আসমাউল হুসনা – আর-রাশীদ
আর-রাশীদ
অর্থ: সঠিক পথের নির্দেশক, বিচক্ষণ, সচেতন
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আর-রাশীদ, তিনি আমাদেরকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেন। আমাদেরকে সঠিক পথ এবং বিশ্বাসের দিকে পরিচালনা করার জন্য তিনিই সর্বোচ্চ পরিচালক। দ্বীনের ক্ষেত্রে তিনি মানুষকে বাধ্য করেন না, বরং তাঁর প্রেরিত কুরআন এবং রাসুলগনের মাধ্যমে তিনি সঠিক পথ দেখান।
রশীদ শব্দটি এসেছে ر-ش-د এর মূল থেকে, যার অর্থ সঠিকভাবে নির্দেশিত হওয়া, সঠিক পথ এবং সঠিক বিশ্বাসের দিকে পরিচালিত হওয়া।
এই মূলটি কুরআনে বিভিন্ন উদ্ভূত রূপে এসেছে, কয়েকটি উদাহরণ হল – يَرۡشُدُونَ (ইয়ারশুদুনা)- তারা সঠিক পথে চলবে; ٱلرَّشَاد (আর-রাশাদ)- সঠিক; رُشۡدًا (রুশদান)- বিচারের জ্ঞান, رَشَدًا (রাশাদান) – সুষ্ঠ ভাবে।
আল্লাহর ৯৯টি নামের মধ্যে ৮১টি নাম সুস্পষ্টভাবে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাকি ১৮টি নামের ব্যাপারে আলেমরা একমত হতে পারেননি। আল্লাহর আর-রাশীদ নামটি ইবনে উসাইমিন, ইবনে হাযম এবং ইবনে ওয়াজির আসমাউল হুসনার তালিকায় এই নামটি রাখেননি। যাইহোক, অন্য অনেক আলেম যেমন ইবনে আরাবী, ইমাম আল-বায়হাকী, এবং আল-গাজ্জালী, তাদের তালিকায় এই নামটি অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
অর্থের দিক থেকে আল্লাহর আর-রাশীদ (সঠিকভাবে নির্দেশিত) নামটি আল-হাদী (পথ-প্রদর্শক) নামের মত। যাইহোক, সঠিকভাবে নির্দেশিত বলাতে সব নেতিবাচক অর্থ বাতিল হয়ে যায়। তিনি তাঁর নির্দেশে অভ্রান্ত, এবং বিপথগামী হওয়া থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। এছাড়া আল্লাহর আল-হাকিম (বিচক্ষণ) নামের সাথেও এর মিল আছে। ইমাম আল গাজ্জালী আর রাশীদ সম্পর্কে বলেছেন – কোন উপদেষ্টার উপদেশ, কোন পরিচালকের পরিচালনা, কোন নির্দেশকের নির্দেশনা ছাড়াই কাজ করা, অর্থাৎ নিজে থেকেই সঠিকভাবে পরিচালিত হওয়া।
রাশিদ নামটি প্রায়ই ব্যবহৃত হয় একজন শিক্ষিত ব্যক্তিকে বর্ণনা করার জন্য, যিনি সঠিকভাবে পরিচালিত এবং যিনি সত্য বিশ্বাসকে ধারণ করেন। মুর্শিদ, একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ একজন শিক্ষক বা উপদেষ্টা এবং এই শব্দটিও একই মূল ر-ش-د থেকে উদ্ভূত। একজন শিক্ষকের কাজ হল একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের জন্য পর্থপ্রদর্শক বা অগ্রদূত হওয়া। নিচের আয়াতে, আমরা গায়ি’ (ভুল পথের নির্দেশনা) শব্দের ব্যবহার দেখব যা অর্থের দিক থেকে রুশদ শব্দের বিপরীত।
لَآ إِكۡرَاهَ فِى ٱلدِّينِۖ قَد تَّبَيَّنَ ٱلرُّشۡدُ مِنَ ٱلۡغَىِّۚ فَمَن يَكۡفُرۡ بِٱلطَّٰغُوتِ وَيُؤۡمِنۢ بِٱللَّهِ فَقَدِ ٱسۡتَمۡسَكَ بِٱلۡعُرۡوَةِ ٱلۡوُثۡقَىٰ لَا ٱنفِصَامَ لَهَاۗ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
দীন গ্রহণের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় হিদায়াত স্পষ্ট হয়েছে ভ্রষ্টতা থেকে। অতএব, যে ব্যক্তি তাগূতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।1
নির্দেশনার বিভিন্ন স্তর রয়েছে। ইসলাম গ্রহণ করা এবং আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া এক প্রকার দিকনির্দেশনা, তবে এতে আরও অনেক কিছু রয়েছে।
