“তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো, ছেড়ে দেবো না!…”
এই হৃদপিণ্ড নিয়ে গান, কবিতা কিন্তু কম রচনা হয়নি! মানবদেহে এটাই একমাত্র অঙ্গ যে অঙ্গ শুধু বিজ্ঞানীদেরই নয় বরং কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, গায়ক, বুদ্ধিজীবী সকলকে উদ্দীপ্ত করে রেখেছে!
চিন্তার ভাঁজে ছন্দপ্রবাহ এনে দিয়েছে। বিশাল বিশাল গালভরা তত্ত্বকথায় সাহিত্যসম্ভার সমৃদ্ধ করেছে। নানা প্রেমকাহিনী উপাখ্যানেও হৃদপিণ্ডের বিস্তর চর্চা! কিন্তু তা কেবল ওই হৃদপিণ্ড জুড়েই সীমাবদ্ধ! হৃদপিণ্ডের পরতে পরতে কবি সাহিত্যেকেরা শুধু প্রেমিক/প্রেমিকার গন্ধই যেন চষে বেড়িয়েছে!
কিন্তু আফসোস!
প্রেমিকার জন্য বরাদ্দ রাখা সেই হৃদপিণ্ডটা যে কতোটা আশ্চর্যজনক সব মেকানিজমে ভরপুর তার কিয়দাংশও যদি আমরা অনুধাবন করতাম! তবে আর যাই হোক হৃদয় মাঝে কোনো লায়লীকে বসানোর আগে হৃদয়ের ক্রিয়েটরের কথা একটিবার হলেও চিন্তা করতাম!
সেজদায় লুটিয়ে পড়ে বলতাম; কতো ক্রিয়েটিভ আমার রব! কি নিপুণ দক্ষতায় না গড়েছেন আমায়!
আচ্ছা, আপনার কি মনে আছে প্রথম হৃৎস্পন্দনের কথা! যখন আপনি মায়ের পেটে কেবল ৩ সপ্তাহের ভ্রূণ। শরীর তখনো ভঙ্গুর, হাত-পা, মাথা, চোখ-কান তখন সবেমাত্র আকৃতি পেতে শুরু করেছে! এমন মুহুর্তে আপনার বুকের খাঁচায় সদ্য বেড়ে ওঠা হৃদযন্ত্রের দু’টি অলিন্দে কে যেন চাবি টেনে দিলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য! অস্তিত্ব পেলো গোটা দেহের ছড়ানো শিরা-উপশিরায় রক্ত পাঠানোর এক অদ্ভুত জেনারেটর!
কে যেন নাটকীয়ভাবে নির্দেশ দিলো; ওমনি জেনারেটরটা স্টার্ট নিলো ডিপ-ডিপ আওয়াজে! ওই যে শুরু এরপর মিনিটে ৭০ বার, বছরে সাড়ে তিন কোটি বার এবং সারা জীবনে ২ ট্রিলিয়ন বার কাজ করে এটি। গোটা জীবনে প্রায় ১৫ লাখ ব্যারেল রক্ত সঞ্চালন করে থাকে! অদ্ভুত ব্যাপার হলো এর জন্য লাগে না কোনো তেল, লাগে না ডিজেল চলছে তো চলছেই! একটু বুকের বা-পাশে হাত দিয়ে নিরিবিলি বসে ভাবুন না, ডিপ ডিপ করা এই জেনারেটর জন্মলগ্ন থেকে কিভাবে কারো সাহায্য ছাড়াই একা একাই চলছে! কে তাকে শরীরের কোটি কোটি কোষে রক্ত পৌঁছনোর কাজ দিলেন!
আপনি ঘুনাক্ষরেও টের পাচ্ছেন না, দেখতে পাচ্ছেন না, ওটা নিয়ে ভাবছেন না, কিংবা ওকে সাহায্যও করছেন না, অথচ অনবরত চলছেই! একটুও কি আশ্চর্য লাগে না?
