বিজ্ঞান সিরিজ – ০৪ মানব মস্তিষ্ক মহাবিস্ময়কর সৃষ্টি
ঠিক এই মুহুর্তে আপনি ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। কিছু আকৃতি, রেখা, বিন্দু ইত্যাদি দিয়ে অর্থবোধক সাংকেতিক চিহ্ন গুলো আপনার চোখের রেটিনা দিয়ে প্রবেশ করছে, আর এক মাইক্রো সেকেন্ডেরও কম সময়ে আপনার মস্তিষ্ক তা পড়ে ফেলছে! আপনাকে বলে দিচ্ছে এটা মস্তিষ্ক সংক্রান্ত একটা আর্টিকেল! দরুন না ব্যাপারটা?
ভেবে দেখেছেন কি?
কিভাবে কাজ করছে আপনার মস্তিষ্ক! আর কি কি ক্ষমতাই বা আছে তার! তাকে কতো চমৎকার চমৎকার সব মেকানিজম ঢেলে সাজিয়েছেন আল্লাহ তাআ’লা! আসুন এই এপিসোডে আজ নিজের মস্তিষ্ক দিয়ে নিজের মস্তিষ্ককে চিন্তা করি। যাকে বলে Self-knowledge (নিজেই নিজেকে চেনা)
সেই প্রাচীন কাল থেকেই মস্তিষ্কের রহস্য উন্মোচনে কাজ করে আসছে লক্ষ লক্ষ বিজ্ঞানী। হাজার হাজার বৎসর সাধনা করেও কমে যায়নি এর রহস্য! কমে যায়নি অবাক বিষ্ময়ের মাত্রা। এটাই একমাত্র বস্তু যে কিনা নিজের নাম নিজে রেখেছে!
এই মস্তিষ্ক দিয়েই আলবার্ট আইনস্টাইন বের করেছেন আপেক্ষিক তত্ত্ব, নিউটন বের করেছে মহাকর্ষ সূত্র, স্টিফেন হকিং বের করেছেন ব্লাক হোল তত্ত্ব, আবিষ্কৃত হয়েছে রকেট, বিমান, উড়ন্ত যান, টেলিফোন, কম্পিউটার, আকাশ ছোঁয়া সব ভবন, আবার এই মস্তিষ্কের সাহায্যেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন গীতাঞ্জলি, কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন বিদ্রোহী সব কবিতা, মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখেছেন মহাকাব্য, এই মস্তিষ্কের সাহায্যে আবিষ্কৃত সব যন্ত্র দেখে অবাক বিষ্ময়ে আমরা ‘থ’ হয়ে তাকিয়ে থাকি! আজ আমরা ঠিক এমন একটা বস্তুর ভেতর প্রবেশ করে প্রতিটি নিউরনে নিউরনে আল্লাহ পাকের মহত্ত্বকে অনুধাবন করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ!
আপনি তৈরি তো? চলুন শুরু করা যাক এবার!
‘কথা কম কাজ বেশি’ বহুল প্রচলিত একটি বাক্য। আজকের পৃথিবীতে যে জিনিসের যতো দ্রুত কাজ, তাকে ততই আধুনিক ও উন্নত বলে ধরা হয় বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে। কম্পিউটার নাম শুনেননি এমন লোক খুবই কম। চরম বিষ্ময়কর একটি যন্ত্র কম্পিউটার। খুব দ্রুত নিখুঁত ভাবে শত-শত কাজ করে দিতে পারে। কিন্তু আপনি কি জানেন? আমাদের মস্তিষ্কের সামনে এই কম্পিউটারও নস্যি! কারণ আমাদের মস্তিষ্ক প্রতি সেকেন্ডে ১০১৫ টি হিসাব করার ক্ষমতা রাখে, যা পৃথিবীর কোন সাধারণ কম্পিউটার তো দূরের কথা সুপার কম্পিউটারও করতে অক্ষম! আমাদের মস্তিষ্কে যতোখানি স্মৃতি ধারণ ক্ষমতা রয়েছে তা লক্ষ লক্ষ কম্পিউটারের মাঝেও নেই। এমনকি এই মস্তিষ্ক দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত লাইব্রেরীর বই ধারণ করা সম্ভব!
আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য হলো- যদি আপনার মস্তিষ্ক কোনো কম্পিউটার হতো তবে তা প্রায় ৩৮ হাজার ট্রিলিয়ন কাজ এক সেকেন্ডের মধ্যেই করে দিতে পারতো! বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম সুপার-কম্পিউটার ব্লু জিন (Blue Gene) প্রতি সেকেন্ডে মানুষের মস্তিষ্কের মাত্র ০.০০২% কাজ করতে পারে।
ভেবে দেখুন একবার, ৩৮ হাজার ট্রিলিয়ন কাজ আমাদের মস্তিষ্ক ১ সেকেন্ড করে দিতো। কি পরিমাণ কাজের এই মস্তিষ্ক! এই বিষ্ময়টি আরেকটু উপভোগ করতে আপনি ৩৮ হাজার ট্রিলিয়ন বলতে ৩৮ এর পর কতোটি শূণ্য প্রয়োজন? এটা একটু ভাবতে পারেন!
উঁহু বিশাল গাণিতিক ব্যাপার-স্যাপার! পারছেন না তো ভাবতে? তাহলে আসুন এবার কিছু প্রাকটিক্যাল উদাহরণ দেই মস্তিষ্কের দ্রুত কাজ করা সম্পর্কে।
আপনার মস্তিষ্ক কতোটা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় তা কি আপনি জানেন?
মনে করুন, আপনি আপনার বন্ধুর দিকে মুখ ভেংচিয়ে তাকিয়ে আছেন। তাকে যথেষ্ট পরিমাণে রাগাতে আপনি আরেকটি কাজ করেলেন। তার হাতের উপর ডেঁয়ো পিঁপড়ের মতো ৮ মাত্রা পরিমাণ কিট্টুস করে দিলেন এক চিমটি! আপনার বন্ধু রাগে ফুলে ফেঁপে উঠলো। হঠাৎ করেই আপনার গালে ঠাস করে থাপ্পড় দিতে যাবে, কিন্তু আপনি ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিয়ে গাল দুটো সরিয়ে নিলেন। বেঁচে গেলেন চরম একটা কষা করে থাপ্পড় থেকে! খুশিতে বাকি দাঁতের পাটি গুলো বের হয়ে এলো আপনার!
আবার ধরুন, আপনি রাস্তা পার হচ্ছেন। সড়কদ্বীপ অতিক্রম করে যেই রাস্তার মাঝে চলে এলেন হঠাৎ আপনি খেয়াল করলেন পশ্চিম দিক থেকে তীব্রবেগে একটি বাস আসছে। আর মাত্র কয়েক মিটার দূরে বাসটি। ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিয়ে দুই লাফে পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। যেনো যায় যায় প্রানটা ফিরে পেলেন আপনি!
আবার দেখে থাকবেন হঠাৎ সুচের গুঁতো লাগলে, গরম পাতিলে হাত লাগলে, কাঁটার আঘাত লাগলে অটোমেটিক ত্বরিত গতিতে হাত সরে আসে আপনার।
এখন প্রশ্ন হলো, কে আপনাকে বলে দিলো যে দ্রুত মাথা সরিয়ে থাপ্পড় থেকে বাঁচতে! কে বলে দিলো পিছনে লাফ দিয়ে বাসের এক্সিডেন্টের হাত থেকে বাঁচতে! কে বলে দিলো বাপরে এটা সুচ! কে বলে দিলো বাপরে এটা গরম পাতিল! হাত সরিয়ে নাও?
হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি, একজন আপনাকে বলে দিয়েছিলো (দ্রুত সরে যেতে/সরিয়ে নিতে) সেটা হলো আপনার মস্তিষ্ক..!
মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ভিতর পরিকল্পনা গ্রহন, নির্দেশনা ও বাস্তবায়নের কাজটি আপনার মস্তিষ্কই করেছে। কি অসাধারণ দক্ষতা নিয়ে! এটাই আমাদের মস্তিষ্ক প্রিয় পাঠক। মস্তিষ্ক এর ওজন কতো জানেন?
মাত্র ১৩০৫ গ্রাম!
