‘উপমহাদেশের মানুষদেরকে পোশাক পরা শিখিয়েছে মুসলমানরা’ –কথাটি বললে খুব একটা ভুল হবে না। মুসলিম-পূর্ব উপমহাদেশের মানুষদের পোশাক ছিলো প্রায় অর্ধ-উলঙ্গ।
নীহাররঞ্জন রায় এবং রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে বাঙ্গালি নারী ও পুরুষ একটি কাপড় পরতো। শাড়ি অথবা ধুতি। শাড়ি এবং ধুতির মধ্যে পার্থক্য ছিলো এই যে, শাড়ি দৈর্ঘ্যে এবং ঝুলে বড়ো হতো। সমাজের উপর তলার মানুষরা হাঁটুর নিচে নামে এমন ঝুলের ধুতি পরতো। সাধারণ মানুষ ধূতি পরতো অত্যন্ত খাটো মাপের, ধুতি হাঁটুর উপরই থাকতো।
[হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, গোলাম মুরশিদ, পৃষ্ঠা ৪৬১]
এখন যদি আপনি মুসলিম-পূর্ব বাংলার পোশাককে বাঙ্গালি পোশাকের ‘স্ট্যান্ডার্ড’ মনে করেন, তাহলে টকশোতে সুটেড-বুটেড হয়ে কেনো আসেন? সুট-টাই পরা তো হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি না।
প্রাচীন যুগের বিত্তবানরা যেখানে মাত্র একটি পোশাক পরতো, মুসলমানদের আগমনের সাথে সাথে মানুষের পোশাক পরার রুচি পরিবর্তন হয়ে যায়। একটি পোশাকের জায়গায় চলে আসে তিনটি পোশাক- উর্ধাঙ্গ, নিম্নাঙ্গ এবং মাথায়।
[হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, গোলাম মুরশিদ, পৃষ্ঠা ৪৬৪]
মুকুন্দরামের লেখা থেকে জানা যায়, মধ্যযুগে স্বচ্ছল মুসলিমরা পাজামা পরতেন। মুসলিমদের দেখাদেখি হিন্দু মুনিরা পাজামা পরা শুরু করছেন দেখে শূন্যপুরাণে হিন্দুদেরকে ‘পাজামা পরে মুসলিম হয়ে গেছে’ বলে ঠাট্টা করা হয়েছে।
মুসলমানদের আগমনের পূর্বে এই অঞ্চলের মানুষজন সেলাই করা পোশাক পরতো না। সেলাই করা পোশাক পরার রীতি মুসলমানরাই চালু করে। মুসলমানদের কল্যাণেই ‘দর্জী’ নামক একটি পেশার সাথে এই অঞ্চলের মানুষের পরিচয় ঘটে। তখনকার সময়ে হিন্দুরা সেলাই করা পোশাক পরতো না; বিয়ে বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সেলাই করা পোশাক পরার কথা তো কল্পনাই করা যায় না।
[হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, গোলাম মুরশিদ, পৃষ্ঠা ৪৬৭]
টকশোতে সেলাই করা শার্ট-প্যান্ট পরে এসে বাঙ্গালি পোশাকের যে সবক দিয়ে হা-হুতাশ করছেন, সেটা কোন আমলের পোশাক নির্দিষ্ট করে বলবেন। সেলাইবিহীন পোশাকের আমল নাকি সেলাইওয়ালা পোশাকের আমল?