না লাগলে, আসুন আরও গভীর পর্যালোচনায়!
আপনি জানলে আরও আশ্চর্য হবেন যে, এতটুকুন ছোট্ট একটা জেনারেটর (হৃদপিণ্ড) কতোটা বিস্তৃত দৈর্ঘ্যের রক্তনালির মাধ্যমে রক্ত সংবহন করছে! তা-ও সংখ্যাটা হাজার দিয়েও নয়। লক্ষ দিয়ে!
মানুষের রক্তসংবহনের জন্য যে ধমনী, শিরা ও কৈশিক জালিকা রয়েছে এদের সর্বমোট দৈর্ঘ্য ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) কিলোমিটার! যদি সবগুলো রক্তনালিকা একটির সাথে আরেকটি জোড়া লাগানো হয় এবং দুই প্রান্ত স্থাপন করা হয় তবে প্রায় আড়াইবার সমগ্র পৃথিবীর চারপাশে পরিভ্রমণ করা যাবে!
সুবহানাল্লাহ!
চিন্তা করুন একবার! এতটুকুন যন্ত্রের রক্ত পরিবহন ক্ষমতা কতো বিশাল!
মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় শিশুর হার্ট ১৪০-১৬০ বার সঙ্কোচন করে থাকে যা তার জন্য স্বাভাবিক। অথচ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হার্ট এ গতিতে কয়েক সপ্তাহ চলতে থাকলে হার্ট আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হতে বাধ্য। হৃৎপিণ্ডের কাজের এই বৈচিত্র্যতা আসলে বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এটা মহান আল্লাহ তায়ালারই সৃষ্টি ক্ষমতার অপূর্ব নিদর্শন।
এবার আসুন এই বিষ্ময়কর জেনারেটরটির শক্তির ব্যাপারে জানা যাক!
প্রতিদিন হার্ট যে শক্তি উৎপন্ন করে থাকে তা দিয়ে একটি ট্রাক ২০ মাইল যেতে পারবে এবং সারাজীবনে যে শক্তি উৎপন্ন হয়, তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে চাঁদে যাওয়া এবং ফিরে আসা সম্ভব। আমাদের শরীরে প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন কোষ রয়েছে। হার্টের মাধ্যমে প্রতিটি কোষে দিনে ১০০০ বার রক্ত সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এর ব্যতিক্রম শুধু চোখের কর্নিয়া। এর মধ্যে কোনো রক্তনালী নেই। কাজেই হার্ট তাকে অক্সিজেন সরবরাহ করে না। বাতাস থেকে এবং চোখের অশ্রু থেকে সে অক্সিজেন পেয়ে থাকে। এখানেও মহান আল্লাহ তায়ালার অসীম প্রজ্ঞা ক্রিয়াশীল। কর্নিয়ায় যদি সূক্ষ্মতম রক্তনালীও থাকত, তাহলে আমাদের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যেত। আল্লাহ যে একক সত্ত্বা এটি তারই নিদর্শন! কেননা হৃদপিণ্ডের জন্য এক দেবতা আর চোখের জন্য আরেকজন থাকলে হিসেবে গড়মিল দেখা দিত!
