বেস্ট সেলিং বুক বনাম বেস্ট রাইটিং বুক
“বইটি অনেক ভালো। বাজারে এই বিষয়ে এরচেয়ে ভালো বই নেই। কিন্তু, বইটি তেমন বিক্রি হলো না!”
অনেক লেখক, প্রকাশকের মধ্যে এই কনসার্ন। একটি ভালো বই বিক্রি হচ্ছে না, একটি ভালো প্রোডাক্ট বিক্রি হচ্ছে না। এমনটা মনে হবার কারণ হলো, লেখক-প্রকাশক ধরেই নেন- ভালো বই = বেশি বিক্রি।
এমন সমীকরণ মিলতে পারে, না-ও মিলতে পারে। সাধারণত ৮-১০% ক্রেতা ‘ভালো বই’ দেখে বই কিনে। কিন্তু, বেশিরভাগ ক্রেতা ‘প্রভাবিত’ হয়ে বই কিনে। প্রভাবিত হবার কারণ হতে পারে লেখক, হতে পারে সেটা বইয়ের মার্কেটিং, পাঠকের রিভিউ ইত্যাদি।
আমি একজন লেখক হিশেবে লেখকের মনস্তত্ত্ব, প্রকাশনীর সিওও হিশেবে প্রকাশনীর মনস্তত্ত্ব দুটোই আঁচ করতে পারি। যার কারণে, দুই বছর আগের চিন্তা আর এখনকার চিন্তা রিলেট করতে পারি।
একজন লেখক হিশেবে একটি বই লেখার পর বা লেখার সময় আমি চিন্তা করবো এই বইটি থেকে আমি কী ফলাফল প্রত্যাশা করছি। বইটি এই বিষয়ের সেরা বই হবে নাকি বইটি মার্কেটে হিট করবে এমন আশা নিয়ে লিখছি। দুটো চিন্তার কোনোটাই নেতিবাচক হিশেবে দেখি না। একটা বই একইসাথে বেস্ট সেলিং এবং বেস্ট রাইটিং হতে পারে; একটা আরেকটার বিপরীত না।
বর্তমানে যেসব ইসলামি বই বের হচ্ছে, সেগুলোর বেশিরভাগই ‘নতুন’ কিছু না। পূর্বে অন্যান্য ভাষায় সেগুলো প্রকাশিত বা বাংলা ভাষায়ও ইতঃপূর্বে প্রকাশিত বই থাকলে সেগুলো মানসম্মত না, রেফারেন্স নেই ইত্যাদি। এই হলো বেশিরভাগ নতুন বইয়ের বৈশিষ্ট্য।
‘Rich Dad, Poor Dad’ বইটি পড়তে গিয়ে একটি ঘটনা পড়লাম। রবার্ট টি. কিয়োসাকির উল্লিখিত ঘটনাটি একটু আমাদের প্রেক্ষাপটে পরিমার্জন করে বলি।
একবার রবার্ট টি. কিয়োসাকিকে একজন বললো, “আমি আপনার মতো বেস্ট সেলার লেখক হতে চাই। এই দেখুন, আমি আপনাকে নিয়ে অনেক আর্টিকেল লিখেছি।”
‘Rich Dad, Poor Dad’ বইটি প্রায় ৫ কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। সেই বইয়ের লেখককে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে এমন বেস্ট সেলার লেখক হবার কৌশল। যিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি একজন পিএচডি হোল্ডার; একজন বড়ো গবেষক।
রবার্ট টি. কিয়োসাকি জবাব দিলেন, “পাশের একটি স্কুলে মার্কেটিংয়ের ওপর একটি কোর্স চলছে। আমার বন্ধু কোর্সটি নিচ্ছে। আপনি চাইলে এই কোর্সটি করতে পারেন।”
সেই ডক্টরের ইগোতে লাগলো। তিনি একজন গবেষক, পিএচডি হোল্ডার; তাকে বলা হচ্ছে স্কুলে গিয়ে একটি কোর্স করতে। তিনি রাগ করে চলে গেলেন।
কফি খেতে গিয়ে রবার্ট টি. কিয়োসাকি সেই ডক্টরের আর্টিকেল নিয়ে বসলেন। তাকে দেখালেন- “আপনি আমার নামের আগে কী লিখেছেন দেখুন?”
