Writing

আসমাউল হুসনা – আর-রাউফ

আল্লাহ পবিত্র কুরআনে দশবার নিজেকে আর-রাউফ – দয়ালু, করুণাময় বলেছেন। তিনিই পরম কোমলতার সাথে কৃপা প্রদান করেন। আর-রাউফ আমাদের প্রতি করুনা করেন এবং একই সাথে তিনি আমাদেরকে মৃদুভাবে সতর্ক করেন, অনেক সময় তিনি কিছু জিনিস আমাদের কাছ থেকে প্রতিহত করেন এবং যা কিছু ভাল তা করার নির্দেশ দেন!

রাউফ এসেছে ر-ء-ف এর মূল থেকে, যা তিনটি প্রধান অর্থ নির্দেশ করে। প্রথম অর্থ হল দয়ালু এবং ক্ষমাশীল হওয়া; দ্বিতীয় অর্থ হল করুণাময় হওয়া; এবং তৃতীয় অর্থ হল কোমলতা প্রদর্শন করা।

রাউফ শব্দের অর্থ কোমল স্নেহ, সর্বোচ্চ করুণা ও দয়া, আর-রহীমের উচ্চ সীমা। আর-রাউফের অর্থ আর-রহীমের মতই, যা পরম কোমলতা, দয়া এবং স্নেহের উপর বিশেষভাবে জোর দেয়, এবং যার সাথে আরো যুক্ত হয়েছে রহমত ও করুণার বর্ষণ।

ভাষাগতভাবে, রাফা বলতে বোঝায় কোমলতা, দয়া এবং স্নেহ, যা দিয়ে আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জাল আমাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন। আল-গাজালি উল্লেখ করেছেন যে আর-রাউফ হলেন করুণাময়, এবং করুণা হল অনুগ্রহের তীব্র রূপ। অর্থের দিক থেকে অনেকটা রাহীমের মতো হলেও, রাউফের অর্থ আরো তীব্র। আর-রাউফ আমাদের উপর নানাভাবে তাঁর দয়া এবং করুনা বর্ষণ করেন, সতর্কতা এবং প্রতিরোধ সহ, দুনিয়া এবং আখিরাতের সাফল্যের জন্য তিনি আমাদের নির্দেশিত পথ দেখান।

আর-রাউফ নিজেই বলেছেন –

وَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِيُضِيعَ إِيمَٰنَكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ بِٱلنَّاسِ لَرَءُوفٌ رَّحِيمٌ
এবং আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তোমাদের ঈমানকে বিনষ্ট করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল, পরম দয়ালু।1
وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَشۡرِى نَفۡسَهُ ٱبۡتِغَآءَ مَرۡضَاتِ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ رَءُوفٌۢ بِٱلۡعِبَادِ
আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিজকে বিকিয়ে দেয়। আর আল্লাহ (তাঁর) বান্দাদের প্রতি স্নেহশীল।2
إِنَّهُۥ بِهِمۡ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ
নিশ্চয় তিনি তাদের প্রতি স্নেহশীল, পরম দয়ালু।3

আল্লাহর অসীম দয়া:

পবিত্র কুরআনে আল্লাহর আর-রাউফ নামটি দশবারের মধ্যে আটবার আল্লাহর আর-রাহীম নামের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা কীভাবে রাফা এবং রাহমা (রহমত) এর ধারণাটি বুঝতে পারি?
কোন বিপর্যয় যখন আমাদের আঘাত করে, আর-রহীম আমাদের প্রতি করুণা করেন। রাফা বলতে বোঝায় আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল প্রতিনিয়ত আমাদের যত্ন নিচ্ছেন এবং আমাদের সতর্ক করছেন যাতে আমরা তাঁর শাস্তি থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারি।

আর-রাউফ বলেছেন-

يَوۡمَ تَجِدُ كُلُّ نَفۡسٍ مَّا عَمِلَتۡ مِنۡ خَيۡرٍ مُّحۡضَرًا وَمَا عَمِلَتۡ مِن سُوٓءٍ تَوَدُّ لَوۡ أَنَّ بَيۡنَهَا وَبَيۡنَهُۥٓ أَمَدًۢا بَعِيدًاۗ وَيُحَذِّرُكُمُ ٱللَّهُ نَفۡسَهُۥۗ وَٱللَّهُ رَءُوفٌۢ بِٱلۡعِبَادِ
যেদিন প্রত্যেকে উপস্থিত পাবে যে ভাল আমল সে করেছে এবং যে মন্দ আমল সে করেছে তা। তখন সে কামনা করবে, যদি মন্দ কাজ ও তার মধ্যে বহুদূর ব্যবধান হত! আর আল্লাহ তোমাদেরকে তার নিজের ব্যাপারে সাবধান করছেন এবং আল্লাহ বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল।4

