বাসর রাতের গল্পকথা

এক
‘অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ নিয়ে আমার কোনো আপত্তি ছিলোনা। আমার আপত্তিটা অন্য জায়গায়। আমি চেয়েছিলাম কোনো আধুনিকমনা, মডার্ণ মেয়েকে বিয়ে করতে। আমি স্বপ্ন দেখতাম হলিউড, বলিউডের নায়িকাদের মতো স্টাইলিশ কোনো মেয়ে আমার ঘরে বউ সেঝে আসবে। আমি তাকে নিয়ে যখন পাশাপাশি হেটে যাবো তখন অন্যরা দেখে হিংসে করবে। কিন্তু মনে হচ্ছে সেই স্বপ্ন আর পূরণ হবেনা। যতটুকু জেনেছি মেয়েটা খুব ধার্মিক। এমনকি নিজের চাচাতো ভাইদের সামনেও পর্দা করে।
ভাবা যায়?

দেখার দিন আমিতো রাগে মুখটা পর্যন্ত দেখিনি। তবে তার নামটা ভালোমতো মুখস্ত আছে। নাম আফরোজা। বাকিসব অপছন্দ হলেও নামটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
মা-বাবা শেষ পর্যন্ত এখানেই বিয়ে ফাইনাল করেছেন। সামনের মাসের ৩ তারিখে বিয়ে। ভয়ে বাবাকে না বলতে পারিনি। তাই বিষয়টা নিয়তির উপর ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু আমি ঐ সময় রাগের মাথায় তার মুখ না দেখে যে ভুল করেছি তার জন্য এখন আফসোস হচ্ছে। কারণ যার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে তার মুখটা যদি অন্তত দেখতে পেতাম তাহলে কিছুটা হলেও নিজেকে সান্তনা দিতে পারতাম।

কি আর করা, ভাগ্যের লিখন। এদিকে প্রকাশক মশাই বারবার ফোন দিয়ে জানতে চাচ্ছেন প্রুফ রিডিং শেষ হয়েছে কিনা। অথচ আমি এখনো পাণ্ডুলিপিটা খুলেও দেখিনি। এতোসব চিন্তা করতে করতে আমার মাথাটা একদম গুলিয়ে যাচ্ছে…….’
‘আহনাফ? বাবা এদিকে একটু আয়তো।’

মায়ের ডাক শুনে ডায়েরী বন্ধ করে উঠে দাড়ালাম। অনেক্ষণ ধরে বসে থাকতে থাকতে শরীরে ঝিম ধরে গেছে। শরীরটা একটু এদিক ওদিক মোচড় দিয়ে ঠিক করে নিয়ে মায়ের রুমের দিকে চললাম। সকাল থেকে দেখছি মা কিসব লিস্ট তৈরি করছেন। একমাত্র ছেলে বিধায় নিজের বিয়ের সব দায়িত্ব আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে। বাবা একা একা সামলিয়ে নিতে পারছেননা। কী এক ঝামেলার মাঝে পড়লাম! বাজার সদাই করবো নাকি আপকামিং বউ নিয়ে চিন্তা করবো কিছুই বুজতে পারছিনা। সম্ভবত একেই বলে ‘জীবনটা বেদনা’।

মায়ের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মা, আমাকে ডেকেছিলেন?’
‘হ্যা, এদিকে আয়। এই লিস্টে যে যে জিনিষগুলো লেখা আছে সবগুলো আজ কিনে আনতে হবে।’
আমি লিস্ট হাতে নিয়ে চোখ কপালে তুলে বললাম, ‘এত্তগুলো! এতসব কিসের জন্য?’
‘বিয়ের সময় এগুলো লাগে। আমিতো অনেক কমিয়ে লিখেছি।’
‘বিয়ে? কার বিয়ে?’
‘হাবারাম কোথাকার! তোর বাপের বিয়ে।’
‘আব্বা আবার বিয়ে করছে নাকি?’