আবার হার্টের রয়েছে বিশেষ ইলেকট্রিক সার্কিট। SA Node, AV Node, Bundle of His, Purkinje fibre।
SA Node হচ্ছে টিম লিডার। তার মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় যার কারণে হার্ট ৬০-১০০ বার সঙ্কোচন করে থাকে। সে কাজে অক্ষম হয়ে পড়লে, AV Node নেতৃত্ব গ্রহণ করে থাকে। তার কার্যক্ষমতা ৪০-৬০ বার। সেও দুর্বল হয়ে গেলে, Bundle of His দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকে যার কার্যক্ষমতা আরো কম। আর এভাবেই আল্লাহ তায়ালা কয়েক স্তরে হার্টের তথা জীবন-সুরক্ষার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। এই ইলেকট্রনিক সিস্টেমের কারণে হার্টের কর্মকাণ্ডে ছন্দময়তা আছে। হার্টের অলিন্দ যখন সঙ্কুচিত হয়, নিলয় তখন সম্প্রসারিত হয়। একই সময়ে অলিন্দ-নিলয় সঙ্কুচিত হলে শরীরে রক্ত সরবরাহে চরম ব্যাঘাত ঘটত।
SA Nodeকে প্রাকৃতিক পেসমেকার বলা হয় যা ডান অলিন্দে অবস্থিত এবং এর দৈর্ঘ্য প্রায় ০.৫ ইঞ্চি। প্রতি ৬০০ জনের মধ্যে একজনের বৃদ্ধ বয়সে এটির কার্যক্ষমতা নষ্ট হতে পারে। বাকিদের ক্ষেত্রে এটি সারাজীবন কর্মক্ষম থাকে।
পেসমেকার অকার্যকর হলে আমাদের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের জন্য কৃত্রিম পেসমেকার বুকের চামড়ার নিচে সংস্থাপন করা হয়। এটি আয়তনে অনেক বড় এবং ১০০% ক্ষেত্রে ১০-১২ বছর পরপর এটি প্রতিস্থাপন করতে হয়। আল্লাহর তৈরি পেসমেকারের চেয়ে এটি কত দুর্বল! আসলে আল্লাহর অসীম জ্ঞানের তুলনায় মানুষের জ্ঞান খুবই সীমিত।‘তোমাদেরকে খুব কমই জ্ঞান দান করা হয়েছে।’ (আল কুরআন ১৭ : ৮৫)
হার্টের কার্যক্রমে আরো ব্যতিক্রম রয়েছে। এর একেকটি Cardiac Cycle-এর দৈর্ঘ্য ০.৮ সে.। মিনিটে ৭০ বার গড়ে এই Cycle-এর পুনরাবৃত্তি হয়ে থাকে। ০.৮ সে. এর মধ্যে ০.৩ সে. সে কাজ করে আর ০.৫ সে. বিশ্রাম নেয়। অর্থাৎ কাজের চেয়ে সে বেশি বিশ্রাম করে থাকে। যাকে বিরতিহীনভাবে সারাজীবন কাজ করতে হবে, তার শক্তি সংরক্ষণের ব্যবস্থা আল্লাহ তায়ালা এভাবেই করে দিয়েছেন।
এবার মানুষের তৈরি কৃত্রিম জেনারেটরের কথা ধরুন! সেটা বিরতিহীনভাবে কাজ করতে পারে না। আবার ১০-১২ বছরের বেশি টেকে না। এর মধ্যে আবার কতো সার্ভিসিং করতে হয়, যন্ত্রাংশ পাল্টাতে হয়। অথচ রবের তৈরি এই জেনারেটর টানা ৭০-৮০ কারো বেলায় ১৩০ বছর পর্যন্ত চলতে থাকে, কোনো সার্ভিসিং করাতে হয় না, মরিচা পড়ে না, ক্ষয়েও যায় না! আবার কৃত্রিম জেনারেটরের মতো কান ঝালাপালা করার মতো ঘটঘট শব্দও করে না! প্রচন্ডভাবে কাঁপেও না যে চলতে ফিরতে ঝাঁকুনি খেয়ে খেয়ে চলতে হবে!
আল্লাহু আকবর! কতো মহাবিজ্ঞানী আমাদের রব! অথচ এতো এতো জটিল সূক্ষ্ম যন্ত্রে সমৃদ্ধ হৃদপিণ্ড নিয়ে আমরা তাঁর নেয়ামতের অস্বীকার করি! কতোবড়ো নিমকহারাম আমরা!
এজন্য তো রব বলেছেন;
মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ।
[সূরা আল-ইসরাঃ৬৭]
কসমোলজি অফ মাস্টার প্লানার
বিজ্ঞান সিরিজ – ০১
বিজ্ঞান সিরিজ – ০২