আসমাউল হুসনা – আশ-শাহীদ

আশ-শাহীদ (ُالشَّهِيْد)
অর্থ: প্রত্যক্ষদর্শী
আল্লাহ আশ-শাহীদ অর্থাৎ তিনি সর্বব্যাপী এবং সব কিছু পর্যবেক্ষণকারী। এমন কিছু নেই যে ব্যাপারে তিনি অবগত নন, কারণ তিনি সর্বদা উপস্থিত এবং সবকিছু দেখেন। তাঁর জ্ঞান সবকিছুকে বেষ্টন ও উপলব্ধি করে এবং তিনিই বিচারের দিবসের চূড়ান্ত সাক্ষী।

আরবিতে শাহিদ শব্দটি এসেছে ش-ه-د এর মূল থেকে, যার অর্থ – সাক্ষ্য দেওয়া, সাক্ষী হওয়া, প্রত্যক্ষ করা, উপস্থিত থাকা, এবং অবগত হাওয়া।

এই মূলটি কুরআনে বিভিন্ন রূপে উদ্ভূত হয়েছে, যেমন ٱشۡهَدُواْ – তোমরা সাক্ষী থাকো, شَهِيدًا – সাক্ষী, شَهِدۡنَا – আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, شَهَٰدَةً – সাক্ষ্য বা প্রমাণ।

কোন কিছুর সাক্ষী হওয়া ইলম অর্থাৎ জ্ঞানের একটি গুণ। উপস্থিত না থেকে, কোন বিষয়ে অবগতন না হয়ে, সূক্ষ্ম এবং অনন্য দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী না হয়ে কেউ সাক্ষী হতে পারে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা হলেন আশ-শাহীদ, তিনিই প্রকৃত সাক্ষী। তিনি গাইব সম্পর্কে জানেন, যা মানুষের কাছে গোপন এবং অদৃশ্য। আশ-শহীদ হওয়ার গুণের কারণেই এই পৃথিবীতে যা কিছু ঘটেছে তিনি তার সাক্ষী হিসেবে বিচার দিবসে নিজেকে প্রকাশ করবেন। পুনরুত্থানের পর আমাদেরকে আমাদের কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি করা হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা হলেন আল-আলিম (সর্বজ্ঞানী) এবং আল-খাবির (সর্ব সচেতন, সব বিষয়ে অবগত), আশ-শাহীর নামের ব্যাখ্যাও অনুরূপ।

يَعۡتَذِرُونَ إِلَيۡكُمۡ إِذَا رَجَعۡتُمۡ إِلَيۡهِمۡۚ قُل لَّا تَعۡتَذِرُواْ لَن نُّؤۡمِنَ لَكُمۡ قَدۡ نَبَّأَنَا ٱللَّهُ مِنۡ أَخۡبَارِكُمۡۚ وَسَيَرَى ٱللَّهُ عَمَلَكُمۡ وَرَسُولُهُۥ ثُمَّ تُرَدُّونَ إِلَىٰ عَٰلِمِ ٱلۡغَيۡبِ وَٱلشَّهَٰدَةِ فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ
তারা তোমাদের নিকট ওযর পেশ করবে যখন তোমরা তাদের কাছে ফিরে যাবে। বল, ‘তোমরা ওযর পেশ করো না, আমরা তোমাদেরকে কখনো বিশ্বাস করব না। অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের খবর আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। আর আল্লাহ তোমাদের আমল দেখবেন এবং তাঁর রাসূলও। তারপর তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে গায়েব ও প্রকাশ্যের জ্ঞানীর নিকট। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে যা তোমরা আমল করতে সে সম্পর্কে জানিয়ে দেবেন।1

আল্লাহর এই নামটি কুরআনে ১৮বার উল্লেখ করা হয়েছে। কিছু আয়াত নিচে উল্লেখ করা হলো –

يَوۡمَ يَبۡعَثُهُمُ ٱللَّهُ جَمِيعًا فَيُنَبِّئُهُم بِمَا عَمِلُوٓاْۚ أَحۡصَىٰهُ ٱللَّهُ وَنَسُوهُۚ وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَىۡءٍ شَهِيدٌ
যে দিন আল্লাহ তাদের সকলকে পুনরুজ্জীবিত করে উঠাবেন অতঃপর তারা যে আমল করেছিল তা তাদেরকে জানিয়ে দেবেন। আল্লাহ তা হিসাব করে রেখেছেন যদিও তারা তা ভুলে গেছে। আর আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী।2
مَّآ أَصَابَكَ مِنۡ حَسَنَةٍ فَمِنَ ٱللَّهِۖ وَمَآ أَصَابَكَ مِن سَيِّئَةٍ فَمِن نَّفۡسِكَۚ وَأَرۡسَلۡنَٰكَ لِلنَّاسِ رَسُولًاۚ وَكَفَىٰ بِٱللَّهِ شَهِيدًا
তোমার কাছে যে কল্যাণ পৌঁছে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর যে অকল্যাণ তোমার কাছে পৌঁছে তা তোমার নিজের পক্ষ থেকে। আর আমি তোমাকে মানুষের জন্য রাসূলরূপে প্রেরণ করেছি এবং সাক্ষী হিসেবে আল্লাহ যথেষ্ট।3
سَنُرِيهِمۡ ءَايَٰتِنَا فِى ٱلۡأٓفَاقِ وَفِىٓ أَنفُسِهِمۡ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَهُمۡ أَنَّهُ ٱلۡحَقُّۗ أَوَلَمۡ يَكۡفِ بِرَبِّكَ أَنَّهُۥ عَلَىٰ كُلِّ شَىۡءٍ شَهِيدٌ
বিশ্বজগতে ও তাদের নিজদের মধ্যে আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাবলী দেখাব যাতে তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয় যে, এটি (কুরআন) সত্য; তোমার রবের জন্য এটাই যথেষ্ট নয় কি যে, তিনি সকল বিষয়ে সাক্ষী?4

আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?

