আসমাউল হুসনা – আস-সবুর

আস-সবুর
অর্থ: ধৈর্যশীল, সংযত, সহনশীল
আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালা আস-সবুর – সবচেয়ে ধৈর্যশীল এবং সহনশীল। তিনি তাঁর কর্ম সম্পাদনে তাড়াহুড়ো করেন না, বরং উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করেন। যারা অন্যায় করে তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার সমস্ত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি তাদের অনুতাপ করার জন্য এবং পথ পরিবর্তন করে সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য সময় দেন।

সবুর শব্দটি এসেছে ص-ب-ر এর মূল থেকে, যার অর্থ হলো ধৈর্যশীল এবং সহনশীল, উত্তম আচরণের সাথে সন্তুষ্ট অবস্থায় অভিযোগ না করে দুঃখ-কষ্ট এবং পরীক্ষা শান্তভাবে সহ্য করা, অবিচল এবং সংযত থাকা, এবং কোন কিছু থেকে বিরত থাকা।

কুরআনে এই মূলটি বিভিন্ন রূপে এসেছে, এই রূপ গুলোর কিছু উদাহরণ হল – نَصۡبِرَ (আমরা ধৈর্য্য ধারণ করি/ করব), أَصۡبَرَهُمۡ (তাদের ধৈর্য্য), اِصۡبِرُواْ (তোমরা সবর কর), صَبَّارٍ (পরম ধৈর্যশীল) ইত্যাদি।

আল্লাহর ৯৯টি নামের মধ্যে ৮১টি নাম সুস্পষ্টভাবে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাকি ১৮টি নামের ব্যাপারে আলেমরা একমত হতে পারেননি। আল্লাহর আস-সবুর নামটি ইবনে উসাইমিন, ইবনে হাযম এবং ইবনে ওয়াজির আসমাউল হুসনার তালিকায় এই নামটি রাখেননি। যাইহোক, অন্য অনেক আলেম যেমন ইবনে আরাবী, ইমাম আল-বায়হাকী, এবং আল-গাজ্জালী, তাদের তালিকায় এই নামটি অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

আল্লাহর নিয়ামত অপরিসীম। আমরা আজীবন তাঁর কাছে ঋণী, তিনি আমাদের যে নিয়ামত দিয়েছেন তার প্রতিদান আমাদের পক্ষে কোনভাবেই দেওয়া সম্ভব নয়। আমাদের জীবন, স্বাস্থ্য, বিশ্বাস, প্রতিটি নিঃশ্বাস তাঁর অনুগ্রহ। বিনিময়ে আল্লাহ আমাদের কাছ থেকে খুব কমই প্রত্যাশা করেন, তারপরও আমরা তা পূরণ করতে পারি না। এমনকি নামাজটাও আমরা ঠিকমতো পড়ি না। শরীর দিয়ে আমরা উঠবস করি, জিহ্বা দিয়ে আমরা দু’আ, কুরআনের আয়াত, তাসবীহ পড়ি ঠিকই, কিন্তু আমাদের মন জাগতিক বিভ্রান্তিতে ব্যস্ত থাকে। সালাতে উপস্থিত থাকার পরিবর্তে আমাদের মন ঘুরে বেড়ায় নামাজের পর আমরা কি করব সে বিষয়ে।

অনেক সময় আমাদের আচার-আচরণে আমরা সীমা লংঘন করি, তাঁর আদেশ-নিষদ অমান্য করি। প্রতিটি পরিস্থিতিতে, তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করার এবং শাস্তি দেওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার থাকা সত্ত্বেও তিনি বিরত থাকেন কারণ তিনি আস-সবুর, আল-হালিম।

আল্লাহর এই বিশেষ প্রকৃতির সম্পর্কে ইমাম আল-গাজ্জালী বলেছেন – আল্লাহর এই সংযম কোন অলস ব্যক্তির মত নয় যে কার্য সম্পাদনে দেরি করে, অথবা এমন কোন হঠকারী ব্যক্তির মত নয় যে প্রতিশোধ নিতে তাড়াহুড়া করে। আস-সবুর প্রত্যেকটি জিনিসকে প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক সময়ে নিষ্পত্তি করেন‌। সবকিছুই আল্লাহর পরিকল্পনা অনুযায়ী নিখুঁত ভাবে পরিচালিত হয়।

আবু মুসা থেকে বর্ণিত রাসূল (সা:) বলেছেন –

‘কষ্টদায়ক কোন কথা শ্রবণ করার পর আল্লাহ তা‘আলা থেকে অধিক ধৈর্যশীল আর কেউ নেই। মানুষ আল্লাহর সঙ্গে শরীক করে এবং তাঁর জন্য সন্তান সাব্যস্ত করে; এরপরও তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন এবং তাদেরকে রিযিক দেন।’1

উপরোক্ত হাদিসে আল্লাহর আস-সবুর উপাধিটি উল্লেখ করা না হলেও, তাঁর ধৈর্যশীল প্রকৃতিকে বর্ণনা করা হয়েছে। একইভাবে কুরআনেও এমন অনেক আয়াত রয়েছে যা তাঁর ধৈর্যশীল সত্ত্বা এবং অবকাশ দেখানোর প্রকৃতিকে বর্ণনা করে।

وَلَوۡ يُؤَاخِذُ ٱللَّهُ ٱلنَّاسَ بِمَا كَسَبُواْ مَا تَرَكَ عَلَىٰ ظَهۡرِهَا مِن دَآبَّةٍ وَلَٰكِن يُؤَخِّرُهُمۡ إِلَىٰٓ أَجَلٍ مُّسَمًّىۖ فَإِذَا جَآءَ أَجَلُهُمۡ فَإِنَّ ٱللَّهَ كَانَ بِعِبَادِهِۦ بَصِيرًۢا
আর যদি আল্লাহ মানুষদেরকে তারা যা অর্জন করেছে তার জন্য পাকড়াও করতেন, তাহলে যমীনের উপর একটি প্রাণীকেও তিনি ছেড়ে দিতেন না। কিন্তু তিনি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদেরকে বিলম্বিত করে থাকেন। অতঃপর যখন তাদের সেই নির্দিষ্ট সময় এসে যায় (তখন তিনি তাদের পাকড়াও করেন), কেননা আল্লাহ তো তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে সম্যক দ্রষ্টা।2

আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?

আস-সবুরের ধৈর্যশীলতা এবং সহনশীলতার জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হন। কেউ আপনার দোষ ত্রুটি উপেক্ষা করলে আপনি যেমন কৃতজ্ঞ বোধ করেন, ঠিক তেমনি আপনার প্রতি আস-সবুরের তীব্র সহনশীলতাকে উপলব্ধি করুন এবং পাপ করার পরে তাঁর কাছেই ফিরে আসুন। আস-সবুরের সহনশীলতার জন্য কৃতজ্ঞ হওয়ার উপায় হিসাবে, নিজেকে ধৈর্যশীল এবং সহনশীল হতে প্রশিক্ষণ দিন।

অন্যদের প্রতি সহনশীল হোন; এ ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করুন এবং সহনশীলতার অনুশীলন করুন। রাসুল (সা:) আব্দুল কায়েসকে বলেন: আপনার মধ্যে দুটি গুণ রয়েছে যা আল্লাহ পছন্দ করেন: ধৈর্য ও স্থিরতা।3

শুধুমাত্র রাগের কারণে অনেক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। রাগ দেখানোর অবস্থানে থেকেও আপনি কিভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবেন? আস-সবুরের গুণাবলী দ্বারা নিজেকে অনুপ্রাণিত করুন, সহনশীলতা অনুশীলন করুন। রাগান্বিত বোধ করলে নিজেকে বলুন: আমি আমার রাগ দমন করছি কারণ আমি তাঁকে ভালবাসি এবং তাঁর ভালবাসার প্রত্যাশী, আমি তাঁর নিকটবর্তী হতে চাই এবং আমি তাঁর রাসুলকে (সা:) অনুসরণ করতে চাই।

