিদিন হচ্ছে না।
হ্যাঁ।
আচ্ছা মা! শেষ কবে বাবা তোমার চোখে চোখ রেখে ভালোবাসার কথা বলেছে?
(কিছুটা লজ্জা মিশ্রিত আবেগের সাথে) এইতো গত পরশু, আমার চোখে চোখ রেখে বলেছিল,
“ওগো আমার রমণী,
তুমি আছো বলেই হয়তো, লাগে বেশ এই ধরণী।
তোমার চক্ষু জোড়ার মাঝে হারাই আমি অলিগলি, আমি যে তোমায় বড্ড বেশিই ভালোবাসি।”
(মুচকি হেসে) মাশাআল্লাহ। বাবা কি সুন্দর তোমাকে ভালোবাসা নিবেদন করলো। আচ্ছা মা তুমি কবে বাবাকে চোখে চোখ রেখে ভালোবাসার কথা বলেছিলে?
(কিছুটা অভিমান মিশ্রিত লজ্জার সাথে, আমতা আমতা করে) ঢং! আমার যেন আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই,আমি ভালোবাসার কথা বলব!
হয়েছে হয়েছে আমি বুঝে গিয়েছি।(মুচকি হেসে) তুমিও বলেছো।
বড্ড পাকা হয়েছ তুমি।
আচ্ছা মা শেষ কবে তুমি আর বাবা একসঙ্গে হাঁটতে বের হয়েছিলে?
কি ব্যাপার তুমি এত প্রশ্ন করে যাচ্ছ আজ!
আহা মা! বলই না।
আজ সকালে ফজরের নামাজের পর।
কিছুটা মুচকি হাসি হেসে, আপেলের মাঝখানের উচ্ছিষ্ট অংশটি উপরে করে ঝুলিয়ে, রুমিনা আন্টিকে সম্বোধন করে ফৌজিয়া বলে
আচ্ছা মা এটা কি খাওয়ার যোগ্য?
অবশ্যই না। কারণ ভালো অংশটুকু তুমি খেয়ে নিয়েছো, এখন এটা তো উচ্ছিষ্ট। এটা অবশ্যই এখন তোমার ফেলে দেওয়া উচিত।
রুমিনা আন্টির কথা শেষ হতে না হতেই ফৌজিয়া উচ্ছিষ্ট সে অংশটিকে ছুড়ে মেরে দিয়ে বলে
আসলে মা আমাদের ভালোবাসা ও মধুর এই সংসারে রাগ,ক্ষোপ, ঝগড়াঝাটি , কথা কাটাকাটি ইত্যাদি গুলো ঠিক এমন। যখন এইগুলো তিক্ততায় রূপ নেয় ,তখন সেগুলো উচ্ছিষ্টে পরিণত হয়। আর তখনই আমাদের উচিত হবে এভাবে উচ্ছিষ্ট গুলোকে ছুড়ে মারা।
কিছুটা চুপ হয়ে গিয়ে, ছলছল মায়ার দৃষ্টি নিয়ে, ফৌজিয়ার দিকে তাকিয়ে, ফৌজিয়ার গালে আলতোভাবে হাতটি রেখে বলে
বড্ড বড় হয়ে গিয়েছো তুমি।
চক্ষু জল মুছে কিছুটা মুচকি হেসে রুমিনা আন্টি ফৌজিয়া কে জিজ্ঞেস করে
বলো আজকে রাতে কি খাবে? আজকে তোমার প্রিয় খাবারটি রান্না করবো।
তাই মা! তাহলে তো কথাই নেই। তোমার হাতের মজাদার সেই গোশত ভুনা। আর… টাকি মাছের ভর্তা।
(ভ্রু কুঁচকে) টাকি মাছের ভর্তা! এটা তো তোমার মোটেও পছন্দ না। এটা তো খাই তোমার শ্ব…!(শ্ব বলেই যেন থেমে যায়)
(হো হো করে হেসে দিয়ে বলে) হ্যাঁ মা হ্যাঁ, আমার শ্বশুর মশাইয়ের প্রিয় খাবার।
রুমিনা আন্টি ফৌজিয়ার কানটি ধরে বলে
বড্ড বুদ্ধি হয়েছে এই মাথায়।(হো হো হাসি দিয়ে বলে)
আউ……চ মা। লাগছে।
আমি নিচে যাচ্ছি তুমিও এসো। ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে তোমার।
রাতের খাবার টেবিলে সকলেই খেতে বসে। টেবিলে টাকি মাছের ভর্তা দেখে আলতাফ সাহেব মুচকি মুচকি হাসে এবং, ফৌজিয়ার দিকে তাকিয়ে চক্ষু ইশারাই বলে
গুড জব বেটি গুড জব।
২ সপ্তাহ পর।
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে, ছলছলো চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে ফৌজিয়া। কোথাও যেন এক অভিমানের গোঙ্গানি । অপ্রস্তুত বসতো পেছন থেকে কে যেন জিজ্ঞেস করে
শেষ কবে সাব্বিরকে নিয়ে একসঙ্গে আকাশ দেখেছিলে?
(কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে) মা তুমি!
হ্যাঁ আমি। আহা বলই না কবে একসঙ্গে সাব্বিরকে নিয়ে আকাশ দেখেছিলে?
(কিছুটা মুচকি হেসে) ২ জুলাই ২০২২ রাত দশটা। লোকেশন ঠিক এই বেলকনি।
হুম । গতরাতই।
আচ্ছা শেষ কবে সাব্বিরকে নিয়ে ফুসকা খেতে গিয়েছিলে?
গতপরশু।
আপেলের মাঝখানের উচ্ছিষ্ট একটি অংশ উপরে করে ঝুলিয়ে, ফৌজিয়াকে সম্বোধন করে রুমিনা আন্টি বলে
আমাদের ভালোবাসা ও মধুর এই সংসারে রাগ,ক্ষোপ, ঝগড়াঝাটি , কথা কাটাকাটি ইত্যাদি গুলো ঠিক এমন। যখন এইগুলো তিক্ততায় রূপ নেয় ,তখন সেগুলো উচ্ছিষ্টে পরিণত হয়। আর তখনই আমাদের উচিত হবে এভাবে উচ্ছিষ্ট গুলোকে ছুড়ে মারা।(ছুড়ে মেরে বলে)।
মুচকি হাসি হেসে, ফৌজিয়া জড়িয়ে ধরে রুমিনা আন্টিকে, এবং চোখের জল মুছে বলে
ভালোবাসি মা তোমাই অনেক বেশি।
হা হা। পাগলী।