আশ-শাহীদ নামের অর্থ মনে রাখতে হলে এবং তা উপলব্ধি করতে হলে শাহাদার (বিশ্বাসের সাক্ষ্য) সাথে আপনার হৃদয়ের সংযোগ স্থাপন করুন।

আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।

অর্থাৎ ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে এক আল্লাহ ব্যতীত ইবাদাতের যোগ্য আর কেউ নেই, আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি নিশ্চয়ই মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও তাঁর প্রেরিত রাসুল।’

আশহাদু মানে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আর আল্লাহর নাম আশ-শাহীদের অর্থ হচ্ছে সাক্ষী বা সাক্ষ্যদাতা।

আল্লাহর এই নামটি আপনাকে আপনার কর্ম সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে সহায়তা করে। বিচার দিবসে সবাইকে তাদের কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। আপনার সব কাজের একজন সাক্ষী আছেন এ কথা মাথায় রেখে হিংসা, ক্রোধ, অহংকার, গীবত থেকে মুক্ত হতে হবে, কারণ এই আবেগগুলো বিচার দিবসে আপনার বিরুদ্ধে কাজ করবে। বিনম্র চিত্তে নিজের ভুল স্বীকার করুন, এবং ভুলগুলোর জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান, যেন আপনার ভুলগুলো আশ-শাহিদ হিসাবের খাতা থেকে মুছে ফেলেন।

আশ শাহিদ সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট। কেউ আপনার ভালো কাজের মূল্যায়ন করলো কি করলো না তাতে কিছুই যায় আসে না, কারণ আশ-শাহিদ সবকিছুর সাক্ষী। অন্যের উদাসীনতা যেন আপনার ভালো কাজকে প্রভাবিত এবং প্রতিহত না করে।

জেনে রাখুন আপনি কখনই একা নন। যখনই আপনি বিছানায় ঘুমাতে যান, ঘুম থেকে উঠেন বা বাইরে যান তখন এই উক্তিটি পুনরাবৃত্তি করুন, “আল্লাহ আমার দিকে তাকিয়ে আছেন; আল্লাহ আমাকে দেখছেন; আল্লাহ আমাকে প্রত্যক্ষ করছেন।” নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিন আল্লাহ আপনার প্রতিটি গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছেন। তাঁর উপস্থিতি অনুভব করুন, এবং তাঁর সাথে কথা বলুন, তাঁর কাছে আপনার উদ্দেশ্যকে শুদ্ধ রাখতে এবং আপনার কাজগুলিকে ন্যায়পরায়ণাতর সাথে পরিচালনা করতে প্রার্থনা করুন।

আপনি যখন জানেন কেউ আপনাকে প্রত্যক্ষ করছে, আপনি সর্বদা আপনার সাধ্যমত চেষ্টা করেন ভালো কাজ করতে, তাই না? তাহলে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা কেমন হওয়া উচিত?
তাই পরের বার অতিরিক্ত সাদাকাহ দিন, সময়মতো নামাজ পড়ুন এবং আরও বেশি করে কুরআন পড়ুন এবং আশ-শাহিদকে সন্তুষ্ট করুন!

কথাবাত্রায় সংযত হন। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো বড় পাপ থেকে দূরে থাকি, যেমন ব্যভিচার এবং সুদ, কিন্তু আমরা যেভাবে কথা বলি এবং যে বিষয়ে কথা বলি, তার মাধ্যমে আমরা প্রতিদিন হাজারো পাপ করি। মনে রাখবেন আশ-শাহিদ আপনার প্রতিটি কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছেন, তাই নিজেকে প্রশ্ন করুন: এই কথাটি কি আল্লাহকে খুশি করছে, নাকি তাঁকে রাগান্বিত করছে?

হে আল্লাহ, আশ-শাহিদ, আমরা জানি যে আপনি সবকিছুর সাক্ষী। আমাদেরকে আপনার ইহসান দ্বারা সজ্জিত করুন, এবং আমাদের নিয়তকে পরিশুদ্ধ করুন। আমরা এমনভাবে আপনার ইবাদত করতে চাই যেন আমরা আপনাকে দেখতে পাচ্ছি, নিদেনপক্ষে এই উপলব্ধিটুকু যেন আমাদের মধ্যে থাকে যে আপনি আমাদের দেখতে পাচ্ছেন। আপনি যে আমাদের প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করছেন তা স্মরণে রাখতে, এবং এই উপলব্ধিবোধ থেকে আমাদেরকে ভাল কাজ করতে এবং খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকতে অনুপ্রাণিত করুন।
আল্লাহুম্মা আমীন!

আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।

আশ-শাহিদ

আসমাউল হুসনা

লিখেছেন

ফাহমিনা হাসানাত

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

  1. সূরা আত-তাওবা: আয়াত-৯৪ ↩︎
  2. সূরা আল-মুজাদালাহ-৫৮: আয়াত-৬ ↩︎
  3. সূরা আন-নিসা:আয়াত-৭৯ ↩︎
  4. সূরা ফুসসিলাত/হা মিম সিজদাহ-৪১: আয়াত-৫৩ ↩︎
Exit mobile version