Writing

বিবাহের সুন্নাতসমূহ

প্রিয় ভাই, বাস্তবতা হল, যে সমাজবিয়ে সহজ হবে, সেই সমাজে ব্যভিচার কঠিন হবে। পক্ষান্তরে যে সমাজবিয়ে কঠিন হবে, সেই সমাজে ব্যভিচার সহজ হয়ে পড়বে। এজন্য বিয়ের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ ﷺ-র মূল সুন্নাহ ছিল সহজ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা। এরপর স্বামী-স্ত্রী সৎভাবে সংসার করবে এবং সৎভাবে সংসার করার যাবতীয় উপকরণ গ্রহণ করবে।

সংক্ষিপ্তভাবে এটাই নবীজির আদর্শ; এবার ধারাবাহিকভাবে বিস্তারিত আলোচনায় আসুন:

বিয়ের নিয়ত শুদ্ধ করা

নারী-পুরুষের উভয়ের উচিত বিয়ের মাধ্যমে নিজেকে হারামে লিপ্ত হওয়া থেকে বাঁচানোর নিয়ত করা। তাহলে উভয়ে এর দ্বারা ছাদাকার ছাওয়াব লাভ করবে। কারণ, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন,
وَفِي بُضْعِ أَحَدِكُمْ صَدَقَةً ، قَالُوا : يَا رَسُولَ اللهِ ، أَيَأْتِي أَحَدُنَا شَهْوَتَهُ ، وَيَكُونُ لَهُ فِيهِ أَجْرٌ ؟ قَالَ : أَرأَيْتُمْ لَوْ وَضَعَهَا فِي الْحَرَامِ أَكَانَ عَلَيْهِ فِيهَا وِزْرٌ ؟ فَكَذَلَكَ إِذا وَضَعَهَا فِي الْحَلالِ كَانَ لَهُ فِيهَا أَجْرٌ.
‘তোমাদের সবার স্ত্রীর যোনিতেও রয়েছে ছাদাকা। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমাদের কেউ কি তার জৈবিক চাহিদা মেটাবে আর তার জন্য সে কি নেকী লাভ করবে? তিনি বললেন, ‘তোমরা কি মনে করো যদি সে ওই চাহিদা হারাম উপায়ে মেটাতো তাহলে তার জন্য কোনো গুনাহ হত না? (অবশ্যই হতো) অতএব তেমনি সে যখন তা হালাল উপায়ে মেটায়, তার জন্য নেকী লেখা হয়।’ (মুসলিম ১৬৭৪)

ইস্তিখারা করা

মুসলিম নর-নারীর জীবনে বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তাই যখন তারা বিবাহের সিদ্ধান্ত নেবেন তাদের জন্য কর্তব্য হলো ইস্তিখারা তথা আল্লাহর কাছে কল্যাণ কামনা করা। জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, ‘যখন তোমাদের কেউ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চায় সে যেন দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে অতপর বলে–

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيمِ فَإِنَّكَ تَقْدِرُ ، وَلاَ أَقْدِرُ وَتَعْلَمُ ، وَلاَ أَعْلَمُ وَأَنْتَ عَلاَّمُ الْغُيُوبِ اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ خَيْرٌ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي ، أَوْ قَالَ عَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ – فَاقْدُرْهُ لِي وَيَسِّرْهُ لِي ثُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ شَرٌّ لِي فِي دِينِي وَمَعَاشِي وَعَاقِبَةِ أَمْرِي ، أَوْ قَالَ فِي عَاجِلِ أَمْرِي وَآجِلِهِ – فَاصْرِفْهُ عَنِّي وَاصْرِفْنِي عَنْهُ وَاقْدُرْ لِي الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ ثُمَّ أَرْضِنِي.
‌‘হে আল্লাহ, আমি আপনার ইলমের মাধ্যমে আপনার নিকট কল্যাণ কামনা করছি। আপনার কুদরতের মাধ্যমে আপনার নিকট শক্তি কামনা করছি এবং আপনার মহা অনুগ্রহ কামনা করছি।‌ কেননা আপনি শক্তিধর, আমি শক্তিহীন, আপনি জ্ঞানবান, আমি জ্ঞানহীন এবং আপনি অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানী। হে আল্লাহ, এই কাজটি (এখানে উদ্দিষ্ট কাজ বা বিষয়টি উল্লেখ করবেন) আপনার জ্ঞান মোতাবেক যদি আমার দীন, আমার জীবিকা এবং আমার পরিণতির ক্ষেত্রে অথবা ইহলোক ও পরলোকে কল্যাণকর হয়, তবে তাতে আমাকে সামর্থ্য দিন। পক্ষান্তরে এই কাজটি আপনার জ্ঞান মোতাবেক যদি আমার দীন, জীবিকা ও পরিণতির দিক দিয়ে অথবা ইহকাল ও পরকালে ক্ষতিকর হয়, তবে আপনি তা আমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখুন এবং আমাকেও তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখুন এবং কল্যাণ যেখানেই থাকুক, আমার জন্য তা নির্ধারিত করে দিন। অত:পর তাতেই আমাকে পরিতুষ্ট রাখুন।
(বুখারী ১১৬৬)