ডক্টর বললেন, “এই তো, বেস্টসেলার লেখক রবার্ট টি. কিয়োসাকি…।”
রবার্ট টি. কিয়োসাকি বললেন, “দেখুন, আপনি আমাকে ‘বেস্টসেলার’ বলেছেন, ‘বেস্টরাইটার’ বলেননি। আমার বইগুলোর কাভারে লেখা থাকে- Best Seller Author।”
রবার্ট টি. কিয়োসাকি যা বুঝাচ্ছেন, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, একটি বিষয়ে আপনার জ্ঞান, আপনার লেখার কৌশল, আপনার সৃজনশীলতার কারণে আপনার লেখা বইটি ঐ বিষয়ের ‘সেরা বই’ হতে পারে।
আপনি হাদীস শাস্ত্র নিয়ে গবেষণা করেন। বাংলাদেশে আপনার মতো বিজ্ঞ গবেষক নেই। হাদীসের ওপর আপনার লেখা বইটি হতে পারে এই বিষয়ে সবচেয়ে ভালো বই। তারমানে এই না যে, এই বইটি লাখ-লাখ কপি বিক্রি হবে; বেস্টসেলার বই হবে।
আমার ধারণা, আমাদের অনেক লেখক-অনুবাদক মার্কেটিং নিয়ে পড়াশোনা করেন না বা এই বিষয়ে পড়াশোনা করতে হবে সেটা ঐ পিএচডি হোল্ডারের মতো অনুভব করেন না। তিনি মনে করে, তার লেখা বইটি সেরা বই, অতএব এই বইটি বেস্টসেলার হবে; বেস্টসেলার না হলে প্রকাশনীর দোষ।
দেখুন, একটি প্রকাশনী মাসে একাধিক বই প্রকাশ করে। সবগুলো বইয়ের মার্কেটিং-প্রমোশনে পেছনে তাদের বাজেট থাকে। সেই অনুযায়ী তারা প্রচার-প্রচারণা চালায়। মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ বা প্রকাশক বুঝতে পারেন কোন বইটি ভালো চলবে। সেই অনুযায়ী তিনি ঐ বইয়ের পেছনে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করেন; মার্কেটিং সেক্টরে।
চার-পাঁচটি বইয়ের মধ্যে কোনো বই আশানুরূপ না হলে, ফ্লপ করলে প্রকাশক খুব বেশি দুশ্চিন্তা করেন না। প্রত্যেক প্রকাশনীর বইয়ের এভারেজ বিক্রি আছে। কারো ক্ষেত্রে ২ হাজার, কারো ক্ষেত্রে ৫ হাজার। এক/দুই মাস কোনো বই ‘হিট’ না হলে তিনি চিন্তা করবেন পরের মাসের কোনো বই হয়তো অনেক বিক্রি হবে। ‘হট কেক’ তার কাছে প্রস্তুত থাকে।
কিন্তু, একজন লেখক একটা বই লিখতে ৬ মাস থেকে ২ বছর বা তারও বেশি পরিশ্রম করেন। তিনি যদি সেই বইটি ‘বেস্টসেলার’ বইয়ের চিন্তা মাথায় নিয়ে করেন, তাহলে তার এপ্রোচ একেবারে ভিন্ন হবে। তার এই বইটি ফ্লপ করলে আরেক বইয়ের জন্য আরো ৬ মাস থেকে ২ বছর অপেক্ষা করতে হবে।
একজন প্রকাশকের এই দুশ্চিন্তা নেই। তার হাতে এমনিতেই ৫০-৬০ টি পাণ্ডুলিপি থাকে। এরমধ্যে কয়েকটা বই এভারেজের চেয়ে একটু বেশি বিক্রি হলেই তিনি সন্তুষ্ট।
লেখকরা যে মনে করেন একেকটি প্রকাশনীতে গেলে সেই প্রকাশনী তাদেরকে ‘বেস্টসেলার লেখক’ বানাবে, এটা ভুল চিন্তা। গার্ডিয়ান থেকে ‘প্যারাডক্সিকাল সাজিদ’ আসার পর আমার পরিচিত অনেক লেখক স্বপ্ন দেখতেন- ‘আমার বইটা যদি গার্ডিয়ান থেকে আসতো’।
আসলে কী হতো?
তাদের ধারণা, তাদের বইটিও বেস্টসেলার হতো!
