বিপদ-মুসিবতে ধৈর্যধারণের ৭টি উপায়

তাকদিরের উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখা:

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘‘জমিনে এবং তোমাদের নিজদের মধ্যে এমন কোনো মুসিবত আপতিত হয় না, যা আমি সংঘটিত করার পূর্বে কিতাবে লিপিবদ্ধ রাখি না—নিশ্চয়ই এটি আল্লাহর পক্ষে খুবই সহজ—যাতে তোমরা সে বিষয়ে আফসোস না করো, যা তোমাদের থেকে হারিয়ে গেছে এবং তোমরা সে বিষয়ে উৎফুল্ল না হও, তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন (তা নিয়ে)। আর আল্লাহ কোনো উদ্ধত ও অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না।”1

দুনিয়ার জীবনের বাস্তবতা উপলব্ধি করা:

কেউ যদি দুনিয়ার জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে জানে, তবে তার জন্য বিপদ-মুসিবতে ধৈর্যধারণ করা সহজ হয়ে যায়।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘‘দুনিয়া হলো মুমিনের জন্য কারাগার আর কাফিরের জন্য জান্নাত।”2
ইমাম ইবনু রজব হাম্বলি (রাহ.) বলেন, যেহেতু দুনিয়া হচ্ছে মুমিনের কারাগার আর কাফিরের জান্নাত, সুতরাং কারাগারের বাসিন্দা যতক্ষণ না তা থেকে বের হচ্ছে, ততক্ষণ বিপদ-মুসিবত তার থেকে দূর হবে না। যখন সে এই কারাগার থেকে বের হবে, তখন সে (মনের) আশা-আকাঙ্ক্ষা (পূরণ) এবং (জান্নাতের) চিরকালীন নিয়ামতলাভে ধন্য হবে।3

প্রখ্যাত তাবি তাবিয়ি সুফিয়ান আস সাওরি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
‘যাকে দুনিয়াবি কিছু দেওয়া হয়, তাকে এ কথাও বলে দেওয়া হয় যে, অনুরূপ দুঃখও গ্রহণ করো।’ (অর্থাৎ, অনুরূপ দুঃখের জন্যও প্রস্তুত থেকো)4

বিভিন্ন দুআর মাধ্যমে ধৈর্য কামনা করা:

ধৈর্যধারণ করা নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ। আমরা যাতে ধৈর্যশীল হতে পারি, সেজন্য কীভাবে দুআ করতে হবে, আল্লাহ আমাদের তা জানিয়েছেন।

رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَّتَوَفَّنَا مُسْلِمِين
অর্থ: হে আমাদের রব! আমাদের জন্য ধৈর্যের দ্বার খুলে দিন এবং মুসলিম হিসেবে আমাদের মৃত্যু দিন।5

নবিজি এভাবে দুআ করেছেন—

اَللّٰهُمَّ أَسْأَلُكَ الرِّضَا بَعْدَ الْقَضَاءِ
(আল্লাহুম্মা আসআলুকার রিদ্বা বা’দাল ক্বাদ্বা)
হে আল্লাহ! আপনার কাছে (তাওফিক) চাই, যেন আপনার সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকতে পারি।6

ধৈর্যধারণের মর্যাদা ও লাভ সম্পর্কে জানা:

কুরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন,
‘‘অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করবো—কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ ও জীবনের ক্ষতি এবং ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের; তাদেরকে যখন বিপদ আক্রান্ত করে, তখন বলে—নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী। তাদের জন্যই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও রহমত এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত।’’7

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“হে আবু বকর, আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন, তুমি কি অসুস্থ হও না? তুমি কি কষ্ট পাও না? তুমি কি দুঃখ-দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হও না? মুসিবত তোমাকে কি পিষ্ট করে না?’’
আবু বকর বলেন, ‘অবশ্যই।’ তখন নবিজি বললেন, ‘‘এগুলো তোমাদের (গুনাহের) প্রায়শ্চিত্ত।”8

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘‘যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য এমন মর্যাদা নির্ধারণ করা থাকে, যেখানে সে তার আমল দ্বারা পৌঁছানোর যোগ্যতা রাখে না, তখন আল্লাহ্ তাকে তার শরীর অথবা তার সম্পদ কিংবা তার সন্তান-সন্ততির প্রতি বিপদ-আপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন এবং তাকে ঐ বিপদের উপর ধৈর্যধারণ করার তাওফিক দেন। শেষ পর্যন্ত তাকে ঐ নির্ধারিত মর্যাদায় পৌঁছে দেন।’’9

আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
‘‘যখন আল্লাহ তাঁর বান্দার কল্যাণ চান, তখন তিনি তাকে দ্রুত দুনিয়াতে শাস্তি দিয়ে দেন। আর, যখন আল্লাহ তাঁর বান্দার অকল্যাণ চান, তখন তিনি তাকে (শাস্তিদানে) বিরত থাকেন। পরিশেষে কিয়ামতের দিন তাকে পুরোপুরি শাস্তি দেবেন।’’10

ধৈর্যধারণের বাস্তবতা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করা:

আলি ইবনু আবি ত্বলিব (রা.) বলেন,
‘(বিপদে) তুমি সবর করলে তোমার উপর তাকদির কার্যকর হবে এবং তুমি নেকি লাভ করবে। অন্যদিকে, তুমি যদি সবর না করো, তবুও তোমার উপর তাকদির কার্যকর হবে অথচ তুমি গুনাহগার হবে।’11
হাদিসে এসেছে, আল্লাহ যখন কোনো সম্প্রদায়কে ভালবাসেন, তখন তাদের (বিপদ-মুসিবত দ্বারা) পরীক্ষা করেন। এতে যারা সন্তুষ্ট থাকে, তাদের জন্য (আল্লাহর) সন্তুষ্টি আর যারা এতে অসন্তুষ্ট থাকে, তাদের জন্য (আল্লাহর) অসন্তুষ্টি।12

ধৈর্যধারণের চেষ্টা অন্তত করা:

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘‘যে ধৈর্যধারণ-(এর চেষ্টা) করে, আল্লাহ তাকে ধৈর্যধারণের সক্ষমতা দেন।’’13

অধিকতর বিপদগ্রস্তকে দেখে সান্ত্বনা নেওয়া:

নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“যে তোমাদের চেয়ে নীচে রয়েছে, তার দিকে তাকাও; যে তোমাদের চেয়ে উপরে আছে, তার দিকে তাকিয়ো না। আল্লাহর নিয়ামতকে তুচ্ছ না ভাবার এটাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।”14

অন্য হাদিসে তিনি বলেন, “তোমাদের কারো নজর যদি এমন লোকের উপর পড়ে, যাকে ধন-সম্পদ ও দৈহিক গঠনে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে, তবে সে যেন এমন লোকের দিকে নজর দেয়, যে তার চেয়ে নিম্ন স্তরে রয়েছে।”15

আমরা যতই বিপদগ্রস্ত হই-না-কেন, আশেপাশে তাকালে আমাদের চেয়েও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ দেখতে পাবো। আসুন, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি যে, তিনি আমাদেরকে অনেকের চেয়ে ভালো রেখেছেন।

লিখেছেন

নুসুস টিম

কুরআন ও হাদিসের মূল পাঠকে নুসুস (text) বলা হয়। নুসুসের উপর ভিত্তি করেই আমরা লেখালেখি করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন
  1. সুরা হাদিদ, আয়াত: ২২-২৩ ↩︎
  2. ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৭৩০৭ ↩︎
  3. মাজমুউর রাসাইল: ১/২২৩ ↩︎
  4. ইমাম আবু নুআইম, হিলয়াতুল আউলিয়া: ৭/২১ ↩︎
  5. সুরা আরাফ, আয়াত: ১২৬ ↩︎
  6. ইমাম নাসায়ি, আস-সুনান: ১৩০৫; হাদিসটি সহিহ ↩︎
  7. সুরা বাকারাহ, আয়াত: ১৫৫-১৫৭ ↩︎
  8. ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ: ৭০; হাদিসটি সহিহ ↩︎
  9. ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান: ৩০৯০; হাদিসটি সহিহ ↩︎
  10. ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান: ২৩৯৬; হাদিসটি সহিহ ↩︎
  11. ইমাম মাওয়ার্দি, আদাবুদ দুনিয়া ওয়াদ দ্বীন, পৃষ্ঠা: ৪০৭ ↩︎
  12. ইমাম ইবনু মাজাহ, আস-সুনান: ৪০৩১; হাদিসটি হাসান ↩︎
  13. ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ১৪৬৯ ↩︎
  14. ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৭৩২০ ↩︎
  15. ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৬৪৯০ ↩︎
Exit mobile version