পরামর্শ করা

বিয়ে ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ, পাত্রী ও তার পরিবার সম্পর্কে ভালো জানাশুনা রয়েছে এমন ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করা। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর সাহাবীদের সঙ্গে অধিক পরিমাণে পরামর্শ করতেন। আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
مَا رَأَيْتُ أَحَدًا أَكْثَرَ مَشُورَةً لأَصْحَابِهِ مِنْ رَسُولِ اللهِ ﷺ
‘আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-র চেয়ে অন্য কাউকে আপন সাথীদের সঙ্গে বেশি পরামর্শ করতে দেখি নি।’
(তিরমিযী ১৭১৪)

সৎ ও খোদাভীরু পাত্র-পাত্রীর সন্ধান

সৎ ও খোদাভীরু পাত্র-পাত্রীর সন্ধান করে বিবাহের পয়গাম পাঠানো এবং কোন বাহানা বা সুযোগে পাত্রী দেখা সম্ভব হলে, দেখে নেয়া: জাবের ইবন আবদুল্লাহ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
إِذَا خَطَبَ أَحَدُكُمُ الْمَرْأَةَ فَقَدَرَ عَلَى أَنْ يَرَى مِنْهَا مَا يُعْجِبُهُ وَيَدْعُوهُ إِلَيْهَا فَلْيَفْعَلْ. قَالَ جَابِرٌ : فَلَقَدْ خَطَبْتُ امْرَأَةً مِنْ بَنِى سَلِمَةَ فَكُنْتُ أَتَخَبَّأُ فِى أُصُولِ النَّخْلِ حَتَّى رَأَيْتُ مِنْهَا بَعْضَ مَا أَعْجَبَنِى فَتَزَوَّجْتُهَا
‘তোমাদের কেউ যখন নারীকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়, অতপর তার পক্ষে যদি ওই নারীর এতটুকু সৌন্দর্য দেখা সম্ভব হয়, যা তাকে মুগ্ধ করে এবং মেয়েটিকে (বিবাহ করতে) উদ্বুদ্ধ করে, সে যেন তা দেখে নেয়।’
(বাইহাকী, সুনান কুবরা ১৩৮৬৯)

উল্লেখ্য, আনুষ্ঠানিকভাবে ঘটা করে পাত্রী দেখানোর যে প্রথা আমাদের সমাজে প্রচলিত, তা সুন্নাতের পরিপন্থী ও পরিত্যাজ্য।-(ইমদাদুল ফাতাওয়া ৪/২০০)

সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর হওয়া

সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর হওয়া এবং আবশ্যক হল, অপচয়, অপব্যয়, বেপর্দা ও বিজাতীয় সংস্কৃতি, গান-বাদ্য, ভিডিও-অডিও মুক্ত হওয়া: আল্লাহ তাআ’লা বলেন,
إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ ۖ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا
‘নিশ্চয় অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আর শয়তান হচ্ছে তার প্রভুর প্রতি বড় অকৃতজ্ঞ।’
(বনী ইসরাঈল ২৭)

যৌতুক বা অধিক মহরানার শর্ত না থাকা

যৌতুকের আলোচনা বা সামর্থ্যের অধিক মহরানার শর্ত না থাকা; বরং মহরানা সামর্থ্যানুযায়ী ধার্য করা : কেননা, আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
إِنَّ مِنْ يُمْنِ الْمَرْأَةِ : تَيْسِيرَ خِطْبَتِهَا ، وَتَيْسِيرَ صَدَاقِهَا ، وَتَيْسِيرَ رَحِمِهَا
কনের বরকতের আলামত হচ্ছে- বিয়ের প্রস্তাবনা সহজ হওয়া, মোহরানা সহজসাধ্য হওয়া এবং গর্ভ ধারণ সহজ হওয়া।
(মুসনাদে আহমাদ ২৩৯৫৭)

