ইসলামে বহুবিবাহ নিয়ে একটি তেতো কিন্তু প্রয়োজনীয় কথা বলি। ইসলামের নাম ব্যবহার করে যারা বহুবিবাহ নিয়ে অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে ফ্যান্টাসিতে ভুগেন, তারা কি কখনো ভেবেছেন যে এটি কোনো ইসলামী বাধ্যবাধকতা নয়? বরং বহুবিবাহ একটি সামাজিক প্রথা মাত্র, যা ইসলামের অনেক আগেই বিভিন্ন সমাজে প্রচলিত ছিল। ইসলাম এটিকে অনেক শর্তসাপেক্ষে বৈধতা দিয়েছে, কিন্তু কোনোভাবেই এটি বাধ্যতামূলক করেনি।
আল্লাহ তা’আলা স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন:
“فإن خفتم ألا تعدلوا فواحدة”
অর্থাৎ, “আর যদি তোমরা আশঙ্কা কর যে, তোমরা (স্ত্রীদের মধ্যে) ন্যায়বিচার করতে পারবে না, তবে একজনেই সন্তুষ্ট থাকো।” (সূরা নিসা, আয়াত: ৩)
এখানে আল্লাহ তা’আলা পরিস্কারভাবে বলে দিয়েছেন, ন্যায়বিচার করতে অক্ষম ব্যক্তির জন্য একাধিক বিবাহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির একজন স্ত্রী রাখাই বাধ্যতামূলক।
বর্তমানে যারা “চারটি বিয়ে করব” বলে লাফিয়ে পড়েন, তাদের জন্য চরম সতর্কবার্তা আছে। বিয়ের পরে যদি কেউ স্ত্রীদের মধ্যে নূন্যতম সমতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে না পারে, তাহলে হাশরের ময়দানে তাকে চরম অপমান সহ্য করতে হবে।
রাসূলুল্লাহ (সা.), সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এবং সালফে সালেহীনদের (রহ.) জীবনে আমরা বহুবিবাহের যে উদাহরণ দেখতে পাই, সেগুলো ছিল পূর্ণ দায়িত্বশীলতা এবং মহৎ উদ্দেশ্যের সাথে সম্পৃক্ত। তাঁদের বহুবিবাহের মধ্যে কখনোই কোনো ব্যক্তিগত ফ্যান্টাসি বা প্রবৃত্তির তাড়না ছিল না। বরং তা ছিল সমাজ ও রাজনীতির প্রয়োজন মেটানোর একটি মাধ্যম। উদাহরণস্বরূপ, এক গোত্রের সঙ্গে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে সম্পর্ক উন্নত করতে অন্য গোত্রের মেয়েকে বিয়ে করা হতো। এটি অনেক সময় একজন ব্যক্তির বহুবিবাহে পরিণত হতো। তাঁদের মূল লক্ষ্য ছিল সামাজিক বন্ধন জোরদার করা। ইতিহাসে এরকম অনেক নজির রয়েছে।
বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে কী ঘটছে?
বর্তমান সময়ে বহুবিবাহের পর পরিবারে অশান্তি দেখা যায়। স্ত্রীদের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ন্যায্যতা না থাকলে স্ত্রীদের মধ্যে ঈর্ষা, দ্বন্দ্ব ও মনোমালিন্য দেখা দেয়। যার ফলে পরিবারে স্থায়ী অশান্তির সৃষ্টি হয়। সন্তানরাও এই অশান্তির শিকার হয়, যা তাদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বহুবিবাহের কারণে অনেক সময় বাবা সব স্ত্রীর সন্তানদের সমানভাবে সময় দিতে পারেন না। এতে সন্তানদের মধ্যে বৈষম্যের বোধ তৈরি করে। অনেক সময় তাদের শিক্ষা ও নৈতিকতার ব্যাপারেও অবহেলা ঘটে। বহুবিবাহের ফলে একাধিক স্ত্রীর মানসিক ও আবেগগত চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।
এটি একজন ব্যক্তির মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, যা তার জীবনে ভারসাম্যহীনতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বহুবিবাহের ক্ষেত্রে প্রতিটি স্ত্রীর প্রতি সমান দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা আখিরাতে কঠিন শাস্তির কারণ হতে পারে। রাসূল (সা.) স্পষ্টভাবে এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: “إذا كان عند الرجل امرأتان فلم يعدل بينهما جاء يوم القيامة وشقه ساقط.” অর্থাৎ, “যে ব্যক্তির দুইজন স্ত্রী রয়েছে এবং সে যদি তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার না করে, তবে কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তি তার দেহের এক পার্শ্ব ভাঙ্গা অবস্থায় উপস্থিত হবে” (তিরমিজি, হাদিস: ১১৪১)। বহুবিবাহের ক্ষেত্রে ইসলামের যে আদর্শ ও দায়িত্বশীলতা থাকা উচিত, তার ছিটেফোঁটাও আজকের সমাজে বহুবিবাহ নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভোগা অধিকাংশ লোকদের মধ্যে নেই।
আরব বিশ্বে এখন “বিবাহ সহজকরণ” নিয়ে অনেক ক্যাম্পেইন চলমান। কিন্তু “বহুবিবাহ” নিয়ে কোনো ক্যাম্পেইন নেই। কারণ এটি ইসলামের মৌলিক কোনো বিধান নয়। এটি কেবল ইসলামে বৈধ একটি বিষয় মাত্র। অতএব, এটিকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কোনো সুযোগ নেই। ইসলামের মূল শিক্ষা হলো ন্যায়বিচার, দায়িত্বশীলতা এবং পরিবারে শান্তি স্থাপন করা। এই জিনিসগুলো নিশ্চিত করতে না পারলে কোনোভাবেই বহুবিবাহ নয়, বরং একটিই যথেষ্ট।
শেষ কথা: ইসলামের একটি বৈধ কাজকে নিজের ফ্যান্টাসির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়। দায়িত্বশীলতা ও ন্যায়বিচার ছাড়া বহুবিবাহের চিন্তাই যেন আমাদের মাথায় না আসে। অন্যথায় এর জন্য মহান আল্লাহর সামনে কঠিন জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে।