আসমাউল হুসনা – আল-ওয়াসি
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে নিজেকে আল-ওয়াসি’ —সর্ব-পরিবেষ্টনকারী, পর্যাপ্ত, অসীম— বলেছেন নয়টি উপলক্ষে। আল-ওয়াসি’ অসীম, তাঁর ক্ষমতা অফুরন্ত। তিনি তাঁর আশীর্বাদ, যত্ন এবং দয়া দিয়ে সমগ্র সৃষ্টিকে বেষ্টন করে রেখেছেন। তিনিই স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সকলের জন্যই যথেষ্ট। কিছুই তাঁর উর্ধ্বে নয়, এবং তাঁর গুণের কোনো সীমা নেই; আমাদের পক্ষে তাঁর ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়!
ওয়াসি’ و-س-ع এর মূল থেকে এসেছে, যা তিনটি প্রধান অর্থ বহন করে। প্রথম অর্থ হল বিশাল, ধারণক্ষমতা বা আকারে যথেষ্ট এবং প্রশস্ত হওয়া। এই মূলের দ্বিতীয় অর্থ হল প্রচুর এবং পর্যাপ্ত হওয়া। তৃতীয় অর্থ হল আলিঙ্গন করা, উপলব্ধি করা এবং পরিব্যাপ্ত হওয়া।
এই মূলটি কুরআনে ৩২ বার ছয়টি উদ্ভূত রূপে উপস্থিত হয়েছে। এই রূপগুলির উদাহরণ হল وَٰسِعَ – ওয়াসিয়া (অন্তর্ভুক্ত), وُسْعَهَا – উসআ’হা (এর ক্ষমতা), এবং وَٰسِعَةٌ – ওয়াসিআতুন (প্রশস্ত)।
আরবি ভাষায় ওয়াসি’র ধারণা এমন কিছুকে ইঙ্গিত করে যার কোনো সীমা নেই; এবং তা এতটাই সীমাহীন যে আমাদের কল্পনাতীত। আল্লাহর এই গুণটি তাঁর অন্যান্য গুণের মতোই সীমাহীন, যেমন তাঁর দান করা, দেখা, শ্রবণ করা এবং তাঁর জ্ঞান।
আল-ওয়াসি নিজেই বলেছেন –
....وَ اِنۡ یَّتَفَرَّقَا یُغۡنِ اللّٰهُ کُلًّا مِّنۡ سَعَتِهٖ ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ وَاسِعًا حَکِیۡمًا
....আর যদি তারা উভয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তবে আল্লাহ প্রত্যেককে নিজ প্রাচুর্য দ্বারা অভাবমুক্ত করবেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, প্রজ্ঞাবান।1
....ذٰلِکَ فَضۡلُ اللّٰهِ یُؤۡتِیۡهِ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰهُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ
.....এটি আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি তাকে তা দান করেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।2
.....اِنَّ رَبَّکَ وَاسِعُ الۡمَغۡفِرَۃِ......
.....নিশ্চয় তোমার রব ক্ষমার ব্যাপারে উদার.....3
আল-ওয়াসি তাঁর ওয়াসিয়ার বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে একটি আশ্চর্যজনক, সুন্দর প্রার্থনার জন্য আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন এবং দু’আয়াটি আমাদের সকল চাওয়াকে এবং সবকিছুকেই পরিবেষ্টন করে।
وَ اکۡتُبۡ لَنَا فِیۡ هٰذِهِ الدُّنۡیَا حَسَنَۃً وَّ فِی الۡاٰخِرَۃِ اِنَّا هُدۡنَاۤ اِلَیۡکَ ؕ قَالَ عَذَابِیۡۤ اُصِیۡبُ بِهٖ مَنۡ اَشَآءُ ۚ وَ رَحۡمَتِیۡ وَسِعَتۡ کُلَّ شَیۡءٍ ؕ فَسَاَکۡتُبُهَا لِلَّذِیۡنَ یَتَّقُوۡنَ وَ یُؤۡتُوۡنَ الزَّکٰوۃَ وَ الَّذِیۡنَ هُمۡ بِاٰیٰتِنَا یُؤۡمِنُوۡنَ
আর আমাদের জন্য এ দুনিয়াতে ও আখিরাতে কল্যাণ লিখে দিন। নিশ্চয় আমরা আপনার দিকে প্রত্যাবর্তন করেছি।’ তিনি বললেন, ‘আমি যাকে চাই তাকে আমার আযাব দেই। আর আমার রহমত সব বস্তুকে পরিব্যাপ্ত করেছে। সুতরাং আমি তা লিখে দেব তাদের জন্য যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যাকাত প্রদান করে। আর যারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি ঈমান আনে।4
সাফল্যের সূত্র কেমন হওয়া উচিত? হৃদয়ে ভয় রাখুন, কারণ আল-ওয়াসি যাকে ইচ্ছা শাস্তি দিতে পারেন। আশা রাখুন, কারণ তাঁর রহমত সবকিছুকে ঘিরে রেখেছে। পাপ কাজ থেকে দূরে থাকুন, নিজেকে এবং নিজের সম্পদকে পবিত্র করুন। আমাদের উপলব্ধির জন্য পবিত্র কুরআনে এবং মহাবিশ্বে যে নিদর্শনগুলি দেওয়া হয়েছে তাতে বিশ্বাস রাখুন।
আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?
