আসমাউল হুসনা – যুল-জালালি ওয়াল-ইকরাম

আল্লাহ পবিত্র কুরআনে নিজেকে ‘যুল-জালালি ওয়াল-ইকরাম’—গৌরব ও সম্মানের অধিকারী, মহিমা ও উদারতার মালিক — বলেছেন দুইবার। তিনিই এই সবগুলো গুণের অধিকারী – গৌরব, মহিমা, শ্রেষ্ঠত্ব, উদারতা এবং সম্মানের। যুল-জালালি ওয়াল-ইকরাম মহান ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের উৎস!

জালাল এসেছে ج-ل-م এর মূল থেকে এসেছে, যা তিনটি প্রধান অর্থ নির্দেশ করে। প্রথম অর্থ হল মহিমান্বিত; দ্বিতীয় অর্থ হল সর্বোচ্চ এবং স্বতন্ত্র হওয়া; এবং তৃতীয় অত্যন্ত মহান।

এই মূলটি কুরআনে একটি রূপে দুবার এসেছে; জালাল – বিশেষ্য হিসাবে। একটি উদাহরণ হল ٱلۡجَلَٰلِ -আল-জালালি (মহিমা)।

করিম (ْكَرِيم), আকরাম (ْاَكْرَم) এবং ইকরাম (ْاِكْرَم) ك-ر-م এর মূল থেকে এসেছে, যা প্রধানত চারটি প্রধান অর্থ নির্দেশ করে। প্রথম অর্থটি হল উদার, দানশীল এবং উপকারী হওয়া, একই মূলের দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে অত্যন্ত সম্মানিত হওয়া, তৃতীয় অর্থ মূল্যবান এবং বিরল হওয়া; চতুর্থ অর্থ হলো প্রচুর এবং ফলাদায়ক হওয়া। এই মূলটি কুরআনে ৪৭ এসেছে আটটি উদ্ভূত রূপে। এই রূপগুলির উদাহরণ হল: আল-আকরাম (اَلْاَكْرَم) -সর্বাধিক উদার, কারীমুন (ٌكَرِيم) – মহৎ, আল-মুকরামিন (اَلْمُكَرَمِين) – সম্মানিত।

ভাষাগতভাবে, ذُو একটি নির্দেশক সর্বনাম এবং আরবি ভাষায় এর আক্ষরিক অর্থ হল সাথে, মধ্যে। যুল-জালাল-এ ذُو বলতে আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জাল’কে পূর্ণ মালিক, এবং আল-জালাল দ্বারা মহিমা ও গৌরবের মালিককে বোঝায়; ওয়াল-ইকরাম অর্থ ওয়া (এবং); আল-ইকরাম অর্থ উদারতা এবং অনুগ্রহ। করিম একটি বিশেষণ এবং ইকরাম একটি ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য।

যুল-জালালি ওয়াল-ইকরাম নিজেই বলেছেন –

تَبَٰرَكَ ٱسۡمُ رَبِّكَ ذِى ٱلۡجَلَٰلِ وَٱلۡإِكۡرَامِ
তোমার রবের নাম বরকতময়, যিনি মহামহিম ও মহানুভব।1

আল্লাহর সম্মানিত চেহারা:

সূরা আর-রহমান এ আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জাল’ আমাদেরকে সেই মুহূর্ত সম্পর্কে বলেছেন যখন পৃথিবীর সবকিছু এবং প্রত্যেকেরই ধ্বংস হয়ে যাবে এবং কেবল তাঁর সম্মানিত চেহারা থাকবে, কারণ তিনি চিরঞ্জীব এবং কখনও মৃত্যুবরণ করবেন না। আল্লাহ আজ্জা ওয়াজাল এখানে তাঁর চেহারাকে যুল-জালালি ওয়াল-ইকরাম বলে বর্ণনা করেছেন।

আশ-শা’বি বলেন,
যখন আপনি তেলাওয়াত করবেন, كُلُّ مَنۡ عَلَيۡهَا فَانٍ – যমীনের উপর যা কিছু রয়েছে, সবই ধ্বংসশীল2; থামবেন না, পড়তে থাকুন, وَيَبۡقَىٰ وَجۡهُ رَبِّكَ ذُو ٱلۡجَلَٰلِ وَٱلۡإِكۡرَامِ – আর থেকে যাবে শুধু মহামহিম ও মহানুভব তোমার রবের চেহারা3। ইবনে আব্বাস যুল-জালালি ওয়াল-ইকরামের অর্থ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “মহানুভবতা এবং গৌরবের মালিক।” এই উভয় বক্তব্যই তাফসীরে ইবনে কাসিরে পাওয়া যায়।

আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?

যুল-জালালি ওয়াল-ইকরামের চেহারা অন্বেষণ করুন। আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জাল তাঁর মহৎ চেহারাকে যুল-জালালি ওয়াল-ইকরাম বলে বর্ণনা করেছেন; শুধুমাত্র তিনিই শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের যোগ্য। আপনি যা কিছুই করেন, তাতে তাঁর চেহারার সন্ধানই যেন হয় আপনার মূল উদ্দেশ্য।

وَٱصۡبِرۡ نَفۡسَكَ مَعَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ رَبَّهُم بِٱلۡغَدَوٰةِ وَٱلۡعَشِىِّ يُرِيدُونَ وَجۡهَهُۥۖ
তুমি দৃঢ় চিত্ত হয়ে তাদের সাথে অবস্থান কর যারা সকাল-সন্ধ্যা তাদের প্রতিপালককে আহবান করে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের সন্ধানে।4