কুরআন এবং হাদিস থেকে শিক্ষা নিন। নিজের ঈমানের প্রতি ধৈর্যশীল হতে, যারা আপনার ক্ষতি করতে চায় তাদের প্রতি সহনশীল হতে, বিপদে আপদে ধৈর্য্য ধারণ করতে এবং অশ্লীল ভাষা থেকে বিরত থাকতে কুরআন এবং হাদিস আমাদেরকে শিক্ষা দেয়। হাদিসে এসেছে রাসূল (সা:) বলেছেন-

‘যে ব্যক্তি পবিত্র থাকতে চেষ্টা করবে, আল্লাহ তাকে পবিত্র রাখবেন, যে ব্যক্তি (অপরের) অমুখাপেক্ষী থাকতে চেষ্টা করবে, আল্লাহ তাকে (সকল থেকে) অমুখাপেক্ষী করে দেবেন এবং যে ব্যক্তি ধৈর্য ধরতে চেষ্টা করবে, আল্লাহ তাকে ধৈর্য ধরতে সাহায্য করবেন। আর ধৈর্যের চেয়ে অধিক উত্তম ও ব্যাপক দান কাউকে দেওয়া হয়নি।4

রাসূলুল্লাহকে (সা:) বিশেষভাবে সম্বোধন করে আল্লাহ তা’আলা সব মুমিন মুসলিমদেরকে সবর করতে উৎসাহিত করেছেন।

وَٱصۡبِرۡ وَمَا صَبۡرُكَ إِلَّا بِٱللَّهِۚ وَلَا تَحۡزَنۡ عَلَيۡهِمۡ وَلَا تَكُ فِى ضَيۡقٍ مِّمَّا يَمۡكُرُونَ
আর তুমি সবর কর। তোমার সবর তো শুধু আল্লাহর তাওফীকেই। তারা যেসব ষড়যন্ত্র করছে তুমি সে বিষয়ে সংকীর্ণমনা হয়ো না।5

মহান আল্লাহ অবিশ্বাসীদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে মু’মিন, পরহেযগার ও সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে আছেন। আর আল্লাহ যাদের সঙ্গে থাকেন পৃথিবীর লোকেদের চক্রান্ত তাদের কোন ক্ষতি করতে পারে না।

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱسۡتَعِينُواْ بِٱلصَّبۡرِ وَٱلصَّلَوٰةِۚ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلصَّٰبِرِينَ
হে মুমিনগণ, ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।6

আস-সবুরের কাছে দু’আ করুন আপনার এবং আপনার প্রিয়জনদের প্রতি তাঁর সহনশীলতা প্রদর্শনের জন্য। তাঁর ক্ষমার জন্য প্রার্থনা করুন, কারণ একমাত্র তিনিই পারেন আপনাকে তাঁর ন্যায়সঙ্গত ক্রোধ থেকে রক্ষা করতে।

হে আল্লাহ আস-সবুর, আমরা জানি আপনি সবচেয়ে সহনশীল এবং আপনি আপনার শাস্তি বিলম্বিত করেন এবং অনেক সময় তা প্রজ্ঞার সাথে বাতিল করেন। হে আস-সবুর আপনি আমাদেরকে তৌফিক দিন যেন আমরা আপনার সবরের সুযোগ নিয়ে পাপ কাজে লিপ্ত না হই, এবং পাপ করলেও যেন আপনার কাছে প্রত্যাবর্তন করতে পারি। আপনার সহনশীলতার জন্য কৃতজ্ঞ হতে, কষ্টের সময় ধৈর্য ধারণ করতে, এবং অন্যদের সাথে আমাদের আচরণে সহনশীল হতে আমাদেরকে সহায়তা করুন। আল্লাহুম্মা আমীন!

আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।

আসমাউল হুসনা

  1. সহীহ বুখারী: ৬০৯৯ ↩︎
  2. সূরা ফাতির-৩৫:-৪৫ ↩︎
  3. সহীহ মুসলিম ↩︎
  4. বুখারী ১৪৬৯, মুসলিম ২৪৭১ ↩︎
  5. সূরা আন-নাহাল-১৬: আয়াত-১২৭ ↩︎
  6. সূরা বাকারাহ-২: আয়াত-১৫৩ ↩︎

লিখেছেন

ফাহমিনা হাসানাত

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

Exit mobile version