قَالُواْ يَٰقَوۡمَنَآ إِنَّا سَمِعۡنَا كِتَٰبًا أُنزِلَ مِنۢ بَعۡدِ مُوسَىٰ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيۡهِ يَهۡدِىٓ إِلَى ٱلۡحَقِّ وَإِلَىٰ طَرِيقٍ مُّسۡتَقِيمٍ
তারা বলল, ‘হে আমাদের কওম, আমরা তো এক কিতাবের বাণী শুনেছি, যা মূসার পরে নাযিল করা হয়েছে। যা পূর্ববর্তী কিতাবকে সত্যায়ন করে আর সত্য ও সরল পথের প্রতি হিদায়াত করে’।2
وَيَزِيدُ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ٱهۡتَدَوۡاْ هُدًىۗ وَٱلۡبَٰقِيَٰتُ ٱلصَّٰلِحَٰتُ خَيۡرٌ عِندَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيۡرٌ مَّرَدًّا
আর যারা সঠিক পথে চলে আল্লাহ তাদের হিদায়াত বৃদ্ধি করেন আর স্থায়ী সৎকর্মসমূহ তোমার রবের কাছে পুরস্কার প্রাপ্তির দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ এবং পরিণতি হিসেবেও শ্রেষ্ঠ।3
উপরের আয়াত দুটি থেকে স্পষ্ট হয় যে হেদায়েত বা নির্দেশনা বিভিন্ন ভাবে আসতে পারে। সত্যের পথের যে নির্দেশনা তা সচেতনতা, জ্ঞান, এবং উপলব্ধির আকারে আসতে পারে। পক্ষান্তরে সঠিক পথের নির্দেশনা বলতে আমাদের ক্রিয়াকলাপ, আচরণ – এসব সবকিছুকে আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করাকে বোঝায়। কাজেই এই দুই রকমের নির্দেশনাতেই আমরা নির্দেশিত পারি – ভালো কাজ, ধৈর্য, ন্যায়পরায়নতা, জ্ঞান, ঈমান, এবং বোধগম্যতায় আমরা বৃদ্ধি পেতে পারি।
আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?
আপনি যদি বিভ্রান্ত বোধ করেন বা হতাশায় ভোগেন, তাহলে আল্লাহর আল-হাদী, আর-রাশিদ এই নামগুলো স্মরণ করুন। আল্লাহ একজন জ্ঞানী পথপ্রদর্শক, তিনি যে কারো জন্য যে কোনো পথকে সহজ করে দিতে পারেন। তিনি আমাদের প্রাকৃতিক প্রবণতা জানেন, আমাদের জন্য উপযুক্ত এমন অনেক পথ তিনি উন্মোচন করতে পারেন। তিনি আমাদের জন্য তাঁর অনুমোদিত যে কোন লক্ষ্য অর্জনের পথকে সহজ করে দিতে পারেন। তাই সঠিক পথে প্রদর্শিত হওয়ার জন্য আর-রাশিদের কাছে সাহায্য চান।
অত্যাচারী শাসক থেকে পালাতে গুহায় আশ্রয় নেওয়া যুবকরা যে দু’আটি পাঠ করেছিল আমরা তা শিখতে পারি। তারা তাদের বিষয়গুলি পরিচালনা করার জন্য আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিল। এটি বাইরের ক্ষতি থেকে সুরক্ষা, ধৈর্য, বিধান এবং সামগ্রিক দিকনির্দেশনার জন্য একটি সর্বব্যাপী দু’আ।
إِذۡ أَوَى ٱلۡفِتۡيَةُ إِلَى ٱلۡكَهۡفِ فَقَالُواْ رَبَّنَآ ءَاتِنَا مِن لَّدُنكَ رَحۡمَةً وَهَيِّئۡ لَنَا مِنۡ أَمۡرِنَا رَشَدًا
যখন যুবকরা গুহায় আশ্রয় নিল অতঃপর বলল, ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে আপনার পক্ষ থেকে রহমত দিন এবং আমাদের জন্য আমাদের কর্মকান্ড সঠিক করে দিন’।4
আল্লাহ আর-রাশিদ – পথপ্রদর্শক, এটা জেনে স্বস্তিবোধ করুন। তিনি একজন অবিশ্বাস্য পরিচালক এবং অদম্য শিক্ষক। কুরআন এবং রাসূলগণের মাধ্যমে যে নির্দেশনা তিনি আমাদের দিয়েছেন সেটাই প্রকৃত সত্য। প্রত্যেকটি বিষয়ে সঠিকভাবে নির্দেশিত হওয়ার জন্য আমাদের উচিত আর-রাশিদের কাছে প্রার্থনা করা। জীবনের যে কোনো পরিস্থিতিতে আমাদেরকে প্রথমে চিন্তা করতে হবে আমাদের প্রতিক্রিয়া কি রকম হলে আল্লাহ আমাদের উপর সন্তুষ্ট হবেন।