কখনো কি চিন্তা করে দেখেছেন কতটা করুণাময় আমাদের রব? আর-রাউফ তাঁর দয়া এবং স্নেহের কারণে আমাদের সতর্ক করছেন কিভাবে আমরা তাঁর শাস্তি এড়াতে পারি। আমাদের হেদায়েতের জন্য এবং তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনের জন্য তিনি নবী, রাসুল পাঠিয়েছেন, কুরআন প্রেরণ করেছেন।

রাফা এবং রাহমা এর ধারণা বোঝার জন্য একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। পিতা-মাতা যখন তাদের সন্তানকে শীতকালে গরম পোশাক পরার জন্য সতর্ক করেন যাতে তারা ঠান্ডায় না ভোগে, এটি হল রাফা, এবং যখন শিশুটি অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং পিতামাতার হৃদয় সন্তানের জন্য ব্যথিত হয় এবং তারা অসুখ নিরাময়ের জন্য যা কিছু করেন (যেমন সেবা সুশ্রষা করা, ওষুধের ব্যবস্থা করা) তাই হল রহমা।

আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?

আল্লাহর রাফা সম্পর্কে চিন্তা করুন। আপনি কি প্রতিদিন আর-রাউফের করুনার কথা চিন্তা করেন যিনি আপনাকে একজন মুসলিম হিসাবে পথ চলতে পথনির্দেশনা দিচ্ছেন।

وَإِن كَانَتۡ لَكَبِيرَةً إِلَّا عَلَى ٱلَّذِينَ هَدَى ٱللَّهُۗ وَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِيُضِيعَ إِيمَٰنَكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ بِٱلنَّاسِ لَرَءُوفٌ رَّحِيمٌ
যদিও তা অতি কঠিন (অন্যদের কাছে) তাদের ছাড়া যাদেরকে আল্লাহ হিদায়াত করেছেন এবং আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তোমাদের ঈমানকে বিনষ্ট করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল, পরম দয়ালু।5

আপনার জীবনে নির্দিষ্ট কিছু লক্ষণের মাধ্যমে তিনি আপনাকে সতর্ক করেন। এমন কি কখনো হয়েছে যখন আপনার মধ্যে এই রকম কিছু “অনুভূতি” কাজ করেছে — এই কাজটা করা উচিত নয়, বা ওই নির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়া উচিত নয়? অনুচিন্তন হল ‘ইবাদত’।

রাসুলের (ﷺ) রহমত থেকে শিক্ষা নিন।

আর-রাউফ রাসুলকে (ﷺ) সূরা আত-তাওবায় রাউফুন রাহিম বলে বর্ণনা করেছেন।

لَقَدۡ جَآءَكُمۡ رَسُولٌ مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ عَزِيزٌ عَلَيۡهِ مَا عَنِتُّمۡ حَرِيصٌ عَلَيۡكُم بِٱلۡمُؤۡمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ
নিশ্চয়ই তোমাদের নিজদের মধ্য থেকে তোমাদের নিকট একজন রাসূল এসেছেন, তা তার জন্য কষ্টদায়ক যা তোমাদেরকে পীড়া দেয়। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, পরম দয়ালু।6

রাসুল (ﷺ) তাঁর সঙ্গী, পরিবার এবং এমনকি তাঁর শত্রুদের সাথে কি রকম আচরণ করতেন তা জানতে সিরাত অধ্যয়ন করুন!