এর অর্থ হল আপনি যদি কারো জন্য কিছু করে থাকেন, তা যেন কারো প্রশংসা বা স্বীকৃতির জন্য না হয়, আপনার সকল কাজের পেছনে উদ্দেশ্যে যেন হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, যেমন তিনি দানশীলদের সম্পর্কে বলেছেন –

إِنَّمَا نُطۡعِمُكُمۡ لِوَجۡهِ ٱللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنكُمۡ جَزَآءً وَلَا شُكُورًا
তারা বলে,‘আমরা তো আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তোমাদেরকে খাদ্য দান করি। আমরা তোমাদের থেকে কোন প্রতিদান চাই না এবং কোন শোকরও না।5

কারো জন্য কিছু করে থাকলে এবং এর জন্য স্বীকৃতি না পেলে আপনি কেমন অনুভব করেন তা দেখে আপনি নিজেকে পরীক্ষা করতে পারেন: আপনি কি রাগান্বিত এবং বিরক্ত বোধ করেন?
তাহলে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিন আপনি তা করেছেন তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে, তিনিই প্রতিটি কাজ লিপিবদ্ধ করেন, মানুষ আপনাকে স্বীকৃতি দিক বা না দিক।

প্রতি সালাতের পর যুল-জালালি ওয়াল ইকরামকে স্মরণ করুন। এই সুন্নতটি অনুসরণ করে প্রচুর সওয়াব লাভ করুন। আয়েশা (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) যখন সালাত (নামাজ) শেষ করতেন, তিনি বলতেন –

اللَّهُمَّ أَنْتَ السَّلامُ وَمِنْكَ السَّلامُ ، تَبَارَكْتَ يَا ذَا الْجَلالِ وَالإِكْرَامِ
মোটামুটি উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা আনতাস সালা-মু ওয়া মিনকাস সালা-মু, তাবা-রাকতা ইয়া যাল জালা-লি ওয়াল ইকরা-ম।
অর্থ: “হে আল্লাহ, আপনিই সালাম (শান্তি), আপনার থেকেই শান্তি, হে মহাসম্মানের অধিকারী ও মর্যাদা প্রদানের অধিকারী, আপনি বরকতময়।”6

উদার হন। রাসুল (সা.) বলেছেন,
‘ যে দানশীল সে আল্লাহর নিকটবর্তী, জান্নাতের নিকটবর্তী, মানুষের নিকটবর্তী এবং আগুন থেকে দূরবর্তী ….’7

প্রকৃত উৎস চিনুন। যখন আপনি মানুষের কাছ থেকে উপহার পান বা কারো দ্বারা উপকৃত হন, তখন জেনে রাখুন যে এই অনুগ্রহের প্রকৃত উৎস হলেন যুল-জালালি ওয়াল-ইকরাম। সুতরাং আপনি নিশ্চিত করুন যে আপনি সবার আগে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলবেন এবং প্রকৃত দাতাকে সম্মান করবেন যার কাছ থেকে সমস্ত আশীর্বাদ আসে। তারপরে, ওই ব্যক্তিকে বলুন জাযাকাল্লাহু খায়ের (আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন) বা বারাকআল্লাহু ফীক (আল্লাহ আপনাকে বরকত দিন)।

যুল-জালালি ওয়াল-ইকরাম এর কাছে প্রার্থনা করুন। রাসূল (সা.) আল্লাহর সবচেয়ে সুন্দর নামগুলো ব্যবহার করে কার্যকরী পদ্ধতিতে প্রার্থনা করতে আমাদেরকে উৎসাহিত করেছেন। আপনি যখন এই নাম দিয়ে দু’আ শুরু করেন, মনে রাখবেন যে যু যা-তে পরিবর্তিত হয়, উদাহরণস্বরূপ ইয়া যাল-জালালি ওয়াল-ইকরাম। রাসুল (সা.) বলেছেন:
“ইয়া যাল-জালালি ওয়াল-ইকরাম8 বলে অবিরাম প্রার্থনা করতে থাকুন, সুতরাং আপনি যখন দু’আ করবেন, তখন আপনি বলতে পারেন: ইয়া যাল-জালালি। ওয়াল-ইকরাম… [আপনার অনুরোধ]

হে আল্লাহ, যুল-জালালি ওয়াল-ইকরাম, আমরা জানি যে আপনি সমস্ত মহিমা ও অনুগ্রহের মালিক। আমাদের উদ্দেশ্য, কথা এবং কাজে শুধুমাত্র আপনার সম্মানিত চেহারা খুঁজে পেতে অর্থাৎ আপনার সন্তুষ্টি অর্জনে আমাদের সাহায্য করুন। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সবকিছুর উপরে আপনার আনুগত্য করতে এবং অন্যদের প্রতি উদার হতে আমাদের সাহায্য করুন। আখিরাতে আপনার চেহারা দেখার জন্য আমাদের আশীর্বাদ করুন, আল্লাহুম্মা আমিন!

আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।

যুল-জালালি ওয়াল-ইকরাম

আসমাউল হুসনা

লিখেছেন

ফাহমিনা হাসানাত

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

  1. সূরা আর-রহমান-৫৫: আয়াত -৭৮ ↩︎
  2. সূরা আর-রহমান-৫৫: আয়াত -২৬ ↩︎
  3. সূরা আর-রহমান-৫৫: আয়াত -২৭ ↩︎
  4. সূরা আল-কাহাফ-১৮: আয়াত -২৮ ↩︎
  5. সূরা আল-ইনসান-৭৮: আয়াত -৯ ↩︎
  6. সহীহ মুসলিম ↩︎
  7. আত-তিরমিজি ↩︎
  8. আহমাদ, আন-নাসায়ী ↩︎
Exit mobile version