একটি সুপার-কম্পিউটার যে তথ্য জমা রাখে মানুষের মস্তিষ্ক তার চাইতে ১ লক্ষ গুন বেশি তথ্য ধারণ করতে সক্ষম। এর কাজের দ্রুততা দেখে আপনি অবাক না হয়ে পারবেন না। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, জটিল সব সমস্যার সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে মানব মস্তিষ্ক প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১ কোটি গানিতিক ক্যালকুলেশন করতে সক্ষম। ভেবে দেখুন তো একবার! এরজন্য কতোগুলো নিউরনের প্রয়োজন! কতো নিখুঁত করে সাজানো প্রয়োজন!
আপনি কি জানেন? আমাদের মস্তিষ্কে মাত্র একটি নিউরনই প্রতি সেকেন্ডে ১,০০০ সংকেত পাঠাতে পারে। আবার প্রতিটি নিউরন অন্যান্য নিউরন এর সাথে প্রায় দশ হাজার বন্ধন তৈরি করে।
একটি গমের দানার সমপরিমাণ মস্তিষ্ক টিস্যুতে ১ লক্ষের মতো নিউরন থাকে, যেগুলো পরস্পরের সাথে এক বিলিয়ন বন্ধন তৈরি করে। তাহলে মোট নিউরনের সংখ্যা কত? নিখুঁত হিসেব এখনও পাওয়া যায়নি। তবে বিজ্ঞানিদের ধারণা, সেটা ৮৬ বিলিয়নের কম না। এদের সবাই একরকম তা নয়। প্রায় ১০ হাজার বিভিন্ন রকম নিউরন রয়েছে।
ভেবে দেখুন একবার, ৮৬ বিলিয়ন নিউরন নিয়ে গঠিত আমাদের মস্তিষ্ক!
চলুন এবার, মস্তিষ্কের এই ৮৬ বিলিয়ন নিউরন সেলের মহাসমুদ্রে ডুব দিয়ে মহান রবের ক্ষমতা ও মহত্ত্ব অনুধাবনের এক রাজত্ব নিয়ে এসে শেষ করি আর্টিকেল টা!
হালকা মাত্রায় চিন্তা করুন তো, আপনার মস্তিষ্কের ভেতরে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন নিউরন একটার পর একটা সাজিয়ে তৈরি হয়েছে বিশাল এক কলোনি , তৈরি হয়েছে বৈদ্যুতিক অভাবনীয় একটি যোগাযোগ ব্যাবস্থা। যার কাজ হলো পুরো দেহ পরিচালনা করা। এটাকে আমরা নাম দিয়েছি সেরিব্রোস্পাইন্যাল স্নায়ূ মণ্ডলী বা নার্ভাস সিস্টেম।
আপনি হলেন আপনার দেহের রাজা। আপনার হাত, পা, গলা, কান, চোখ, মুখ, পেট ইত্যাদি আপনার রাজ্যের একেকটা মহল মনে করুন। কোন মহলে কি কাজ হবে না হবে, কিভাবে মহলের সংস্করণ হবে, মহলে কোনো ক্ষতি সাধন হলো কিনা তা আপনার মস্তিষ্ক আপনাকে জানান দেয়। এজন্য আপনি হাত কেটে গেলে বুঝতে পারেন আপনার কেটে গেছে! নতুবা হাত কেটে পরে থাকতো আর আপনি চলে যেতেন! বুঝতেই পারতেন না। মস্তিষ্কের এই ক্ষমতার জন্য আপনার চামড়ায় কেউ চিমটি কাটলে আপনি টের পান। আবার কেউ কাতুকুতু দিলে সুরসুরি পান। কখনো কি নিজে নিজে কাতুকুতু দিয়েছেন? না দিলে দিয়ে দেখুন। কি সুরসুরি লাগে না তাইনা! এর কারণ হলো আপনার মস্তিষ্ক আপনার স্পর্শ এবং অন্য কারও স্পর্শের পার্থক্য করতে পারে!