প্রত্যেক প্রকাশনীর কিছু লয়াল কাস্টমার থাকে। হাজার, পনেরশো কাস্টমার। ঐ প্রকাশনী থেকে যাই বের হবে, কাস্টমার কিনবে। তাই বলে, ঐ প্রকাশনী থেকে বই বের হলেই সেটা বেস্টসেলার হবে না।
রবার্ট টি. কিয়োসাকি তার প্রথম বইয়ের কথা বলেন। বইটির নাম দিয়েছিলেন ‘If You Want To Be Rich And Happy, Don’t Go To School’। অর্থাৎ, ‘যদি তুমি ধনী এবং সুখী হতে চাও, তাহলে স্কুলে যেও না’।
কিন্তু, প্রকাশক বললেন, বইটির নাম এভাবে না দিয়ে এমন নাম দিন- ‘The Economics of Education’। ‘শিক্ষার অর্থমূল্য’ বা এরকম কিছু।
রবার্ট টি. কিয়োসাকি তার প্রকাশককে বললেন, “আপনি যেই নামে বই প্রকাশ করতে বললেন, এই নামে বই প্রকাশ করলে বইটি কিনবে মাত্র দুজন। আমার বউ আর আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।”
বেস্টসেলার লেখক রবার্ট টি. কিয়োসাকি মার্কেটিং কতো ভালো বুঝেন, সেটা তার বই পড়লে, ইন্টার্ভিউ দেখলেই বুঝতে পারবেন।
সমস্যা হলো, আমরা মনে করি আমাদের বই বেস্টসেলার হোক; কিন্তু আমরা ইনভলভ হতে চাই না। পাণ্ডুলিপি জমা দেয়া, বই বের হলে কয়েকটা পোস্ট দেয়া এই পর্যন্ত কাজ সেরে মনে করি বইটি হাজার হাজার কপি বিক্রি হবে!
পৃথিবীর যতো বেস্টসেলার রাইটার আছেন, তাদের জীবনী-আত্মজীবনী, ইন্টার্ভিউ আমি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখি। আমি দেখি, তারা নিজেদের বই নিয়ে কেমন ইনভলভ ছিলেন।
হুমায়ূন আহমেদের কথাই বলি। সবাই জানেন, তিনি বাংলাদেশের বেস্টসেলার লেখক। হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের একজন প্রকাশকের সাথে কথা হলো। তার কাছ থেকে জানলাম হুমায়ূন আহমেদ নিজের বইয়ের প্রমোশনের জন্য কী করতেন। হুমায়ূন আহমেদ একদিনেই বেস্টসেলার হননি বা তিনি প্রকাশনীতে স্রেফ পাণ্ডুলিপি জমা দিয়েই পরবর্তী বই লেখা শুরু করে দিতেন না।
আমার পরিচিত একজন সম্মানিত লেখক প্রকাশনীতে বই জমা দেবার সময় বলেন, “ভাই, বইটার টপিক ভালো। এই টপিকে বই নাই। আপনারা চাইলে প্রকাশ করতে পারেন। তবে, বইটা তেমন বিক্রি হবে না।”
এরকম অনেক বই আমরা প্রকাশ করি কন্টেন্ট বিবেচনায়। বাংলায় এমন বই থাকা দরকার এটা ভেবে। একইসাথে লেখকের মার্কেট ধারণা দেখেও ভালো লাগে। তিনি ভালো বই লিখছেন, অনেক রেফারেন্স দিয়েছেন, বাংলাতে এমন বই নাই, তারপরও বলছেন তার ধারণা এটা তেমন বিক্রি হবে না।
সাধারণ শিরোনাম দিয়েও একটা বই ভালো বিক্রি হতে পারে। অন্যদিকে সস্তা শিরোনাম দিলেই ভালো বিক্রি হবে এমন না। বই নিয়ে আলোচনা, হাসাহাসি হতে পারে; বেশি বিক্রি না। হুজুরের বউ, হুজুরের গার্লফ্রেন্ড এরকম শিরোনামের বইগুলো হাজার হাজার কপি বিক্রি হলেও আমি যেমন এমন টপিকে লিখবো না, এমন টপিকের বই পড়বোও না।
নিজের লেখক ব্র্যান্ড অক্ষুণ্ণ রেখে ‘বেস্টসেলার’ বই লেখা যায়। বেস্টসেলার বইগুলো স্রেফ নামের কারণে বেস্টসেলার হয় না। সস্তা নামের বইগুলো হয়তো নামের কারণে কিছু বিক্রি হতে পারে, কিন্তু ঐ বইয়ের লেখকের নামটা কেউ মনে রাখে না।
প্রকাশনীতে বই জমা দিলে প্রকাশনী তার নিজের মতো মার্কেটিং করে বই বিক্রি করবে, বছর শেষে/মুদ্রণ শেষে রয়্যালটি দিবে। এটার জন্য লেখকের খুব বেশি ইনভলভ হওয়া লাগে না। লেখক দুই-তিনটা পোস্ট দিলেও হয়, না দিলেও হয়।
কিন্তু, লেখক যদি ‘বেস্টসেলার’ হতে চায়, তার শখ বা স্বপ্ন যাই বলেন না কেনো, তখন তার ইনভলভমেন্ট দরকার। মার্কেটিংয়ের জ্ঞান থাকা আবশ্যক; যা প্রত্যেক বেস্টসেলার লেখকেরই আছে।