বললে যদিও গীবত হয়ে যায় তবুও বলি…
“বললে যদিও ‘গীবত’ হয়ে যায়, তবুও বলি…।”
“তার নামে আমি ‘গীবত’ করলাম কই? আমি তো সত্যিটাই বললাম!”
“জানেন ভাবী? পাশের বাসার ভাবীর দেবরের কী হয়েছে?”
আমরা গীবতের আলোচনাগুলো ঠিক এভাবেই শুরু করি। হয় জেনেবুঝে গীবত করি, নতুবা গীবতের সংজ্ঞা না জেনেই গীবত করি। আমাদের আলোচনাগুলো থাকেই মূলত অন্যকে নিয়ে। অমুক কী করলো? কোথায় গেলো? কেনো গেলো? কেনো ওটা করলো? কেনো ওটা করলো না? এগুলোই নিয়ে চলে আমাদের আলোচনা।
ইসলাম একজন ব্যক্তির সম্মুখ বা আড়ালে নিন্দা করতে নিষেধ করে। এটা হলো ইসলামের ‘রুল অব থাম্ব’। তবে ব্যতিক্রম তো আছে (বিশেষত: অপরাধের সাক্ষ্য বর্ণনায়)। গল্পচ্ছলে একজন মানুষের দুর্নাম করা, কুৎসা রটানো, মানহানী করার বিরুদ্ধে ইসলাম সরব।
একজন মুসলিম সামনাসামনি একজন মুসলিমের ইজ্জত রক্ষা করবে, আড়ালে গেলেও তার ইজ্জত রক্ষা করবে। তার মুসলিম ভাই অপমানিত হয় এরকম কোনো কথা সে বলবে না। কুরআন কঠোরভাবে কয়েকটি কাজের নিন্দা করেছে। তারমধ্যে গীবত অন্যতম।
একই মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া একজন ভাই কতো আপন! সেই ভাই যদি মারা যায়, অন্য ভাই কতোটা মর্মাহত হবে, চিন্তা করা যায়? মৃত ভাইকে কি কেউ আঘাত করতে পারবে? তার শরীর থেকে এক টুকরো গোশত কাটতে পারবে? সেই গোশত কি সে নিজে খেতে পারবে!?
গীবত করাকে কুরআনে মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সাথে উদাহরণ দিয়েছে! একজন মানুষ যেভাবে তার মৃত ভাইয়ের মাংস খেতে পারে না, সেভাবে সে গীবত করতে পারে না।
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন:
“আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দই করে থাকো।”
[সূরা হুজুরাত ৪৯:১২]
গীবত তাহলে কী?
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গীবতের এমন স্পষ্ট সংজ্ঞা দেবার পর সেটা নিয়ে কনফিউশন থাকার কথা নয়।
একদিন তিনি সাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমরা কি জানো, গীবত কী?” সাহাবীরা জবাব দিলেন- “আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক জানেন।”
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গীবতের সংজ্ঞা দিলেন:
“গীবত হলো- তোমার ভাই সম্পর্কে এমন কিছু বলা, যা সে অপছন্দ করে।”
এমন স্পষ্ট সংজ্ঞা দেবার পরও সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, “আমি যা বলছি, সত্যিই যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে এমন কিছু থাকে?” অর্থাৎ, যার সম্পর্কে এমন কথা বলা হচ্ছে, সত্যিই তারমধ্যে এসব আছে। তবুও কি সেটা গীবত হবে?
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের কনফিউশন দূর করে বললেন:
“তুমি তার সম্পর্কে যা বলছো, তা যদি সত্যিই তার মধ্যে থেকে থাকে তাহলে তো তুমি গীবতই করলে। আর যদি তার মধ্যে না থাকে, তাহলে তো তুমি তার প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিলে।” [সহীহ মুসলিম: ৬৪৮৭]
তারমানে কারো কুৎসা রটনা করে এটা বলার কোনো সুযোগ নাই যে- ‘আমি কি মিথ্যা বলছি? গিয়ে দেখে আসো, সে আসলেই এমন।’
পূর্ববর্তী আলেমগণ গীবতের ব্যাপারে ছিলেন খুব সচেতন। তারা কেবল ওয়াজ বা লেখালেখিতেই গীবতের ব্যাপারে সচেতন করতেন না, নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনেও সেটা মেনে চলতেন।
ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) সম্পর্কে জগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রাহিমাহুল্লাহ) ইমাম সুফিয়ান আস-সাওরীকে (রাহিমাহুল্লাহ) বললেন,
“আবু হানিফাকে আমি কোনোদিন কারো গীবত করতে শুনিনি!”
জবাবে সুফিয়ান আস-সাওরী বলেছিলেন:
“আবু হানিফা তো এতোটা বোকা নন যে, গীবত করে নিজের সব নেক আমল ধ্বংস করে দিবেন।”
[তারীখ বাগদাদ ১৩/৩৬১]
ইমাম বুখারীর (রাহিমাহুল্লাহ) একজন অন্ধ ছাত্র ছিলেন। তাঁর নাম ছিলো আবু মাআশার যারীর। একদিন হাদীসের ক্লাস করার সময় ইমাম বুখারী হাদীস বলে যাচ্ছিলেন আর আবু মাআশার হাদীস শুনে মজা পেয়ে মাথা দুলাচ্ছিলেন। অন্ধ ছাত্র হাদীস শুনে এমন মজা পাচ্ছে দেখে ইমাম বুখারী হেসে দেন।
ইমাম বুখারীর মনে প্রশ্ন জাগলো- এটা কি গীবতের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায় কিনা? কারণ, ছাত্র তো অন্ধ, সে যদি দেখতে পেতো তাকে দেখে তিনি হাসছেন, সে নিশ্চয়ই কষ্ট পেতো। তাহলে তো তিনি এমন কিছু করছেন, যা সে অপছন্দ করে?
একদিন ইমাম বুখারী সেই ছাত্রকে ডেকে বললেন, “ও আবু মাআশার! আমাকে তুমি ক্ষমা করো।” ইমাম বুখারী সেদিনের ঘটনা শুনালে আবু মাআশার বললেন, “আল্লাহ আপনার প্রতি অনুগ্রহ বর্ষণ করুন। এজন্য আল্লাহর কাছে আপনাকে জবাবদিহী করতে হবে না (অর্থাৎ, আমি মাফ করে দিলাম)।”
ইমাম বুখারী নিজের সম্পর্কে বলেন:
“যেদিন থেকে আমি পরনিন্দা হারাম বলে জেনেছি, সেদিন থেকে আমি পরনিন্দা বা কারো গীবত করিনি। আমি আশা করি যে, রোজ কিয়ামতের দিন এজন্য আমার কাছে কেউ দাবীদার হতে পারবে না।”
[ইমাম বুখারী, মুহাম্মদ মুজীবুর রহমান: ৩৫]
একজন ভাইয়ের ইজ্জত রক্ষা করা আমার-আপনার দায়িত্ব। এটা ‘অপশনাল’ কোনো দায়িত্ব না, অবশ্যকর্তব্য। ঘৃণা, ঘৃণার প্রচার এবং প্রসারের রাস্তা ইসলাম সেই শুরুতেই কেটে দেয়। কারো ব্যাপারে যদি মন্দ কথা না বলেন, ঘৃণা ছড়াবে কিভাবে?