এই স্নায়ু গুলোও আবার চমৎকার সব জিনিস দিয়ে সাজানো। তার মধ্যে হলো- ডেনড্রাইট্স, নার্ভ সেল, নার্ভ এক্সান, নিউরিলেমা, মেডালারি সেদ।
মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ থেকে বার্তা যাওয়া ও আসার জন্য পৃথক পৃথক Nerve Fiber থাকে। এই কাজ এতো দ্রুত চলে থাকে যে কল্পনা করাও যায় না। Nerve Impulse-এর যারার গতিবেগ প্রায় ইলেক্ট্রিসিটির মতো।
ভেবে দেখুন একবার, আপনার মস্তিষ্কে বার্তা আদান প্রদান বিদ্যুতের গতিতে হয়ে থাকে। যার কারণেই তৎক্ষণাৎ কোনো সিদ্ধান্ত মস্তিষ্ক নিজে নিজেই নিতে পারে। বিপদ থেকে বেঁচে যায়। উপরে যেমন উদাহরণ গুলো দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেখেছেন? সেখানকার ইলেকট্রনিক উৎপাদন কেন্দ্রে থাকে একটি Power Station এবং এই পাওয়ার স্টেশন এর সঙ্গে যুক্ত থাকে ছোট ছোট তার দিয়ে লক্ষ লক্ষ Point এর, তেমনি ব্রেনের সাথে সব স্নায়ুতন্ত্রের যোগ থাকে এই Nerve Fiber দিয়ে। মানে কোটি কোটি স্নায়ু যুক্ত হয়ে মস্তিষ্কের জটিল সব কাজ করে দিচ্ছে নিমিষেই!
এমন দারুণ সব সিস্টেমে গড়া চমকপ্রদ মূল্যবান মস্তিষ্কটিকে সুরক্ষা প্রদান করার জন্য রয়েছে আবার একটি পর্দা যার নাম ব্লাড-ব্রেইন-ব্যারিয়ার। রক্ত থেকে মস্তিষ্কে কী যাবে তা নিয়ন্ত্রণ করে দেয় এই পর্দা। ক্ষতিকর পদার্থ এই পর্দা ভেদ করে সাধারণত যেতে পারে না।
এবার এখান থেকে কিছু প্রশ্ন করি আমি।
আচ্ছা বলুন তো এতো দুর্দান্ত চমকপ্রদ এমন একটি মস্তিষ্ক বানাতে কোনো ইঞ্জিনিয়ারের দরকার হয়নি? কোনো মহাজ্ঞানী এর পেছনে কাজ করেনি? এর বৃদ্ধি, বিকাশ, শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সব নিপুণভাবে সাজাতে কোনো বুদ্ধিমত্তার কি পরিকল্পনা ছিলো না এটা? নাকি এমনি এমনি হয়ে গেছে?
একদিকে মহাবিষ্ময়কর এই মস্তিষ্ক, অপরদিকে মস্তিষ্কের সুরক্ষার জন্য চমৎকার সব সু-ব্যাবস্থা!
ঠিক এই মুহূর্তে এই বিষয়টি হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করতে পারলে আপনার ইচ্ছে করবে, যে সত্তা এতো নিখুঁত মেকানিজমে সাজিয়ে আপনার মস্তিষ্কটি বানিয়েছেন সেই মহাজ্ঞানী সত্তার সামনে আপনার ১৩০৫ গ্রামের মস্তিষ্কটি ঝুঁকিয়ে দিয়ে বলতে- “হে আমার রব, আমি চাইনি এতো কিছু, চাইনি এতো বিশাল সমগ্রের নিউরন সেলে ভর্তি সুপার-কম্পিউটার থেকে শত গুণে শ্রেষ্ঠ আজব একটি মস্তিষ্ক, তুমিই দিয়েছ মাবুদ, না চাইতেই তুমি দিয়েছ এসব, তুমি দিয়েছ এর চিন্তাশক্তি, তুমিই দিয়েছো এর সৃজনশীল শক্তি, তুমিই দিয়েছ এর অনুধাবন করার ক্ষমতা, জ্ঞান অর্জনের বিশাল মেগাবাইটের এক মেমোরি। নতুবা আমি তো শেয়াল, কুকুর,বেড়ালের মতো জ্ঞানহীন অবুঝ হয়ে জন্ম নিতাম!
কি? অনুধাবন হচ্ছে কিছুটা?
সাহায্যকারী বই: এ্যানাটমি শিক্ষা।
কসমোলজি অফ মাস্টার প্লানার
বিজ্ঞান সিরিজ – ০১
বিজ্ঞান সিরিজ – ০২
বিজ্ঞান সিরিজ – ০৩