আল-ওয়াসীর প্রশংসা বৃদ্ধি করুন। তিনিই যার গুণাবলী অপরিসীম, তাঁর সাথে সংযুক্ত সবকিছুই বিশাল, অসীম, এবং নিখুঁত। আল-ওয়াসি’ হলেন তেমন, যেমন তিনি নিজের প্রশংসা করেছেন। আমরা তাঁর প্রাপ্য প্রশংসা করতে পারি না কিন্তু আমরা যতটা সম্ভব তাঁকে স্মরণ ও প্রশংসা করার চেষ্টা করতে পারি। আমরা কি সত্যিই সারাদিন সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ এবং আল্লাহু আকবার এই জিকিরগুলো করি? সারাদিন না হলেও আমাদের অবসর মুহূর্তগুলো কি আমরা কাজে লাগাই তাঁর স্মরণে? আমরা কি সত্যিই আল্লাহর স্মরণে আমাদের জিহ্বাকে সিক্ত রাখি? নিজেকে আল-ওয়াসির বিশালতার এই মহান গুণের কথা মনে করিয়ে দিন এবং আপনার প্রতিদিনের জিকির বাড়িয়ে দিন!
তাঁর রাজত্ব নিয়ে চিন্তা করুন। আমরা দেখতে পাই বা না পাই, তাঁর রাজ্য সবকিছুকে ঘিরে রেখেছে। আল-ওয়াসি’র সীমাহীনতা উপলব্ধি করতে তাঁর সৃষ্টির দিকে তাকান। আকাশ এবং ছায়াপথ, ভারসাম্য, পরিপূর্ণতা এবং মহাবিশ্বের দিকে দৃষ্টিপাত করুন, যা আমাদের কাছে এখনও অজানা।
আল-ওয়াসির কাছে প্রার্থনা করুন। তাঁর ক্ষমতা সবকিছুকে ঘিরে আছে এবং আল-ওয়াসি করতে পারে না এমন কিছুই নেই। তাঁর বিশাল আধিপত্যে প্রতিটি অনুরোধে সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা তিনি রাখেন। তাই আপনার প্রতিটি প্রয়োজনে তাঁর কাছে প্রার্থনা করুন এবং প্রতিটি উদ্বেগে তাঁর কাছেই প্রত্যাবর্তন করুন।
ভালো কাজে অগ্রদূত হন। তাঁর আধিপত্যের বিশালতা কল্পনাতীত। আল-ওয়াসি’ আপনাকে এই পৃথিবীতে স্থাপন করেছেন এবং তিনি আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করছেন। আপনি যা করেছেন, করেন এবং করবেন সে ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণভাবে জ্ঞাত।
اِنَّمَاۤ اِلٰـهُکُمُ اللّٰهُ الَّذِیۡ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ؕ وَسِعَ کُلَّ شَیۡءٍ عِلۡمًا
তোমাদের ইলাহ তো কেবল আল্লাহই। তিনি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ নেই। সকল বিষয়েই তার জ্ঞান পরিব্যাপ্ত।5
এই পৃথিবীতে আপনার ভূমিকাকে গুরুত্ব সহকারে নিন। অন্যদের আল-ওয়াসি’র দিকে ডাকুন এবং নেক আমলের মাধ্যমে নিজেকে ইসলামের একজন অগ্রদূত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করুন।
