আসমাউল হুসনা – আজ-জ’হির
আল্লাহ নিজেকে আজ-জ’হির—সুস্পষ্ট, প্রকাশ্য—বলেছেন পবিত্র কুরআনে একবার। আজ-জ’হির— সবকিছুর ঊর্ধ্বে, তবুও সমস্ত সৃষ্টিতে প্রকাশিত। তাঁর অস্তিত্ব এবং একত্ব মহাবিশ্বের সমস্ত নিদর্শনের মধ্যে স্পষ্ট, তবুও তাঁকে এই পৃথিবীতে আমাদের ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উপলব্ধি করা সম্ভব না!
জ’হির এসেছে মূল ظ-ه-ر এর মূল থেকে, যা পাঁচটি প্রধান অর্থ নির্দেশ করে। প্রথম অর্থ হল দৃশ্যমান, প্রকাশিত এবং স্বতন্ত্র হওয়া, দ্বিতীয় অর্থ হল উন্মুক্ত হওয়া বা বেরিয়ে আসা। তৃতীয় অর্থ হল আরোহন করা এবং উচ্চ মর্যাদা লাভ করা। চতুর্থ অর্থ বশীভূত করা এবং পরাস্ত করা, এবং পঞ্চম অর্থ অন্যকে সাহায্য করা।
এই মূলটি কুরআনে ৫৯ বার দশটি উদ্ভূত রূপে উপস্থিত হয়েছে। এই রূপগুলির উদাহরণ হল ظَهَرَ – জাহারা (“প্রকাশ্য”), لِيُظْهِرَهُ – লিইয়াজহিরাহু (“যেন তিনি বিজয়ী করেন”) এবং ظَهۡرِهِ – জাহরিহি (“তার উপরিভাগে”)।
আজ-জ’হির সর্বাপেক্ষা প্রকাশ্য কারণ তিনি ব্যতীত অন্য সব কিছুই তাঁর গুণাবলী দ্বারা প্রকাশিত। তিনি তাঁর সৃষ্টির ঊর্ধ্বে, তিনি সবকিছু এবং সকলকে বশীভূত করেন এবং তিনিই প্রকৃত সাহায্যকারী, অন্যরা কেবল তাঁর সাহায্যের মাধ্যমে সাহায্য ও সমর্থন প্রদান করতে পারে।
আজ-জ’হির নিজেই বলেছেন –
هُوَ ٱلۡأَوَّلُ وَٱلۡأٓخِرُ وَٱلظَّٰهِرُ وَٱلۡبَاطِنُۖ وَهُوَ بِكُلِّ شَىۡءٍ عَلِيمٌ
তিনিই প্রথম ও শেষ এবং প্রকাশ্য ও গোপন; আর তিনি সকল বিষয়ে সম্যক অবগত।[৫৭:৩]
একটি চিন্তা-উদ্দীপক আলোচনা:
সূরাতুল ওয়াকিয়াতে রয়েছে কিছু শক্তিশালী প্রশ্ন ও উত্তরের সমষ্টি যেখানে সৃষ্টিকর্তা তাঁর সৃষ্টির সাথে হৃদয় স্পর্শী আলোচনা করেছেন:
نَحۡنُ خَلَقۡنٰکُمۡ فَلَوۡ لَا تُصَدِّقُوۡنَ
আমিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি: তাহলে কেন তোমরা তা বিশ্বাস করছ না?[৫৬:৫৭]
اَفَرَءَیۡتُمۡ مَّا تُمۡنُوۡنَ
তোমরা কি ভেবে দেখেছ তোমাদের বীর্যপাত সম্বন্ধে?[৫৬:৫৮]
ءَاَنۡتُمۡ تَخۡلُقُوۡنَهٗۤ اَمۡ نَحۡنُ الۡخٰلِقُوۡنَ
তা কি তোমরা সৃষ্টি কর, না আমিই তার স্রষ্টা?[৫৬:৫৯]
نَحۡنُ قَدَّرۡنَا بَیۡنَکُمُ الۡمَوۡتَ وَ مَا نَحۡنُ بِمَسۡبُوۡقِیۡنَ
আমি তোমাদের জন্য মৃত্যু নির্ধারিত করেছি এবং আমি অক্ষম নই -[৫৬:৬০]
عَلٰۤی اَنۡ نُّبَدِّلَ اَمۡثَالَکُمۡ وَ نُنۡشِئَکُمۡ فِیۡ مَا لَا تَعۡلَمُوۡنَ
তোমাদের স্থলে তোমাদের সদৃশ আনয়ন করতে এবং তোমাদেরকে এমন এক আকৃতি দান করতে যা তোমরা জাননা।[৫৬:৬১]
وَ لَقَدۡ عَلِمۡتُمُ النَّشۡاَۃَ الۡاُوۡلٰی فَلَوۡ لَا تَذَکَّرُوۡنَ
তোমরা তোমাদের প্রথম সৃষ্টি সম্বন্ধে অবশ্যই জান তাহলে (আল্লাহ যে তোমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম এ কথা) তোমরা অনুধাবন কর না কেন?[৫৬:৬২]
اَفَرَءَیۡتُمۡ مَّا تَحۡرُثُوۡنَ
তোমরা কি ভেবে দেখেছ তোমরা যে বীজ বপন কর সে সম্পর্কে?[৫৬:৬৩]
ءَاَنۡتُمۡ تَزۡرَعُوۡنَهٗۤ اَمۡ نَحۡنُ الزّٰرِعُوۡنَ
তোমরা তা অঙ্কুরিত কর, না আমি অঙ্কুরিত করি?[৫৬:৬৪]
আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?
আপনার বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ উভয় ব্যাপারে যত্নবান হোন। শুধু খাদ্য-পানীয় দ্বারা দেহকে পুষ্ট করলে এবং ইন্দ্রিয়কে তৃপ্ত করলে চলবে না, আল্লাহর স্মরণ দ্বারা আপনার আত্মাকেও পরিতৃপ্ত করুন। যেমন ধরুন এমন অনেকে আছে যারা অধিকাংশ সময় কাটায় বাহ্যিক সৌন্দর্যকে বর্ধিত করতে, কিন্তু তারা কুরআন পড়ার জন্য কোন সময় ব্যয় করে না। জনসমক্ষে কখনই নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বা ক্ষমতার জাহির করবেন না এবং অন্যদের সাথে থাকার সময় কখনই বাড়াবাড়ি করবেন না, বা মিথ্যা বলবেন না। প্রতিদিন এই সুন্দর দু’আটি পড়ুন,
‘হে আল্লাহ! আমার অভ্যন্তরীণকে আমার বাহ্যিক থেকে উত্তম করে দিন, এবং আমার বাহ্যিক অবস্থাকে ভালো করে দিন।’ [আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু]
আজ-জ’হির দ্বারা সান্ত্বনা লাভ করুন, জেনে রাখুন যে অন্য কেউ না জানলেও আপনি যা করেন এবং অন্যরা আপনার প্রতি যে আচরণ করে সে সবই তিনি জানেন। আজ-জ’হির আপনার সাথে সব সময় ন্যায়সঙ্গত আচরণ করবেন। এই হাদিসটি দ্বারা আজ-জ’হিরের প্রতি আপনার ভালবাসা ও ভীতিকে বাড়িয়ে তুলুন:
রাসূল (ﷺ) বলেছেন:
‘আল্লাহ তাআলা সৎকাজ ও পাপকাজের সীমা চিহ্নিত করে দিয়েছেন এবং সেগুলোর বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। অতএব যে ব্যক্তি কোনো সৎ কাজের নিয়ত করে (কিন্তু) এখনো তা সম্পাদন করতে পারেনি; আল্লাহ তা’আলা তার আমলনামায় একটি নেকি লিখে দেওয়ার আদেশ দেন।
আর ভালো কাজের নিয়ত করার পর যদি সেই কাজটি সম্পাদন করা হয়, তাহলে আল্লাহ তার আমলনামায় ১০ নেকি থেকে শুরু করে সাতশ’ এমনকি তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি নেকি লিপিবদ্ধ করে দেন।
আর যদি কোনো ব্যক্তি পাপ (অসৎ) কাজের ইচ্ছা পোষণ করে এবং তা সম্পাদন না করে, তবে আল্লাহ তাআলা তার (ওই ব্যক্তির অন্যায় কাজ না করার) বিনিময়ে তার আমলনামায় একটি পূর্ণ নেকি দান করেন।
আর যদি কোনো মানুষ মন্দ কাজের ইচ্ছা পোষণ করে, সঙ্গে সঙ্গে তার আমলনামায় গুনাহ লেখা হয় না। তবে যখন সে ব্যক্তি মন্দ কাজ করে তখন শুধু মাত্র একটি মন্দ কাজের জন্য একটি গুনাহ লেখা হয়।’[বুখারী, মুসলিম]
আপনার নিয়ত সম্পর্কে সচেতন থাকুন। আজ-জ’হিরের কাছে সবকিছুই স্পষ্ট, আপনি তা প্রকাশ্য করুন বা না করুন। রাসূল (ﷺ) বলেছেন,
‘সব আমল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক ব্যক্তি তা-ই পাবে, যা সে নিয়ত করবে।’ [আল-বুখারী, মুসলিম]। আপনার নিয়ত যাচাই করে দেখুন, আপনি কি সত্যিই আল্লাহর জন্য কাজ করছেন?
আপনি যখন আল্লাহর পথে কাজ করেন তখন নিয়মিত আপনার নিয়তকে নবায়ন করুন। নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিন: কিয়ামতের দিন ছোট কাজগুলো বড় হয়ে যেতে পারে এবং সবচেয়ে বড় কাজগুলো তার পেছনের উদ্দেশ্যের ওপর নির্ভর করে মূল্যহীন হয়ে যেতে পারে!
আপনার চারপাশ অবলোকন করুন এবং আজ-জ’হিরের প্রতি আপনার প্রশংসা বৃদ্ধি করুন। আপনার চারপাশে গাছপালা, পশুপাখি, এমনকি আপনার নিজের প্রতি লক্ষ্য করুন এবং উপলব্ধি করুন যে সবকিছু কেবল তাঁর মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। যখন আপনার ঈমান হ্রাস পায়, আপনার চারপাশের নিদর্শনগুলো যেন আপনার বিশ্বাস ও ভীতিকে পুনরুজ্জীবিত করে সেই প্রকাশকের প্রতি এবং আপনাকে যেন আরও কৃতজ্ঞ এবং নম্র করে তুলে। প্রতিদিন কিছুটা সময় নিয়ে আপনার চারপাশটা অবলোকন করুন, আজ-জ’হিরের কথা ভাবুন এবং তাঁর প্রশংসা করুন।
আজ-জ’হিরের কাছে প্রার্থনা করুন। যদিও তাঁর অস্তিত্ব সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে প্রকাশিত, তবুও আমরা আজ-জ’হিরকে এই পৃথিবীতে দেখতে পাই না। পরকালে যেন তাঁর মুখের দিকে তাকাতে সক্ষম হন সেজন্য প্রার্থনা করুন। রাসূল (ﷺ) এই সুন্দর দু’আটি করেছেন –
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ لَذَّةَ النَّظَرِ إِلَى وَجْهِكَ وَالشَّوْقَ إِلَى لِقَائِكَ
মোটামুটি উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আসসালুকা লজ্জাতান-নাজরি ইলা ওয়াজহিকা ওয়াশ-শাওক্বা ইলা লিক্বা-ইক
অর্থ: হে আল্লাহ, আমি আপনার মুখের দিকে তাকানোর আনন্দ এবং আপনার সাথে সাক্ষাতের আগ্রহের জন্য আপনার কাছে প্রার্থনা করছি।[আন-নাসায়ী]
এই দু’আটি মুখস্ত করুন এবং অন্তরের অন্তস্থল থেকে দু’আটি করুন, কারণ আপনি প্রার্থনা করছেন আপনার পরমানন্দের জন্য।
হে আল্লাহ, আজ-জ’হির আমরা জানি যে আপনিই প্রকাশ্য এবং সুস্পষ্ট। আমাদের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক উভয় দিক থেকেই কল্যাণ দান করুন, আমাদের চারপাশে আপনার নিদর্শনগুলিকে উৎপাদনশীল উপায়ে প্রতিফলিত করার জন্য আমাদের পথনির্দেশনা দিন। আমাদের আন্তরিকতার সাথে আশীর্বাদ করুন এবং আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা পরকালে আপনার চেহারার দিকে তাকাতে সক্ষম হবে, আল্লাহুম্মা আমীন!
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
আজ-জ’হির