‘এই তুই কিসব আবুল তাবুল বকছিস? তোর যে বিয়ে সেটা ভুলে গেছিস?’
‘ওহ! তাইতো। আচ্ছা লিস্ট দাও আমি নিয়ে আসছি।’
জানিনা এই রোগের নাম কি। মাঝে মাঝে এমন আচরণ করি যেন আমি কিছু বুঝিই না। এজন্য পরিচিতমহলের অনেকেই আমাকে আঞ্চলিক ভাষারীতি মেনে ‘বেদিশা’ বলে ডাকে। বেদিশা মানে হলো যার দিশা নেই। কখনো কখনো মনে হয় এই উপাদিটা আমার সাথে যায়না। আবার কখনো মনে হয় একদম পারফেক্ট। এই যেমন আজ মনে হচ্ছে। আমার বিয়ে অথচ আমিই ভুলে গেছি।

দুই
দরজার কপাট ভেড়ানো ছিলো। আস্তে করে ঠেলে দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলাম। এই সময় মুখ ফচকে বেরিয়ে গেলো ‘বিসমিল্লাহ’। শেষ কবে ঘরে ডুকতে বিসমিল্লাহ বলেছি ঠিক মনে করতে পারলামনা। আদৌ কখনো পড়েছি কিনা কে জানে। আসলে আমি এসব ধর্ম কর্মের খুব একটা ধার ধারিনা। প্রতি শুক্রবারে বাধ্য হয়ে মসজিদে যাই এজন্য বোধ হয় আমাকে একেবারে অধার্মিকের কাতারেও ফেলা যায়না। মাঝে মাঝে ভাবতাম কিছুটা ধর্ম-কর্ম করা দরকার।

বিশেষ করে ওয়াজের সিজনে হুজুরদের দুই একটা কথা শুনে একটু ভাবতাম। কিন্তু সেটা ঐ ভাবনা পর্যন্তই। আজ পর্যন্ত বাস্তবে রুপ নেয়নি। আমার মতো অকর্মার কপালে এমন ধার্মিক মেয়ে কেমন করে ঝুটলো বুঝতে পারিনি। এটা আমার সৌভাগ্য নাকি ঐ মেয়ের দুর্ভাগ্য কে জানে।
ঘরে ডুকেই খাটের উপর ঘোমটা মাথায় দিয়ে বসে থাকা আফরোজার দিকে তাকালাম। নীচের দিকে চেয়ে থাকায় তার মুখটা দেখা যাচ্ছেনা। মুখ দেখার জন্য এতো উৎসুক কারণ আমি এখনো তার মুখখানা দেখতে পাইনি। গাড়িতে সারাটা পথ অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার কেমন যেন লজ্জা লাগছিলো। আমারও যে লজ্জা আছে সেটা আজই প্রথম টের পেলাম।

যাহোক, ধীরে ধীরে খাটের কাছে গিয়ে অন্যদিকে ফিরে বসলাম। বুকের বা পাশের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম হার্ট বিট দ্রুত উঠানামা করছে। না দেখেই বিয়ে করা অপরিচিতার মুখ খানা দেখতে যাচ্ছি বলেই হয়তো। সাহস করে খাটের উপর এক পা তুলে আয়েসি ভঙ্গিতে বসে আফরোজার দিকে তাকালাম। ও মুখ না তুলেই সালাম দিলো।
‘আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম।’
আবার নীরবতা। দুজনের কারো মুখ দিয়েই কোনো কথা বেরুচ্ছেনা। আফরোজা হাতের আঙ্গুল নিয়ে খেলা করছিলো। এদিকে আমার আর তর সইছেনা তার মুখ দেখবো বলে। মিনিটখানেক নীরবতার পর আমি মুখ খুললাম।
‘সারা রাত কি এভাবেই ঘোমটা মাথায় বসে থাকবে?’

আমার কথায় আফরোজা মনে হয় বেশ লজ্জা পেলো। আমার সন্দেহটা প্রমাণিত হলো যখন ওর লাজ রাঙা মুখ খানা দেখতে পেলাম। এমন চাঁদমুখ আমি এর আগে কখনো দেখিনি। একজন মানুষ এতো সুন্দর হতে পারে সেটা আমি আফরোজাকে না দেখলে বিশ্বাসই করতামনা। মানুষ সৌন্দর্যের শেষ সীমা বুঝাতে বলে ‘পরীর মতো লাগছে’। আমি কোনোদিন পরী দেখিনি তবে না দেখেও এটা বলতে পারি যে, আফরোজার রুপের কাছে পরীর রুপও হার মানবে। আফরোজার গায়ের রঙ ফর্সা নয়।
কিন্তু তারপরেও আমার কাছে তা ফর্সার চেয়েও বেশি কিছু মনে হচ্ছে। আজ বুঝলাম সুন্দরের কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। সুন্দরবোধটা আপেক্ষিক। এতো সুন্দর মুখ খানা নাকি সে সবসময় নেকাবের আড়ালে ঢেকে রাখতো! মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন উকি দিলো ‘কেন?’।