আল্লাহর কোন বৈশিষ্ট্যে কখনো নিরাশ হবেন না। আল-ওয়াসি’র যেকোন ক্ষমতায় হতাশ হওয়ার অর্থ হল আপনি তাঁর উপর সীমাবদ্ধতা অর্পণ করছেন, বস্তুত তাঁর ক্ষমতা অসীম। আল্লাহ যেনো আমাদের এই ধরনের চিন্তা থেকে রক্ষা করেন! আপনি যদি মনে করেন যে তিনি আপনাকে ক্ষমা করতে পারবেন না কারণ আপনি খুব খারাপ, তাহলে আপনি তাঁর অসীম করুণার গুণটিকে অস্বীকার করছেন। তাই তাঁর যে কোনো ভূমিকায় কখনোই নিরাশ হবেন না, তা যাই হোক না কেন — প্রদানকারী, বিচারক, অথবা প্রার্থনার উত্তরদাতা। তাঁর সমস্ত ক্ষমতা কোন কিছু বা কারও দ্বারা সীমাবদ্ধ নয় — এই বিশ্বাসে দৃঢ় থাকুন।
আপনার কর্ম সম্পর্কে সচেতন হন। আল-ওয়াসি বলেছেন –
وَ لِلّٰهِ الۡمَشۡرِقُ وَ الۡمَغۡرِبُ ٭ فَاَیۡنَمَا تُوَلُّوۡا فَثَمَّ وَجۡهُ اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ
পূর্ব পশ্চিম আল্লাহরই, সুতরাং তোমরা যে দিকেই মুখ কর না কেন, সেদিকেই আছে আল্লাহর চেহারা, আল্লাহ সুবিস্তৃত, সর্বজ্ঞ।6
যদিও এই আয়াতটি নামাযের দিক নির্দেশনা (কিবলা) সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছিল, তবুও আপনি এই আয়াতটিকে নিজের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে সচেতন হতে অনুপ্রাণিত করতে পারেন সেই আল-ওয়াসির কথা স্মরণে রেখে যার জ্ঞান, শ্রবণ, করুণা এবং শক্তি সর্বব্যাপী।
আপনার উদারতা দিয়ে অন্যদের আলিঙ্গন করুন। সর্বদা আল-ওয়াসি’র সমস্ত দাসদের প্রতি আপনার দয়া এবং উত্তম আচরণ প্রদর্শন করুন। অন্যদের প্রতি দয়ালু হন এবং যখন কেউ আপনার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে তখন তাদের আহবানে মনোযোগী হন।
হে আল্লাহ, আল-ওয়াসি’, আমরা জানি যে আপনি সবকিছু এবং সবাইকে বেষ্টন করে আছেন। আমাদেরকে আপনার এমন ইবাদতকারী এবং জিকিরকারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন — যারা আপনার বিশালতা ও পরিপূর্ণতাকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করে এবং যাদের কর্ম এই সচেতনতাকে প্রতিফলিত করে। আপনার অফুরন্ত আধিপত্য নিয়ে যেন আমরা চিন্তা ভাবনা করতে অনুপ্রাণিত হই এবং জীবনের প্রতিটি প্রয়োজনে যেন আপনার কাছে চাইতে পারি এবং আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তন করি। এই পৃথিবীতে একজন সদয় এবং ন্যায়পরায়ণ অগ্রদূত হতে আমাদেরকে পথপ্রদর্শন করুন এবং আপনার প্রতি আমাদের বিশ্বাসকে এমনভাবে দৃঢ় করুন যাতে আপনার কোন বৈশিষ্ট্যে আমরা সন্দেহ পোষণ না করি। আল্লাহুম্মা আমীন!
আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
- সূরা আন-নিসা-৪: আয়াত-১৩০ ↩︎
- সূরা মা’ইদাহ-৫: আয়াত-৫৪ ↩︎
- সূরা আন-নাজাম-৫৩: আয়াত-৩২ ↩︎
- সূরা আল-আরাফ-৭: আয়াত-১৫৬ ↩︎
- সুরা তাহা-২০: আয়াত-৯৮ ↩︎
- সূরা আল-বাকারাহ-২: আয়াত-১১৫ ↩︎