আপনার অন্তরে করুণা বৃদ্ধি করুন। অন্যদের প্রতি সদয় হন এবং অন্যের অনুভূতির প্রতি সহনশীল হন। কখনও কখনও আপনি আপনার নিজের জীবন, নিজের পরিবার, এবং বন্ধুদের নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে আপনি অন্যদের কথা ভুলে যান। মুসলিম উম্মাহর সাথে আপনি যে সংযোগ অনুভব করেন তাই আপনার ঈমানের আয়না। সারা বিশ্বে আপনার মুসলিম ভাই-বোনদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন, এবং কীভাবে তাদের সমর্থন করা যায় সে সম্পর্কে চিন্তা করুন। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিটি বিতরের নামাজে, নিশ্চিত করুন যে আপনি আপনার দু’আতে উম্মতকে স্মরণ করেছেন।

সক্রিয় হন। কেউ একবার বলেছিল:
‘আমি এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম যে কেউ এই ব্যাপারে কিছু করবে, তারপর বুঝলাম কেউ একজন আমি।’
আর-রাউফ আমাদের প্রতি করুণা করেন এবং তিনি আমাদের সতর্ক করেন কিভাবে তাঁর শাস্তি এড়াতে হয়। আপনি যদি আপনার ভাই বা বোনকে ঈমানের দিক থেকে দুর্বল দেখেন, অথবা বিপথগামী হতে দেখেন তবে তাদের জন্য উদ্বিগ্ন বোধ করুন এবং তাদের দয়া ও যত্ন সহকারে পরামর্শ দিন। মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করা এবং সৎকাজের আদেশ করা আপনার কর্তব্য; আপনি এটি কতটা গুরুত্ব সহকারে নেন?

কুরআনের জন্য আপনার হৃদয়কে উন্মুক্ত করুন। আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন –

هُوَ ٱلَّذِى يُنَزِّلُ عَلَىٰ عَبۡدِهِۦٓ ءَايَٰتٍۢ بَيِّنَٰتٍ لِّيُخۡرِجَكُم مِّنَ ٱلظُّلُمَٰتِ إِلَى ٱلنُّورِۚ وَإِنَّ ٱللَّهَ بِكُمۡ لَرَءُوفٌ رَّحِيمٌ
তিনিই তাঁর বান্দার প্রতি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ নাযিল করেন, যাতে তিনি তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনতে পারেন। আর নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু, পরম করুণাময়।7

আর-রাউফকে তাঁর অনুস্মারক– কুরআনের জন্য আপনার হৃদয়কে কোমল করতে বলুন!

আর-রাউফের কাছে প্রার্থনা করুন। আর-রাউফ এই নামটি ব্যবহার করে কুরআনে একটি সুন্দর প্রার্থনা উল্লেখ করেছেন।

وَٱلَّذِينَ جَآءُو مِنۢ بَعۡدِهِمۡ يَقُولُونَ رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَا تَجۡعَلۡ فِى قُلُوبِنَا غِلًّا لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ
যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে: ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন; এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না; হে আমাদের রব, নিশ্চয় আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু।8

এই সুন্দর দু’আটি মুখস্ত করুন, পড়ুন এবং অন্যদেরও শিখান।

হে আল্লাহ, আর-রাউফ, আমরা জানি যে আপনার দয়া আমাদের বেষ্টন করে আছে। আমাদের হৃদয়ে করুণা বৃদ্ধি করুন, আমরা যেন মন্দ কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পারি, এবং সৎকাজে নিজেকে এমনভাবে নিয়োজিত রাখতে পারে যা আপনার পছন্দনীয়। অন্যদেরকে অসৎ কাজে নিষেধ এবং সৎ কাজে নির্দেশ করার, এবং আপনার রাফা সম্পর্কে চিন্তা করার তৌফিক দান করুন। কুরআনের জন্য আমাদের হৃদয় উন্মুক্ত করুন এবং আপনার সতর্কবাণী অনুসরণকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন, যাতে আমরা আপনার শাস্তি এড়াতে পারি এবং নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারি, আল্লাহুম্মা আমীন!

আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।

আর-রাউফ

আসমাউল হুসনা

লিখেছেন

Picture of ফাহমিনা হাসানাত

ফাহমিনা হাসানাত

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

  1. সূরা বাকারাহ-২: আয়াত ১৪৩ ↩︎
  2. সূরা বাকারাহ-২: আয়াত ১০৭ ↩︎
  3. সূরা আত তাওবা-৯: আয়াত-১১৭ ↩︎
  4. সূরা আলি ইমরান-৩: আয়াত-৩০ ↩︎
  5. সূরা বাকারাহ-২: আয়াত-১৪৩ ↩︎
  6. সূরা আত তাওবা-৯: আয়াত-১২৮ ↩︎
  7. সূরা আল হাদীদ-৫৭: আয়াত-৯ ↩︎
  8. সূরা আল হাশর-৫৯: আয়াত-১০ ↩︎
Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button