পরক্ষণেই উত্তর পেয়ে গেলাম। তার এই রুপ দেখার অধিকার কেবল আমার। এই রুপ সে সংরক্ষণ করতো আমার জন্যেই। এই অতুলনীয় রুপের স্বাদ অন্যকেউ কেন নিবে? আমি এমন এক রুপবতীর সামনে বসে আছি যার রুপ আমি ছাড়া কোনো পর পুরুষ দেখেনি। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে?
মনে মনে মা কে ধন্যবাদ দিলাম। এতোদিন মনের মাঝে যে রাগ পুষে রেখেছিলাম মুহূর্তেই উবে গেলো। নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো ‘আলহামদুলিল্লাহ’। বুঝলামনা আজ কেন যেন নিজেকে ধার্মিক ধার্মিক মনে হচ্ছে। মেয়েটা যাদু জানে নাকি?

আমি আস্তে আস্তে আফরোজার ডান হাতটা আমার হাতে তুলে নিলাম। মনে হলো আফরোজার শরীরটা হালকা ঝাকুনি দিয়ে উঠলো। প্রথম ছোঁয়া বলেই হয়তো। আমি তার তুলতুলে হাতটা আমার হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রেখে বলতে লাগলাম, ‘আজ আমি কোনো মিথ্যা বলবোনা। এই পর্যন্ত আমি অনেক মেয়ের রুপের প্রেমে পড়েছি। না না, ভয়ের কারণ নেই। আমি এতোটা ভীতু ছিলাম যে একটা মেয়েকেও দিলের খবর জানাতে পারিনি। সব মেয়েকেই আমি একটা কথা বলতে চেয়েছিলাম। কতবার চেষ্টা করেছি কিন্তু সাহসে কুলায়নি। হয়তো কথাটা শুধু তোমাকেই বলবো বলেই ওদেরকে বলতে পারিনি।

এখন মনে হচ্ছে যদি কাউকে বলে ফেলতাম তাহলে সেটা হতো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। কিন্তু আজ আর আমি সংকোচ করবোনা। আজ আমাকে বলতেই হবে। ‘আই লাভ ইউ আফরোজা’।’
আফরোজা এতোক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলো। এবার চোখ নামিয়ে লজ্জামাখা কন্ঠে বললো, ‘আনা উহিব্বুকা।’

ঠিকমতো কুর’আনটাও পড়তে পারিনা আর আরবী বুঝবো কীভাবে? জিজ্ঞেস করলাম, ‘এর অর্থ কী? আরবী শব্দ?’
‘জি এটা আরবী শব্দ। এর অর্থ হলো ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি’।’ এটা বলেই আফরোজা তার হাতটা আমার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলো। খুব বেশি লজ্জা পেয়েছে মনে হয়। লজ্জা পেলে মেয়েদেরকে যে এতোই সুন্দর লাগে তা আজ প্রথম টের পেলাম।

তিন
হঠাৎ কিসের শব্দ শুনে ঘুম ভাঙলো। উঠে দেখি রুমের লাইট জ্বালানো। এদিকে দরজাও ভিতর থেকে লাগানো। তবে লাইট কে জ্বালালো?
আমার পুরো মনে আছে আমি লাইট অফ করে ঘুমিয়েছিলাম। বেডের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার পাশে আরেকটি বালিশ রাখা। মনে হচ্ছে একটু আগ পর্যন্ত কেউ শুয়ে ছিলো এখানে। আমি খানিকটা ভয় পেয়ে গেলাম। তবে কি আমি জিনের সাথে সারা রাত ঘুমিয়ে ছিলাম?

পরক্ষণে মনে পড়লো আমার তো বিয়ে হয়েছে গতকাল। নিশ্চই এখানে আফরোজা ঘুমিয়ে ছিলো। কিন্তু লাইট জ্বালিয়ে রেখে ও গেলো কোথায়?
শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি আফরোজা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়া আসছে। তোয়ালে দিয়ে হাত মুখ মুছতে মুছতে বললো, ‘ও আপনি উঠে গেছেন? আমি আরো ভেবেছিলাম ওজু করে এসে আপনাকে ডাক দিবো। ওজু করে আসেন নামাজের সময় বেশি নেই।’

আমি ঘড়িতে টাইম দেখে বুঝলাম এখন ফজরের সময় হয়েছে। আফরোজা জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে গেছে। আমি চেয়ে চেয়ে তার নামাজ পড়া দেখছি। শেষ কবে ফজরের নামাজ পড়েছিলাম সেটা অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলামনা। মা রোজ এসে ডেকে যায়। কিন্তু আমি উঠছি বলেই আবার ঘুমিয়ে পড়ি। আজ কেন যেন মনে হলো আফরোজার পাশে দাঁড়িয়ে নামাজটা পড়তে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু আলসেমির কারণে বিছানা থেকে উঠতে মন সায় দিচ্ছেনা। দু’রাকাত সুন্নত শেষ করে আফরোজা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কি হলো? নামাজ পড়বেননা?
সময় কিন্তু বেশি বাকি নেই। তাড়াতাড়ি ওজু করে আসেন।’

জানিনা আজ আমার কি হয়েছে। সম্ভবত মেয়েটা আমাকে জাদু করেছে। আমি কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো উঠে গিয়ে ওজু করে আসলাম। তারপর কোনোরকমে ভুলভাল নামাজটা পড়ে আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু আফরোজা এখনো জায়নামাজে বসে আছে। বসে বসে কুর’আন তিলাওয়াত করছে। খুব জুরেও না আবার আস্তেও না। আমি মোটামুটি শুনতে পাচ্ছি। মুগ্ধ করা কন্ঠ তার। ও যতক্ষণ তিলাওয়াত করছিলো আমি ততক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
হঠাৎ ও তিলাওয়াত বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। আমি বললাম, ‘বন্ধ করলে কেন?

ভালোইতো লাগছিলো।’ আফরোজা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। আমি যে এতক্ষণ তার তিলাওয়াত শুনছিলাম সেটা ও খেয়াল করেনি। লজ্জা মাখা কন্ঠে বললো, ‘আপনি এখনো ঘুমাননি?’
‘এতো মায়াবী কন্ঠের তিলাওয়াত না শুনে কি ঘুমানো যায়? কিন্তু তুমি তিলাওয়াত বন্ধ করে দিলে কেন?’
‘সকাল হয়ে গেছে। সবাই উঠে পড়তে পারে তাই।’
‘কেন, সবাই উঠে গেলে কী হবে?’

‘সবাই শুনলে আমার মাঝে রিয়া এসে যেতে পারে।’
‘রিয়া মানে কী?’
‘রিয়া মানে হলো লোকদেখানো আমল।’
‘ওওও’

আফরোজা লাইট অফ করে আমার পাশে এসে শুয়ে পড়লো। ও ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চিত হয়ে আমি চুপি চুপি উঠে গিয়ে চার্জার লাইট জ্বালিয়ে ডায়েরি লিখতে বসলাম। লেখার শিরোনাম কী দিবো ভেবে না পেয়ে লিখলাম ‘বাসর রাতের গল্পকথা’।

লিখেছেন

নাবিল হাসান

সিলেটে থাকি, পড়ালেখা সিলেটেই। পড়ছি কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে। আর ভালোবাসি লিখালিখি করতে।
Writer and selector at জাগরণ - Jagoron
সসীমের পথ ছেড়ে ছুটি অসীমের পানে

All Posts

সিলেটে থাকি, পড়ালেখা সিলেটেই। পড়ছি কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে। আর ভালোবাসি লিখালিখি করতে।
Writer and selector at জাগরণ – Jagoron
সসীমের পথ ছেড়ে ছুটি অসীমের পানে

Exit mobile version