আমাদের সঠিক ভাবে নির্দেশিত হতে হবে যাতে আল্লাহ আমাদের কাছ থেকে যা চান তা আমরা পূরণ করতে পারি। আমরা যদি আল্লাহর আর-রাশিদ নামটি বুঝতে পারি তাহলেই আমরা উপলব্ধি করতে পারব যে আল্লাহ আমাদের জন্য যে দিকনির্দেশনা দেন সেটিই সর্বোত্তম, আপাতদৃষ্টিতে তা মনে না হলেও।
আমরা যদি সুন্দর আখলাককে নিজের মধ্যে ধারণ করতে চাই, তাহলে আমাদের কথাবার্তা, জ্ঞান, বিচার-বিবেচনা, ও আবেগের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে পরিচালিত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে, আবেগের ভারসাম্যকে আয়ত্ত করার চেষ্টা করতে হবে। যখন আমরা আমাদের প্রিয়জনদের হারাই, তখন শোক প্রকাশ করা স্বাভাবিক, কিন্তু আল্লাহর কদরে অসন্তুষ্ট হলে চলবে না।
এমনকি রাগের সময়ও সঠিকভাবে পরিচালিত হওয়াও সম্ভব, যেমন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাগ করা জায়েজ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখনই ক্রুদ্ধ হতেন যখন আল্লাহর হুকুম লঙ্ঘন করা হতো। কিন্তু তাও তিনি করতেন সুন্দর বাকপটুতার সাথে, ঝগড়া করার জন্য বা কাউকে প্রকাশ্যে অপমানিত করার জন্য নয়, বরং কাউকে আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়ার জন্য। আবেগের ক্ষেত্রে এরকম ভারসাম্য বজায় রাখা একমাত্র অন্যান্য গুণসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব।
ٱهۡدِنَا ٱلصِّرَٰطَ ٱلۡمُسۡتَقِيمَ
আমাদেরকে সরল পথের হিদায়াত দিন।5
صِرَٰطَ ٱلَّذِينَ أَنۡعَمۡتَ عَلَيۡهِمۡ غَيۡرِ ٱلۡمَغۡضُوبِ عَلَيۡهِمۡ وَلَا ٱلضَّآلِّينَ
তাদের পথ, যাদের উপর আপনি অনুগ্রহ করেছেন। যাদেরকে নিয়ামত দিয়েছেন।যাদের উপর (আপনার) ক্রোধ আপতিত হয়নি এবং যারা পথভ্রষ্টও নয়।6
অন্যকে সঠিক পথের দাওয়াত দিন। প্রথমে নিজের অনুকরণীয় আচরণের মাধ্যমে অন্যদেরকে সরল পথের আমন্ত্রণ জানান। যাই হোক না কেন, জেনে রাখুন যে প্রকৃত নির্দেশনা আসে আর-রাশিদ থেকে, আর এই অনুধাবনটুকু অন্যদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান করার ব্যাপারে আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়াবে, কারণ আপনি জানেন যে ফলাফলগুলি আপনার দাওয়াহ বা বক্তব্যের উপর নির্ভরশীল নয় বরং আর-রাশিদের নির্দেশনার উপর নির্ভরশীল। তাই দাওয়ার কাজ করতে গিয়ে হতাশ হলে বা অহংকারী হলে চলবে না।
হে আল্লাহ, আর-রাশিদ, আমরা জানি আপনিই চূড়ান্ত পথপ্রদর্শক। আমাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করুন এবং আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা প্রতিটি বিষয়ে আপনার কাছে আন্তরিকভাবে সঠিক নির্দেশনা প্রার্থনা করে। আপনার নির্দেশনা সম্পর্কে সচেতন হতে ও কৃতজ্ঞ হতে আমাদের অনুপ্রাণিত করুন। অন্যদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতে আমাদের সাহায্য করুন এবং আপনার জান্নাতে প্রবেশ করার জন্য আমাদেরকে চূড়ান্ত নির্দেশনা দিয়ে আশীর্বাদ করুন, আল্লাহুম্মা আমীন!
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
- সূরা বাকারাহ-২:আয়াত-২৫৬ ↩︎
- সূরা আহকাফ-৪৬: আয়াত-৩০ ↩︎
- সূরা মারিয়াম-১৯: আয়াত:৭৬ ↩︎
- সূরা আল কাহাফ-১৮: আয়াত-১০ ↩︎
- সূরা আল-ফাতিহা-২: আয়াত-৬ ↩︎
- সূরা আল-ফাতিহা-২: আয়াত-৭ ↩︎