পায়ে জুতো পরাটাকে এই অঞ্চলে জনপ্রিয় করে মুসলিমরা [হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, গোলাম মুরশিদ, পৃষ্ঠা ৪৬৭]। আর মুসলিম শাসনামলে মুসলমানদের দেখাদেখি এই অঞ্চলের মানুষ মোজা পরা শুরু করে [হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, গোলাম মুরশিদ, পৃষ্ঠা ৪৬৪]। বঙ্কিমচন্দ্র মুসলমানদের ভালোবাসতেন না, কিন্তু ১৮৮২ সালের তার যে ছবিটি পাওয়া যায় সেটাতে দেখা যায় মাথায় পাগড়ি, গায়ে গলাবন্ধ চাপকান পরিহিত (মুসলমানি পোশাক)। রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথের দাদা), দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এমনকি খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোশাকের মধ্যে মুসলমানি পোশাকের ছাপ পাওয়া যায়; প্রাচীনকালের পোশাক না।
হিন্দু অভিজাতদের ‘ভদ্র পোশাক’ –এ মুসলিম শাসনামলের পোশাকের ছাপ ছিলো স্পষ্ট। ইংরেজ শাসনামলে আস্তে আস্তে পোশাকের পরিবর্তন হতে থাকে। পোশাকের মধ্যে বিচিত্রতা আসে। ইংরেজদের মতো পোশাক পরায় যুবকদেরকে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ই সমালোচনা করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কোট বা চাপকান’ প্রবন্ধে ইংরেজ পোশাক নিয়ে কুসুম-কোমল সমালোচনা করেন।
আজ ‘বাঙ্গালির পোশাক’ বলতে যে পোশাকের দিকে ফিরে যাবার আহ্বান জানানো হচ্ছে, সেটা কোন যুগের পোশাক? পাল আমল, সেন আমল, মুসলিম আমল, ইংরেজ আমলের পোশাক?
সত্যি কথা বলতে, এই অঞ্চলের মানুষের নির্দিষ্ট, স্বতন্ত্র কোনো পোশাক আদৌ ছিলো? ‘বাইরের’ মানুষরা এসে এদেশের মানুষকে পোশাক পরিয়েছে। কখনো সেটা তুর্কি, আফগান, পারসিক, আরবীয়, কখনোবা ইংরেজ। এদেশের মানুষের পোশাক হলো বিদেশী পোশাকের আত্মীকৃত।
আপনার পরনে ইংরেজ পোশাক, আপনি ঠিক কোন বাঙ্গালি পোশাকের তালিম দিতে আসছেন শুনি?
পুনশ্চ:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোশাকের বিবর্তন নিয়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় শোভন শোম লিখেন:
“উনিশ শতকে ভদ্র বাঙ্গালীর ব্যবহারিক পোষাক ছিল না। তারা নবাবী আমলের ভদ্র পোষাক চোগা চাপকান-পাগড়ী পরতেন।…ছবিতে দ্বারকানাথ, দেবেন্দ্রনাথ এমনকি রবীন্দ্রনাথকেও পাগড়ী, টুপি চোগা চাপকান ইত্যাদি যেসব পোষাকে দেখা যায় সেই পোষাক মুসলিম জামানার উত্তরাধিকার।…
রবীন্দ্রনাথ, অবীন্দ্রনাথদের তিন ভাই-এর সঙ্গে (এক পার্টিতে) চললেন ধুতি পাঞ্জাবি ও চটি পরে। পার্টিতে তাঁদের সাজ পোষাক দেখে হতভম্ভ। কেউ তাদের সঙ্গে কথা বললেন না। পার্টি যারা দিয়েছিলেন আর পার্টিতে যারা গিয়েছিলেন তারা বলেছিলেন, এ কি রকম ব্যবহার, এ কি রকম অসভ্যতা। লেডিজদের সামনে খালি পায়ে আসা। মোজাবিহীন খালি পায়ে পার্টিতে গিয়ে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বলে কথিত রবীন্দ্রনাথকে একদিন ‘অসভ্য’ গালি খেতে হয়েছিল।
সেই থেকে রবীন্দ্রনাথ ধুতি পাঞ্জাবী প্রায় বাদ দিয়ে দার্জিলিংয়ে দেখা তিব্বতীদের বকুর সঙ্গে মুসলমানী আলখেল্লা মিলিয়ে মাথায় ঈষৎ হেলানো তুর্কী টুপির বদলে এক ধরণের লম্বা টুপি ও মোজাসহ নাগড়াই ব্যবহার করতেন। কারণ তখন সেলাইবিহীন কাপড় সভ্য সমাজ থেকে দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হচ্ছিল…মজলিসে যেতে হতো কাটা কাপড় পরে। ধুতি চাদর চলতো না। আবার হিন্দু বিয়ে, শ্রাদ্ধ, পূজা ইত্যাদিতে ধুতি চাদর পট্টবস্ত্র পরতে হতো, কাটা কাপড় চলতো না।”
[জোড়া সাঁকোর ঠাকুর বাড়ির সংস্কৃতি, শোভন সোম। দেশ, কলকাতা, ডিসেম্বর ১৯৯৮]