অন্যত্র নবীজি ﷺ বলেছেন, خَيْرُ الصَّدَاقِ أَيْسَرَه‘সর্বোত্তম মোহরানা হচ্ছে- সহজসাধ্য মোহরানা।’
(বাইহাকী ১৪৭২১)

শাওয়াল মাসে বিবাহ সম্পাদন করা

শাওয়াল মাসে বিবাহ সম্পাদন করা: আয়েশা রাযি. বলেন,
تَزَوّجَنِي رَسُولُ اللهِ ﷺ فِي شَوّالٍ، وَبَنَى بِي فِي شَوّالٍ، فَأَيّ نِسَاءِ رَسُولِ اللهِ ﷺ كَانَ أَحْظَى عِنْدَهُ مِنِّي؟
‘রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে শাওয়াল মাসেই বিয়ে করেছেন এবং শাওয়াল মাসেই আমার বাসর করেছেন। সুতরাং তার নিকটে আমার চেয়ে অধিক সৌভাগ্যবতী স্ত্রী আর কে আছে?
(সহীহ মুসলিম ১৪২৩)

উল্লেখ্য, সকল মাসের যে কোন দিন বিবাহ করা জায়েয আছে।

খবর প্রচার এবং মসজিদে সম্পাদন করা

বিবাহের খবর ব্যাপকভাবে প্রচার করে বিবাহ করা এবং জুমা’র দিন মসজিদে সম্পাদন করা: আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
أَعْلِنُوا هَذَا النِّكَاحَ وَاجْعَلُوهُ فِي الْمَسَاجِدِ
‘তোমরা এ বিয়ের ঘোষণা দাও এবং তা মসজিদে সম্পাদন কর।’
(তিরমিযি ১০৮৯)

বরকে অভিনন্দন জানানো

রাসূল ﷺ -র শেখানো অভিনন্দনের মাধ্যমে বরকে অভিনন্দন জানানো: আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত যে, যখন কেউ বিয়ে করত তখন নবীজি ﷺ শুভেচ্ছা জানাতেন ও তার জন্য দোয়া করতেন এই বলে:
بَارَكَ اللَّهُ لَكَ ، وَبَارَكَ عَلَيْكَ ، وَجَمَعَ بَيْنَكُمَا فِي خَيْرٍ
(অর্থ- আল্লাহ তোমাকে বরকত দিন, তোমার ওপর বরকত ঢেলে দিন এবং তোমাদের দুইজনকে কল্যাণের ওপর একত্রিত করুন)।
(সুনানে আবু দাউদ ২১৩০)

ওয়ালিমা বা বৌভাত

বিয়ের ক্ষেত্রে ওয়ালিমার আয়োজন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। এটি বিয়ের প্রচারণার অন্তর্ভুক্ত এবং আনন্দ ও খুশি প্রকাশ করার শামিল।
আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত যে, আব্দুর রহমান বিন আউফ রাযি. যখন বিয়ে করেছেন তখন নবী ﷺ তাকে বলেন, أَوْلِمْ وَلَوْ بِشَاةٍ ‘একটি ছাগল দিয়ে হলেও তুমি ওয়ালিমার আয়োজন কর।’
(বুখারী ও মুসলিম)

উল্লেখ্য, ওয়ালিমায় অতিরিক্ত ব্যয় করা কিংবা খুব উঁচু মানের খানার ব্যবস্থা করা জরুরী নয়। বরং সামর্থ্যানুযায়ী খরচ করাই সুন্নাত আদায়ের জন্য যথেষ্ট।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেস সকলকে আমল করার তাওফীক দান করুক।

লিখেছেন

Picture of আমির হামজা সিদ্দিক​

আমির হামজা সিদ্দিক​

রাসুল সা: বলেছেন ,ভালো কথাও একটি সদকাহ (আল হাদিস)

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

আমির হামজা সিদ্দিক

রাসুল সা: বলেছেন ,ভালো কথাও একটি সদকাহ (আল হাদিস)

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture